নাগিব বাহার,
বিবিসি বাংলা, ঢাকা:

করোনাভাইরাস প্রাদুর্ভাব নিয়ন্ত্রণের উদ্দেশ্যে বিশ্বের বিভিন্ন দেশে এবং অঞ্চলে বিভিন্ন মাত্রার ‘লকডাউন’ আরোপ করা হলেও বাংলাদেশে সরকার আনুষ্ঠানিকভাবে লকডাউন শব্দটি ব্যবহার করা থেকে বিরত থেকেছে।

বাংলাদেশে প্রথম দফায় ২৬শে মার্চ থেকে ৪ঠা এপ্রিল পর্যন্ত ‘সাধারণ ছুটি’ ঘোষনা করার পর দুই দফায় ছুটির মেয়াদ ১৪ই এপ্রিল পর্যন্ত বাড়ানো হয়।

ভাইরাস ছড়ানো কমাতে মানুষ যেন সামাজিক দূরত্ব মেনে চলে এবং অন্য মানুষের সংস্পর্শে আসার সুযোগ না পায়, সে লক্ষ্যে চীনের উহান, ইতালির লোমবার্ডি প্রদেশ সহ বিশ্বের বিভিন্ন এলাকায় – বিশেষ করে যেসব জায়গায় করোনাভাইরাস ব্যাপকভাবে ছড়িয়ে পড়েছে – লকডাউন আরোপ করে কর্তৃপক্ষ।

ওই সব জায়গায় অঞ্চলভেদে স্বল্প পরিসরে খাবারের দোকান এবং ওষুধের দোকান বাদে অন্য সব দোকানপাট বন্ধ রাখা হয়। জরুরি প্রয়োজন ছাড়া ঘরের বাইরে মানুষের বের হওয়ার ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা হয় এবং নিষেধাজ্ঞা লঙ্ঘন করলে অর্থদণ্ড এবং কারাদণ্ডের মত জরিমানার শাস্তিও আরোপ করা হয়।

সৌদি আরব, কুয়েতসহ মধ্যপ্রাচ্যের কয়েকটি দেশে মানুষ যেন ঘর থেকে বের না হতে পারে তা নিশ্চিত করতে দিনের বড় একটা সময় কারফিউ জারি করা হয়। অনেক এলাকাতেই এই কারফিউর সময় প্রশাসনের পক্ষ থেকে মানুষের কাছে প্রয়োজনীয় খাবার এবং ওষুধ পৌঁছে দেয়া হয়।

কিন্তু লকডাউন আরোপ করা হলে সাধারণ মানুষ দৈনন্দিন জীবনযাপনে স্বাস্থ্যসেবা এবং দৈনন্দিন খাদ্য জোগাড়ের ক্ষেত্রে যেসব সমস্যার সম্মুখীন হয়, সেসব সমস্যা নিরসনে সরকারের কি কোনো ধরণের বাধ্যবাধকতা রয়েছে?

মানুষকে ঘরে থাকার আহ্বান করা হলেও বাংলাদেশে অনেক জায়গাতেই মানুষ নিষেধাজ্ঞা মানছে নামানুষকে ঘরে থাকার আহ্বান করা হলেও বাংলাদেশে অনেক জায়গাতেই মানুষ নিষেধাজ্ঞা মানছেন না

লকডাউনে সরকারের দায়িত্ব কী?

মন্ত্রিপরিষদ বিভাগের সাবেক সচিব আলী ইমাম মজুমদার বিবিসি বাংলাকে বলেন, বাংলাদেশে এ ধরণের লকডাউন আরোপ করা হলে জনগণের কাছে জীবনযাপনের জন্য প্রয়োজনীয় পণ্য পৌঁছে দেয়া সরকারের নৈতিক দায়িত্ব হলেও আইনগতভাবে তাদের কোনো বাধ্যবাধকতা নেই।

তিনি বলেন, “কারফিউ জারি করা হলে যখন রাস্তায় কেউ বের হতে পারে না, তখন মানুষের জীবনযাপনে সমস্যা তৈরি হয়। কিন্তু এ রকম সময় সরকারের আইনগত কোনো বাধ্যবাধকতা নেই মানুষের কাছে সাহায্য পৌঁছে দেয়ার।”

কিন্তু এরকম ক্ষেত্রে সরকার তার নৈতিক দায়িত্ববোধ থেকে মানুষের দৈনন্দিন জীবন সহজ করার জন্য পদক্ষেপ নিয়ে থাকে বলে মন্তব্য করেন মি. মজুমদার।

“গণপরিবহন ও দোকানপাট বন্ধ থাকায় এ রকম সময়ে দরিদ্রদের কাছে খাদ্যসামগ্রী ও জরুরি পণ্য পৌঁছে দেয়ার জন্য স্থানীয় প্রশাসনের সাথে সমন্বয় করে সরকারি সংস্থাগুলোকে নিয়োগ করা হয়।”

