খলিল চৌধুরী, সৌদি আরব
মহামারি করোনা ভাইরাসের কারণে আতংকিত বিশ্ব, ঝরছে হাজারও মানুষের প্রাণ। মহামারি এই করোনা ভাইরাসের চেয়ে ভয়ংকর রূপ ধারণ করেছে হ্নদরোগ। করোনা সংক্রমণে এ পর্যন্ত সৌদি আরবের মারা গেছেন ৭জন প্রবাসী বাংলাদেশি । কিন্তু দেশটিতে এ মহামারী শুরু হবার পর থেকে হ্নদরোগে আক্রান্ত হয়ে মারা গেছেন ৩৫ জন। প্রতিদিন মৃত্যুর মিছিলে যোগ হচ্ছে প্রবাসী এ রেমিটেন্স যোদ্ধারা।
হ্নদরোগ কেড়ে নিচ্ছে প্রতিদিন হাজার ও প্রবাসীর জীবন। এই টিকে নীরব ঘাতক বলা চলে। আবার এটি সারাবিশ্বেই মারণব্যাধি হিসেবে স্বীকৃত। প্রতিনিয়ত হার্টঅ্যাটাকে শতকরা ২৫ জন এক ঘণ্টার মধ্যে মারা যায়।

সম্প্রতি মধ্যপ্রাচ্যে দেশ সৌদি আরবে এই রোগের কারণে প্রবাসী বাংলাদেশিদের মৃত্যুর হার ক্রমশ বেড়ে চলছে। পরিসংখ্যান বলছে আগের বছরের তুলনায় ২০১৯ সালে প্রবাসী মৃত্যু বেড়েছে ১৩ শতাংশ। যদিও এটি দেশে ফেরত যাওয়া বৈধ প্রবাসী শ্রমিকদের মরদেহের হিসাব মাত্র। বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই এসব শ্রমিকের মৃত্যুর কারণ স্ট্রোক ও হৃদরোগ। এদের অধিকাংশেরই বয়স ২৫-৩৫ বছরের মধ্যে।

সরকারি হিসাব মতে প্রতিবছর মরদেহ যাই মধ্যপ্রাচ্য থেকে আর এর মধ্যে বেশির ভাগ যায় সৌদি আরব থেকে। সরকার যাদের রেমিটেন্স যোদ্ধা হিসেবে স্বীকৃতি দিচ্ছে, যাদের মাথার ঘাম পায়ে পেলে দেশের জন্য রেমিটেন্স পাঠাচ্ছে, দেশ আজ উন্নত-সমৃদ্ধ দেশে পরিনত হচ্ছে, এই সমস্ত রেমিটেন্স যোদ্ধারা কেন অকালে প্রাণ হারাচ্ছে, সুস্থ্য মানুষ দেশ থেকে আসা পরও প্রবাসী শ্রমিকদের স্ট্রোক ও হৃদরোগে মৃত্যু কেন বাড়ছে, তা খতিয়ে দেখা উচিত নয় কি সরকারের?

দীর্ঘদিন ধরে সৌদি আরবে সাংবাদিকতা আর শ্রমিকদের নিয়েও কাজ করছেন চ্যানেল আই সৌদি আরব প্রতিনিধি এম ওয়াই আলাউদ্দিন। তিনি জানান, বাংলাদেশ থেকে বেশীরভাগ কর্মী ঋণ নিয়ে বিদেশে আসেন, অনেকে বাড়ি ঘর বন্ধক রেখে কেউ বা মহাজনের কাজ থেকে কড়া সুদে টাকা নিয়ে বিদেশে আসার পর যে বেতনের কথা দালালরা বলেন, সেই বেতন পাই না। এই নিয়ে বড় মানসিক চাপ কাজ করে তার সঙ্গে তো আছে হাড়ভাঙা পরিশ্রম। এভাবে শারীরিক ও মানসিক চাপে হার্টঅ্যাটাক করে মারা যান অনেক প্রবাসী শ্রমিক।

