রফিকুল কবির 

শিশু কিশোরের কোলাহলহীন এ পৃথিবী বিদঘুটে লাগছে। ভোরের পাখির মতো কিচিরমিচির শব্দে মুখরিত যে শিশু পার্ক, যে খেলার মাঠ, স্কুলগুলো আজ নিথর পরে আছে! গ্রামে গঞ্জে, শহরে বন্দরে, অলিতে গলিতে তেমন কেউ নেই। হাসপাতাল,ফার্মেসি ও অতি প্রয়োজনীয় কিছু দোকানপাট ছাড়া বাকি সব বন্ধ। মসজিদ, মন্দির, গির্জা, শিল্প চারুকলা, আনন্দ উৎসব, মেলা সব বন্ধ! পৃথিবীর এতো বীভৎস রূপ আগে দেখিনি!

চীনের উহান থেকে নোভেল করোনা ভাইরাস বাংলাদেশ সহ পৃথিবীর ২০০টি দেশে ছড়িয়ে পড়েছে। ইতোমধ্যে সারা পৃথিবীতে সাড়ে ৬ লাখের বেশি মানুষ এ ভাইরাসে সংক্রমিত হয়েছে, মারা গেছে ৩০ হাজারের বেশি। হু হু করে বেড়ে যাচ্ছে মৃতের সংখ্যা! এই লিখা যখন আপনি পড়ছেন ততক্ষনে এ সংখ্যা কততে গিয়ে পৌঁছেছে জানিনা। মৃত্যুর মিছিল সব দেশে, ভয়ে সবাই কম্পমান। মৃত্যুর ভয় খুব ভয়াবহ। এ রুগের তেমন কোনো ঔষুধ এখনো আবিষ্কৃত হয়নি। তাই সংক্রমণ প্রতিরোধে ঘরে থাকুন, হাঁচি-কাশির নিয়ম মেনে চলুন, সামাজিক দূরুত্ব বজায় রাখুন। নিজে বাঁচুন-অন্যকে বাঁচান।

এর আগেও অনেক বার নানা ঘাতক ভাইরাস পৃথিবীকে উলটপালট করে দিয়ে গেছে। গত শতকে ১৯৫৭-১৯৫৮ এর দিকে এশিয়াতে একটি মহামারীতে প্রায় ১০ থেকে ১৫ লক্ষ মানুষ মারা যায়। এই মহামারীর নাম ছিল “এশীয় ফ্লু”। আজ থেকে ১০০ বছর আগে ১৯১৮-১৯১৯ সালে ইনফ্লুয়েঞ্জাতে বিশ্বব্যাপি প্রায় ৫ কোটি মানুষ মারা যায়। ভয়াবহ এই মহামারী “স্পেনীয় ফ্লু” নামে পরিচিত। এ মহামারিগুলোতে মৃত্যু হয়েছে অসংখ্য মানুষের কিন্তু অবশেষে এই ফ্লু’গুলোর সাথে যুদ্ধে মানুষের জয় হয়েছে যদিও ততক্ষনে ভয়াবহ এক বিনাশ ঘটে গেছে। আমরা আজকে আধুনিক প্রযুক্তির এক বিশ্বয়কর যুগে এসে পৌঁছেছি, তাই আমি আশা করি কোবিড-১৯ সাথে যুদ্ধেও আমরা জিতে যাবো ভয়াবহ বিনাশের আগে। কিন্তু তার জন্য চাই দক্ষ রণ কৌশল যেটা চীন, সিঙ্গাপুর, কিউবা করে দেখাচ্ছে। আমাদের মাতৃভূমি বাংলাদেশ পৃথিবীর অন্যতম ঘনবসতিপূর্ণ একটি দেশ। তাই আমরা বেশি ঝুঁকিতে। রোহিংগাদের উপচে পড়া ভিড় ঝুঁকিকে দ্বিগুন করেছে। আরো বেশি ঝুঁকিতে এ কারণে যে আমাদের রাজনৈতিক শিষ্টাচার অতীব নোংরা, এখানে মানুষের প্রাণ নিয়ে খেলা করার অভ্যেস পুরোনো, খুব অল্প দামে মানুষের জীবন কেনা বেচা যায়! এটি সহ্য করা যায়না।