আলী ইমাম মজুমদার বলেন, শুধু গণতান্ত্রিক সরকার ব্যবস্থাতেই নয়, যেসব রাষ্ট্রে রাজতন্ত্র বিদ্যমান সেসব রাষ্ট্রেও সরকার তার নৈতিক দায়িত্ব থেকেই এ ধরণের বিশেষ পরিস্থিতিতে নাগরিকদের কাছে খাবার ও জরুরি সেবা পৌঁছানোর ব্যবস্থা করে থাকে।

“লকডাউন অনেকটা জরুরি অবস্থা বা কারফিউ জারি করার মত,” মন্তব্য করেন সরকারের সাবেক এই শীর্ষ কর্মকর্তা। তিনি এ-ও বলেন যে এই ধরণের পরিস্থিতিতে নাগরিকদের যেন টানা লম্বা সময়ের জন্য অবরুদ্ধ অবস্থায় না রাখা হয়, তারা যেন কিছুটা ছাড় পায় সেই বিষয়গুলো মাথায় রাখা হয়।

লকডাউন আরোপ করা হলে দরিদ্র নাগরিকদের কাছে খাবার ও জরুুরি সেবা পৌঁছে দেয়া সরকারের নৈতিক দায়িত্ব হলেও আইনগত বাধ্যবাধকতা নেইলকডাউন আরোপ করা হলে দরিদ্র নাগরিকদের কাছে খাবার ও জরুরি সেবা পৌঁছে দেয়া সরকারের নৈতিক দায়িত্ব হলেও আইনগত বাধ্যবাধকতা নেই

অন্যান্য দেশে লকডাউন কীভাবে পালন করা হচ্ছে?

করোনাভাইরাস প্রাদুর্ভাব ছড়িয়ে পড়ার পর সংক্রমণের হার নিয়ন্ত্রণের লক্ষ্যে বিভিন্ন জায়গায় জারি করা লকডাউন বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে নীতিমালা ছিল ভিন্ন।

প্রাদুর্ভাবের প্রথম কেন্দ্র চীনের উহান শহরকে জানুয়ারির শেষ সপ্তাহে লকডাউন করা হয়।

উহানে প্রবেশ এবং সেখান থেকে বের হওয়ার ওপর নিষেধাজ্ঞা দেয়া হয়, আর উহানসহ আরো কয়েকটি শহরে গণপরিবহনসহ সব ধরণের যাত্রী পরিবহণ বন্ধ করে দেয়া হয়। বিশেষ কিছু খাবারের দোকান এবং ওষুধের দোকান বাদে বন্ধ করে দেয়া হয় সব দোকানপাট।

এরপর হুবেই প্রদেশের বেশকিছু শহরে আরোপ করা হয় একই ধরণের নিষেধাজ্ঞা।

ইতালির উত্তরাঞ্চলে ভাইরাস সংক্রমণের কেন্দ্র লোমবার্ডি প্রদেশে মার্চের প্রথমদিকে জারি করা হয় লকডাউন। উহানের মত ওই অঞ্চলেও খাবার এবং ওষুধের দোকান বাদে অন্য সব দোকানপাট ও গণপরিবহণ বন্ধ করার সিদ্ধান্ত দেয়া হয়।

পরে পুরো ইতালিকেই কার্যত লকডাউনের আওতায় আনা হয়। নিয়ম না মেনে ঘর থেকে বের হলে শাস্তির ঘোষণা দেয়া হয়।

তবে দেশটির অন্যান্য এলাকাতেও খাবার এবং ওষুধের দোকান খোলা রাখা হয়।

যুক্তরাষ্ট্রের অধিকাংশ অঙ্গরাজ্যে – এমনকি বর্তমানে ভাইরাস প্রাদুর্ভাবের কেন্দ্র হিসেবে বিবেচিত নিউইয়র্ক রাজ্যেও – গণপরিবহণ বন্ধ করে মানুষজনকে ঘরে থাকতে নির্দেশ দেয়া হলেও আনুষ্ঠানিকভাবে লকডাউন ঘোষণা করা হয়নি।

যুক্তরাজ্য, স্পেন, ফ্রান্সসহ ইউরোপের কয়েকটি দেশে মানুষকে দৈনিক একবার ব্যায়ামের উদ্দেশ্যে ঘর থেকে বের হওয়ার অনুমতিও দেয়া হয়েছে।

তবে কিছু কিছু দেশে লকডাউনের নিয়মকানুন মানা হচ্ছে খুবই কঠোরভাবে।

যেমন দক্ষিণ আফ্রিকায় অতি জরুরি প্রয়োজন ছাড়া কাউকে ঘর থেকে বের হতে দেয়া হচ্ছে না – কঠোর অবস্থানে রয়েছে দেশটির আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী।