করোনা ডায়েরী-৫ম পর্ব :

অধ্যাপক আকতার চৌধুরী

৫ম পর্ব
“কক্সবাজারে করোনা রোগী” এ শিরোনামের প্রতি মানুষের আর আস্থা থাকছেনা বলে মনে হয়। পাঠকদের কাঠগড়ায় সাংবাদিক সমাজ। তারা সরাসরি দোষী ভাবছেন সাংবাদিকদের।

একজন সাবেক এমপি’র স্ট্যাটাসেও তা দেখলাম । লিখেছেন -“করোনা ভাইরাস নিয়ে ককসবাজেরে,যার তুন যেন মনে হয় -এন এন রিপোর্ট!!!” ।
একজন রিপ্লাইতে লিখেছেন – “ এখন তো কোনো কাজকর্ম নাই স্যার তাই সবাই রিপোর্টার!”

এরকম একটি ধারণা জন্ম নেয়া স্বাভাবিক । যেহেতু কক্সবাজারের ২ জন করোনা রোগীর রিপোর্ট নেগেটিভ। মানুষের প্রশ্ন করোনা ভাইরাস নেগেটিভ হলে ‘করোনা রোগী’ হয় কিভাবে! তবে ‘করোনা নেগেটিভ’ এটা আনন্দের সংবাদ বটে।

কক্সবাজারের ১ম করোনা রোগী ধরা পড়ে ২৪ মার্চ ২০২০ । কক্সবাজারের যথাযথ কর্তৃপক্ষ ঘোষণা করেন , একজন মহিলা করোনা রোগী পাওয়া গেছে । এটা নিয়ে স্থানীয় সাংবাদিক ছাড়াও জাতীয় সাংবাদপত্র বা মিডিয়াগুলো হুমড়ি খেয়ে পড়ে। প্রশাসনের যথারীতি বিভিন্ন অলিগলি বাসাবাড়ি লগ ডাউন ঘোষণা। উৎসুক জনতার ভীড় , আর সচেতন মানুষের আতংক। রোগীর অবস্থা সংকটাপন্ন হওয়ায় নেয়া হয় ঢাকায় । সেখানে পরীক্ষায় করোনা ভাইরাস নেগেটিভ পাওয়া যায় । যদিও এটা সু-সংবাদ ,পাঠকরা ধরে নেয় এতদিন যা সংবাদ হয়েছে তা মিথ্যা , সাংবাদিকদের বাড়াবাড়ি।
৪ এপ্রিল ২০২০ কক্সবাজারে ২য় করোনা পজেটিভ রোগীর সংবাদ পাওয়া যায় । সীমান্ত উপজেলা টেকনাফে। একজন র‌্যাব সদস্য । ঢাকা থেকে বেড়াতে এসে শ্বশুর বাড়িতে গত ২০-২৬ মার্চ পর্যন্ত অবস্থান করেন। ঢাকায় গিয়ে অসুস্থতা বোধ করলে করোনা সন্দেহে তাকে হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। যতটুকু জেনেছি , প্রথম টেষ্টে করোনা পজেটিভ এরকম একটি ফলাফল পেয়েছিল। এর ফলে প্রশাসন ও স্বাস্থ্য বিভাগ পূর্ব প্রস্তুতি হিসেবে র‌্যাব সদস্যের শ্বশুরবাড়ি , আত্মীয়স্বজনের বাড়ি, দোকানপাটসহ ১৫টি স্থাপনা লক ডাউন ঘোষণা করে লাল ফ্লাগ টাঙ্গিয়ে দেয়। যথারীতি উপজেলা প্রশাসনের ফেসবুক স্ট্যাটাসে গনমাধ্যমকে জানানোও হয়। কিন্তু পরবর্তী দিন আবার করোনা টেষ্টে জানা গেল র‌্যাব সদস্য করোনা নেগেটিভ । এটাও সু-সংবাদ।

কিন্তু করোনা পজেটিভ হল কী নেগেটিভ হল এর দায়ভারটা অনেকে তুলে দিচ্ছেন সাংবাদিক বা মিডিয়াগুলোর উপর। অথচ সংবাদের সমস্ত তথ্য উপাত্ত যথাযথ কর্তৃপক্ষের দেয়া।

এটা মনে রাখতে হবে, অন্তত এই সময়ে করোনা ভাইরাস সম্পর্কে তথ্য বিকৃতি করা সাংবাদিকদের পক্ষে কিছুতেই সম্ভব নয় । করলে সরকার কঠোর আইনগত ব্যবস্থা নিত। এখানে যা হয়েছে ,সাংবাদিকদের কাছে কর্তৃপক্ষের দেয়া করোনা ভাইরাস সংক্রান্ত তথ্য হয় সঠিক না হয় ভুল অথবা চিকিৎসায় ভাল হয়েছে।