করোনা ভাইরাসের সাথে যুদ্ধের রণ কৌশল সাঁজানোর জন্য আমরা ৩ মাস সময় পেয়েছিলাম, আমাদের সরকার কী প্রস্তুতি নিয়েছে সে লজ্জার কথা কারো অজানা নয়। সত্যিই আমরা ক্রমে সুযোগ হারাচ্ছি -বাঁচার! মিথ্যা ধ্বংস করে, সত্য বাঁচায়; তাই প্রকৃত তথ্য মানুষকে সঠিক সময়ে পৌঁছে দেয়া উচিত। এতে জনগণ অধিকতর সাবধান হবে। অথচ আমরা বলছি না যে আমাদের যথেষ্ট পিপিই (হ্যান্ড স্যানিটাইজার, মাস্ক, গ্লাভস, সুরক্ষা পোশাক ইত্যাদি) নেই, আমাদের যেকটি থার্মাল স্ক্যানার এই ভালো তো এই নষ্ট, যথেষ্ট কিট নেই, এরই মধ্যে কয়েক লক্ষ লোক বিদেশ থেকে দেশে ঢুকে পড়েছে তেমন কোনো পরীক্ষা নিরীক্ষা ছাড়া! আমরা এসব কিছুই বলছি না! বরং অনেকে রাষ্ট্রের উচ্চ পদে বসে মদপ্যের মতো বেফাঁস কথা বলেই যাচ্ছে। কারো কারো কথা শুনলে মনে হয় এমন পদলেহক দুনিয়াই জুরা ভার। আমার বিশ্বাস মাননীয় প্রধানমন্ত্রী নিশ্চয় উনাদের পদলেহনের জন্য ঐ গুরুত্বপূর্ণ চেয়ার গুলোতে বসান নি। সুতরাং এসব ছেড়ে নিজের দায়িত্ব পালন করুন। বলছে বিভাগীয় শহরের মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে বায়োসেফটি ক্যাবিনেটসহ ল্যাব–সুবিধা আছে। যাদের এই সুবিধা আছে তারাই নমুনা পরীক্ষা করতে পারবে। তাহলে জেলা, উপজেলা বা দূরের কোনো গ্রামের কেউ আক্রান্ত হলে কী প্রতিকার ? আক্রান্ত কেউ ফোন করে যদি বলে তার কোরোনার লক্ষনগুলো প্রবল ভাবে দেখা দিয়েছে তাহলে কতৃপক্ষ কি উনাকে আনতে অ্যাম্বুলেন্স পাঠাবেন? কেউ কি অরক্ষিতভাবে নমুনা সংগ্রহ করতে যাবেন? নাকি রুগী নিজ দায়িত্বে পাবলিক ট্রান্সপোর্টে করে ভাইরাস ছড়াতে ছড়াতে বিভাগীয় শহরের মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে আসবেন পরীক্ষা করতে? কোনো রোগীর কোভিড-১৯–এর লক্ষণ থাকলেও সুরক্ষা পোশাক ছাড়া এসব রুগীদের প্রাথমিক চিকিৎসা দিতে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের পরিচালক (হাসপাতাল) আমিনুল হাসান নির্দেশ দিয়েছেন। আমার বোধগম্য হয়না কিভাবে এ নির্দেশ দেন !
অদ্ভুত আমাদের প্রস্তুতি! প্যারিসে আমরাও লকডাউনে আছি, সরকার আমাদের খাওয়ানোর দায়িত্ব নিয়েছে। আমারা ঘরে বসে আছি। বৃদ্ধদের খাবার ঘরে পৌঁছে দিচ্ছে ! সংক্রমণ ঠেকাতে লকডাউন উত্তম উপায়। এখন আমাদের দেশেও লকডাউন হচ্ছে। কেউ ভাবছি না দিনমুজুরের কি হবে? যে রিকশা চালায় খায় তার? আরো অনেকে যে দিনে এনে দিনে খায় তাদের কি হবে? সরকার খাওয়াবে? একজন রিকশাওয়ালাকে, একজন দিনমুজুরকে, একজন খেটে খাওয়া মানুষকে Stay Home বলার সাথে সাথে যেন তাঁর খাদ্যের নিরাপত্তাও নিশ্চিত করি। উন্নয়নের গল্পে গলা শুকালেও সত্য জানি আমাদের সেই সামর্থ্য নেই। আজ পর্যন্ত এদের নিয়ে কারো কোনো নির্দেশনাও নেই! সকাল সন্ধ্যা শুধু একই রূপকথার গল্প আর কত ভালো লাগে! প্রধানমন্ত্রী বলেছেন- ‘এই মুহূর্তে আমাদের সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার দেশের মানুষকে এই প্রাণঘাতী সংক্রমণ থেকে রক্ষা করা।’ এ কথা কাজে প্রমাণ করতেই হবে। ঐক্যবদ্ধভাবেই কেবল এটি সম্ভব।