তিনি আরও বলেন, সৌদি আরবে চার থেকে পাঁচ লক্ষ টাকা ব্যয়ে করে প্রবাসে আসা ব্যয়ের তুলনায় আয় কম, দীর্ঘদিন স্বজনদের থেকে বিচ্ছিন্ন থাকার ফলে একাকিত্বই প্রবাসী শ্রমিকদের হৃদরোগের প্রধান কারণও হতে পারে বলে মনে করছেন তিনি।

জেদ্দা প্রবাসী মোসেলেম উদ্দিন মোসেলেম বলেন, আমরা প্রবাসীরা মৃত্যু যখন কাছ থেকে দেখি। কোম্পানী বন্ধ, কর্মী ছাঁটাই, বাইরে কাজ নেই, লকডাউন, রুমে বন্ধি জীবন, ব্যবসা বন্ধ, নিজে চলার পয়সাও নেই, সবসময় করোনা আতঙ্ক !
নিজে মারা গেলে লাশটা দেশে যাবে কিনা সন্দেহ। অন্যদিকে কোন প্রিয়জনের মৃত্যুতে দেশে যাবার সুযোগটাও নেই। কারণ, নিরাপত্তার জন্য ফ্লাইট বন্ধ। প্রবাসীরা কদিন আগে নিজ দেশের বোঝা হলেও এখন নিজেই নিজের কাছে বোঝা, নিজেই চলতে হিমশিম খায়। এই কারণে ও হ্নদরোগে মৃত্যুর হার বেড়ে চলেছে বলে মনে করছেন তিনি।

লোহাগাড়া প্রবাসী সমিতি-সৌদি আরবের ভারপ্রাপ্ত আহবায়ক প্রবাসী মুহাম্মদ কুতুব উদ্দিন তিনি মনে করছেন, করোনার প্রভাবে বন্ধ রয়েছে সব ধরনের ব্যবসা ব্যানিজ্য ও কর্মজীবন। প্রতি নিয়ত হারাতে হচ্ছে চাকরি। পড়ছে আতংকে দিন কাটাচ্ছে দুশ্চিন্তায়। একেতো প্রবাসে খাওয়া দাওয়া, ঘর ভাড়া থেকে শুরু করে কপিল (নিয়োগ কর্তার) টাকা। মাস শেষে পরিবারের জন্য কি ভাবে পাঠাবে টাকা, সব মিলিয়ে অস্তিরতায় কাঠছে জীবন।
যারা ব্যবসা করছেন তাদের অবস্থা ভয়াবহ, প্রতিদিন গুনতে হচ্ছে লোকসানের খাতা, কর্মচারীর বেতন, দোকান ভাড়া থেকে শুরু করে আনুসাঙ্গিক খরচ। এতে অসুস্থ হয়ে পড়ছে আর নিরবে ঘুমের মধ্যে এই দুশ্চিন্তা মাথায় নিয়ে অকালে চলে যেতে হচ্ছে পরপারে।
প্রবাসীদের ক্লান্তিমাখা ও অসুস্থ শরীরটা প্রবাসে থাকলেও মনটা পড়ে থাকে ঠিক মাতৃভুমিতে। প্রতিনিয়ত মনটা কাঁদে নিজ প্রিয়জনের জন্য। তারা কেমন আছে, কি ভাবে খাচ্ছে। প্রবাসীদের একটাই চিন্তা এই ভাইরাসে আমার কিছু হলে আমার পরিবারের কি হবে?

প্রবাসীরাদের যেখানে নিজের ভবিষ্যত অনিশ্চিত, সেইখানে নিজের পরিবারের সুরক্ষা নিশ্চিত করতে দিশেহারা। তাই যেকোন উপায়ে পরিবারের জন্য টাকা পাঠাতে পারলেই মহাখুশি। পরিবারের কথা চিন্ত করে প্রবাসে মৃত্যুর কথা না ভেবে প্রতিনিয়ত আপন জনের কথা চিন্তা করে কাঠছে প্রবাসীদের জীবন।
অসহায় এই প্রবাসীরা এমন একটা ভোরের অপেক্ষায় আছে, কখন ঘুম থেকে উঠে শুনতে পাবে পুরো পৃথিবীটা সুস্থ আছে! মহামারি করোনার ঝড় থেমে গেছে।