তিন মাসের কম সময় আগে, জানুয়ারির ১২ তারিখে করোনাভাইরাসের প্রাদুর্ভাব আটকে ছিল কেবল চীনে। যে দেশে এই ভাইরাস প্রথম ধরা পড়েছিল, সেদিন পর্যন্ত তার বাইরে একটি দেশেও এটি পাওয়া যায়নি।
কিন্তু ১৩ই জানুয়ারি করোনাভাইরাস হয়ে উঠলো একটি বিশ্ব সমস্যা। সেদিন প্রথম একটি করোনাভাইরাসের কেস ধরা পড়লো থাইল্যান্ডে। এরপর একে একে জাপান, দক্ষিণ কোরিয়া এবং যুক্তরাষ্ট্রে।
বিশ্বের বিভিন্ন দেশে একটি-দুটি করে সংক্রমণের ঘটনা ক্রমে শত শত এবং হাজার হাজার সংক্রমণে পরিণত হল।
এখন গোটা বিশ্বে করোনাভাইরাসে আক্রান্ত মানুষের সংখ্যা দশ লাখের বেশি। এর মধ্যে নেপাল থেকে নিকারাগুয়া কোন দেশ বাদ নেই।
মৃত্যুর সংখ্যা প্রতিদিন বাড়ছে, হাসপাতালগুলোতে রোগীর ভিড় উপচে পড়ছে।
বিশ্বে এমন কোন দেশ কি আছে যারা এখনো করোনাভাইরাসমুক্ত?
অবাক করার মতো হলেও এ প্রশ্নের উত্তর হচ্ছে- হ্যাঁ, এরকম কিছু দেশ এখনও আছে।
জাতিসংঘের সদস্য এমন দেশের সংখ্যা হচ্ছে ১৯৩টি।
এর মধ্যে গত দোশরা এপ্রিল পর্যন্ত ১৮টি দেশ কোন করোনাভাইরাস সংক্রমণের খবর জানায়নি।
জন হপকিন্স বিশ্ববিদ্যালয়ের সংগৃহীত তথ্য ব্যবহার করে এটি জানা যাচ্ছে।
তবে বিশেষজ্ঞদের ধারণা এর মধ্যে কোন কোন দেশে হয়তো করোনাভাইরাসের সংক্রমণ ঘটেছে কিন্তু তা ধরা পড়েনি বা প্রকাশ করা হচ্ছে না।
যেমন ধরা যাক উত্তর কোরিয়া। সেখানে সরকারিভাবে দাবি করা হচ্ছে সংক্রমণের ঘটনা শূন্য। যুদ্ধকবলিত দেশ ইয়েমেনও তাই।
কিন্তু একই সঙ্গে এটাও সত্যি কোন কোন দেশে এই ভাইরাস হয়তো পৌঁছেনি। এগুলো একেবারেই ক্ষুদ্র কিছু দ্বীপ রাষ্ট্র।
এর মধ্য সাতটি দেশ আছে বিশ্বে সবচেয়ে কম বেড়াতে যাওয়া দশটি দেশের তালিকায় ।
সোশ্যাল ডিসট্যান্সিং বা সামাজিক দূরত্বের নতুন নিয়মে যখন আটকে পড়েছে বিশ্ব, এসব দেশ তারও বহু আগে থেকেই আসলে এক ধরণের সেল্ফ আইসোলেশন বা বিচ্ছিন্ন হয়ে আছে।
কিন্তু তাই বলে এসব দেশ নিশ্চিন্ত হয়ে বসে নেই। যেমন নাউরুর প্রেসিডেন্ট বিবিসিকে জানিয়েছেন, কোভিড-নাইনটিনকে তারা জাতীয় জরুরী সংকট বলে ঘোষণা করেছেন।
নাউরু একটি প্রশান্ত মহাসাগরীয় দ্বীপ রাষ্ট্র। আশে-পাশের যে কোনা দেশ থেকে এটির দূরত্ব প্রায় দুশো মাইল।
সবচেয়ে নিকট প্রতিবেশি হচ্ছে আরেক দ্বীপ রাষ্ট্র কিরিবাটি। সরাসরি ফ্লাইট চলে এরকম সবচেয়ে কাছের বড় শহর অস্ট্রেলিয়ার ব্রিসবেন। দূরত্ব প্রায় আড়াই হাজার মাইল।
ভূমির আয়তন বিবেচনায় এটি জাতিসংঘের দ্বিতীয় ক্ষুদ্রতম রাষ্ট্র (মোনাকো হচ্ছে সবচেয়ে ছোটো)।