হোম কোয়ারেন্টাইনের ৩য় দিনেই এক মানবিক কক্সবাজার জেগে উঠে। খেটে খাওয়া দিন মজুর নিম্নবিত্তের লোকজন খাদ্যের আশায় হোম কোয়ারেন্টাইন ভেঙ্গে বেরিয়ে আসে। এ নিয়ে বেশ কিছু মানবিক মানুষ ফেসবুকে বেশ লেখালেখিতে সরব হয় । তারা বুঝতে পারে ,নিম্নবিত্তের খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে না পারলে হোম কোয়ারেন্টাইন সফল হবে না । তারা দ্রুত ফেসবুকে একটি গ্রুপ খোলে । এই গ্রুপে সংযুক্ত হয় পুলিশ কর্মকর্তা, রাজনৈতিক ,সামাজিক , সাংবাদিক , ব্যবসায়িক ও পেশাজীবি ব্যক্তিবর্গ । ফলে এই গ্রুপ খুব দ্রুত “কক্সবাজার করোনা সহায়তা তহবিল” গঠনে সক্ষম হয়। যাদের নাম না বললে নয় , উদ্যোক্তা ও প্রধান উপদেষ্টা ইকবাল হোসেন অতিঃ পুলিশ সুপার, উপদেষ্টা সোহেল আহমেদ বাহাদুর ও জাহেদ সরওয়ার সোহেল, প্রধান সমন্বয়ক ইমরুল কায়েস, সমন্বয়ক তৌফিকুল ইসলাম লিপু, এইচ এম নজরুল এর অবদান উল্লেখ যোগ্য। করোনা সহায়তায় তাদের এ উদ্যোগ জেলায় প্রথম বলে চিহ্নিত হবে নি:সন্দেহে।

এই উদ্যোগে উদ্বুদ্ধ হয়ে রাজনৈতিক , সামাজিক ও ব্যক্তিগত উদ্যোগে অনেকে ত্রাণ সহায়তায় মাঠে নেমে পড়েন।প্রাথমিক পর্যায়ে জেলা প্রশাসন , পুলিশ প্রশাসন , সেনাবাহিনী ও সাংসদগণ যেভাবে মানুষকে সহায়তায় দিয়েছে তা প্রশংসার দাবী রাখে । এখন সরকারী ত্রাণ ও ১০টাকা চাল বিক্রি কার্যক্রম চালু হয়েছে শহরে।কিন্তু সমস্যা হচ্ছে ত্রান বা চাল নিতে গিয়ে ‘সামাজিক দুরত্ব’ মানা হচ্ছে না।

শকিং বিষয় গতকালের (৫ মার্চ ২০২০) করোনা ভাইরাস আপডেট । দেশে এক দিনে নতুন করোনা রোগী শনাক্ত হয়েছে ১৮ জন। গত ৮ মার্চ দেশে প্রথম করোনাভাইরাস শনাক্ত হওয়ার পর এক দিনে এ সংখ্যা সর্বোচ্চ। এ পর্যন্ত সংক্রমিত মানুষের সংখ্যা ৮৮। গত ২৪ ঘণ্টায় করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হয়ে একজনের মৃত্যুসহ  মৃত্যু বেড়ে ৯ । বলা যায় হোম কোয়ারেন্টাইন  না মানার খেসারত আমরা খুব খারাপভাবে দিতে যাচ্ছি।

কিন্তু আজ দু:সংবাদ দিয়ে শেষ করতে চাই । গত কয়েকদিন আগে আমরা জেনেছিলাম নির্জন সৈকতে খেলা করছে ডলফিন। এ সংবাদে অনেকে সংশয় প্রকাশ করে স্ট্যাটাসও দিয়েছিলেন। বিদেশী কোন সৈকতে ডলফিনের খেলা করার ভিডিও বলে মন্তব্যও করেছিলেন। কিন্তু সব সন্দেহ দূর করে সেই ডলফিনগুলো মৃত অবস্থায় তীরে ভিড়ছে। টেকনাফ ও ইনানী বীচে বেশ কয়েকটি মৃত ডলফিন লোকজন খোজে পেয়েছেন। এদের গায়ে আঘাত ও জালে পেছানোর চিহ্ন পাওয়া গেছে। তাই একজন ফেসবুকে মন্তব্য করল – “ডলফিনগুলো মরিয়া প্রমাণ করিল , সৈকতে ডলফিন এসেছিল”!