নাউরুর জনসংখ্যা দশ হাজারের কিছু বেশি। বিশ্বে যেসব দেশে খুব কম মানুষ বেড়াতে যায়, এটি তার একটি।
একজন ট্যুর অপারেটরের দেয়া হিসেব অনুযায়ী বছরে মাত্র ১৬০ জন পর্যটক দেশটি সফর করে।
আপনার মতে হতে পারে এরকম একটি বিচ্ছিন্ন এবং দূর্গম দেশের তো আর বিচ্ছিন্ন হওয়ার জন্য বেশি কিছু করার দরকার নেই।
কিন্তু যে দেশে একটি মাত্র হাসপাতাল, নেই একটিও ভেন্টিলেটর এবং ডাক্তার-নার্সের ব্যাপক সংকট- তারা কোন ঝুঁকি নিতেই রাজী নয়।
নাউরু যেসব পদক্ষেপ এরই মধ্যে নিয়েছে:
দোশরা মার্চ চীন, দক্ষিণ কোরিয়া এবং ইতালির সব পর্যটককে নিষিদ্ধ করেছে নাউরু সরকার। পাঁচদিন পর ইরানকেও এই তালিকায় যুক্ত করা হয়েছে।
মার্চের মাঝামাঝি নাউরু এয়ারলাইন্স ফিজি, কিরিবাটি এবং মার্শাল আইল্যান্ডসের সঙ্গে সব ফ্লাইট বাতিল করেছে। ব্রিসবেনের সঙ্গে ফ্লাইট সপ্তাহে তিনটি হতে প্রতি দু’সপ্তাহ একটিতে নামিয়ে আনা হয়েছে।
অস্ট্রেলিয়া থেকে আসা সবাইকে (বেশিরভাগই নাউরুর নাগরিক) বাধ্যতামূলকভাবে ১৪ দিন কোয়ারেনটিনে থাকতে নির্দেশ দেয়া হয়েছে।
রাজনৈতিক আশ্রয়প্রার্থীদের বেলায় একই নিয়ম চালু করা হয়েছে। এই দ্বীপে অস্ট্রেলিয়ার একটি ‘মাইগ্রেন্ট প্রসেসিং সেন্টার আছে।
নাউরুর প্রেসিডেন্ট লায়নেল আইনগিমিয়া বলছেন, তারা ‘ক্যাপচার এন্ড কনটেইনমেন্ট’ এর নীতি নিয়েছেন।
যাদের কোয়ারেনটিনে রাখা হয়েছে, প্রতিদিন তাদের পরীক্ষা করা হয়। কারো জ্বর হলে তাকে আরও আলাদা করে ফেলা হয়। এবং কোভিড-নাইনটিনের টেস্ট করা হয়।
নমুনা অস্ট্রেলিয়ায় পাঠিয়ে পরীক্ষা করা হয়। সব পরীক্ষার ফল এখনো পর্যন্ত নেগেটিভ।
তবে এরকম একটি সংকটের মধ্যেও নাউরুর সাধারণ মানুষ শান্তভাবেই পরিস্থিতির মোকাবেলা করছে, বলছেন প্রেসিডেন্ট।
উত্তর কোরিয়া দাবি করছে তারা করোনাভাইরাসমুক্ত, আর এই বিশ্ব সংকটের মধ্যেই তারা ক্ষেপনাস্ত্র পরীক্ষা চালিয়ে যাচ্ছে।
কেবল নাউরু নয়, কিরিবাটি, টোঙ্গা, ভানুয়াতুর মতো দেশগুলোও একই নীতি নিয়েছে। তারাও জাতীয় জরুরী অবস্থা ঘোষণা করেছে।
দক্ষিণ প্রশান্ত মহাসাগরের ডঃ কলিন টুকুইটোঙ্গা মনে করেন এটাই সঠিক নীতি।
তিনি বলেন, “এই ভাইরাসকে দেশে ঢুকতে না দেয়াটাই তাদের জন্য সবচেয়ে ভালো নীতি, কারণ একবার ঢুকে পড়লে আর রক্ষা নেই।”
ডঃ কলিন টুকুইটোঙ্গা একজন জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ। তিনি বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার একজন সাবেক কমিশনার। এখন অকল্যান্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের মেডিক্যাল স্কুলের ডীন।
“এসব দেশে কোন ভালো স্বাস্থ্য ব্যবস্থা নেই। এগুলো খুবই ছোট এবং নাজুক দেশ। অনেক দেশে কোন ভেন্টিলেটর পর্যন্ত নেই। একবার যদি এসব দেশে করোনাভাইরাস ছড়িয়ে পড়ে, পুরো জনগোষ্ঠিকে শেষ করে দেবে।”
তিনি বলেন, এসব দেশের মানুষের মধ্যে ডায়াবেটিস এবং হৃদরোগের মতো সমস্যাও বেশি।
যদি এসব দেশে করোনাভাইরাসের সংক্রমণ হয়, তখন তাদের অনেক রোগীকে চিকিৎসার জন্য বিদেশে পাঠাতে হবে। কিন্তু সেই কাজটা মোটেই সহজ নয়, বিশেষ করে যখন সব দেশ তাদের সীমান্ত বন্ধ করে দিচ্ছে।
ডঃ কলিন টুকুইটোঙ্গার মতে, এসব দেশের বাঁচার একমাত্র উপায় যতদিন সম্ভব সংক্রমণ একেবারে শূন্যতে রাখা।
তবে ভূমিবেষ্টিত কয়েকটি ক্ষুদ্র রাষ্ট্রও এখনো পর্যন্ত নিজেদের করোনামুক্ত রাখতে পেরেছে।
ভূমিবেষ্টিত দেশ মালাউই গত বৃহস্পতিবার পর্যন্ত করোনামুক্ত ছিল। পূর্ব আফ্রিকার ওই দেশটির জনসংখ্যা প্রায় এক কোটি ৮০ লাখ।
বৃহস্পতিবার সেখানে প্রথম করোনাভাইরাস ধরা পড়েছে। তবে এজন্যে দেশটির প্রস্তুতি ছিল।
দেশটি জাতীয় দুর্যোগ ঘোষণা করেছে, স্কুল বন্ধ করে দিয়েছে এবং বিদেশিদের দেয়া সব ভিসা বাতিল করেছে।
গরীব দেশ নাউরু একবার করোনাভাইরাসের সংক্রমন শুরু হলে আর সামলাতে পারবে না বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে।
লিভারপুল স্কুল অব ট্রপিক্যাল মেডিসিনের ডঃ পিটার ম্যাকফারসন মালাউইতে থাকেন। তিনি বলেন, যে প্রস্তুতি মালাউই নিয়েছে তাতে তারা পরিস্থিতির মোকাবেলা করতে পারবে বলে তিনি আশা করেন।
“করোনাভাইরাস বিশ্বের সবদেশেই ঢুকবে। তবে সবচেয়ে শেষে যেসব দেশে এই সংক্রমণ ঘটবে, সেগুলো হচ্ছে প্রশান্তমহাসাগরীয় ক্ষুদ্র দ্বীপরাষ্ট্রগুলি। এ ব্যাপারে আমি বাজি ধরতে পারি”, বলছেন সাউদাম্পটন বিশ্ববিদ্যালয়ের অ্যান্ডি ট্যাটেম।
“তবে আমি নিশ্চিত নই অর্থনীতির বিশ্বায়নের যুগে এমন কোন জায়গা আসলে আছে কীনা যেখানে গিয়ে এই ভাইরাস থেকে রক্ষা পাওয়া যাবে।“
তিনি বলেন, নাউরুর মতো জায়গায় লকডাউন হয়তো কিছুদিনের জন্য কাজ করবে, কিন্তু এই লকডাউন তো চিরদিন ধরে জারি রাখা যাবে না।
“এসব দেশকে বাইরের আমদানির ওপর নির্ভর করতে হয়। সেটা খাবার থেকে শুরু করে নানা জিনিস। আবার তাদের রফতানিও করতে হয়। একসময় তাদের এই লকডাউন তুলতেই হবে।”
আমরা সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।