সময় গেলে সাধন হবে না।আমাদের সময় চলে যাচ্ছে। তাই সংক্রমণ সারা দেশে ব্যাপকভাবে ছড়িয়ে পড়ার আগে কঠোর পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে। আমাদের যা করতে হবে –

১/ হতদরিদ্রদের সাহায্যের জন্য তহবিল গঠন। সমাজের বিত্তশালীরা এ তহবিল গঠনে সহযোগিতা করতে পারে। উন্নত রাষ্ট্রে সবাই নিজ দেশের মানুষের জন্য তহবিল গঠন করেছে।
২/ জেলা হাসপাতালকে সেন্টার করে প্রত্যেক জেলার কিছু হোটেল বা সাইক্লোন সেন্টারকে হাসপাতালে রূপান্তর করে আইসোলেশন সমস্যা সমাধান করা যায়।
৩/ অতি দ্রুত পিপিই ব্যবস্থা করা, তা নাহলে চিকিৎসা দেয়ার জন্য কোনো ডাক্তার, নার্স, ভলেন্টিয়ার পাওয়া যাবে না।
৪/ খাদ্য দ্রব্যের মূল্য স্থিতিশীল রাখতে হবে, লখ্য রাখতে হবে যেন কোনো অসৎ ব্যবসায়ী প্রয়োজনীয় খাদ্য দ্রব্যাদির মূল্য বৃদ্ধি না করে। প্রত্যেক থানার ইউ.ন.ও এ দায়িত্ব নিতে পারে।
৫/ সচেতনতা তৈরির জন্য কাল বিলম্ব না করে who নির্দেশিত নিয়ম কানুনগুলো প্রত্যেক মসজিদের ইমামকে দিয়ে মাইকে প্রচার করতে হবে। এটি খুবই কার্যকর হবে কারণ আমাদের দেশের মানুষ প্রবল ধর্মীয় অনুভূতি সমম্পন্ন। মিডিয়া ব্যক্তিত্ব, খেলোয়াড়, সোশ্যাল এক্টিভিস্টরা সচেতনতা তৈরিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারে।
৬/আইনের কঠোর প্রয়োগ, আইন অমান্যকারীদের শাস্তির বিধান রাখতে হবে। একটু দেরিতে হলেও ভালো যে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী মাঠে নেমেছে তবে যেন কেউ অন্যায় হয়রানির শিকার না হয়।
৭/ রোহিঙ্গা কবলিত আমাদের প্রিয় কক্সবাজারকে বিশেষ সতর্ক ব্যবস্থায় রাখতে হবে, তা নাহলে কক্সবাজার করোনা সংক্রমণের কেন্দ্রস্থলে পরিণত হবে।
৮/ ভাইরাস ও সংক্রমণ বিষয়ে অভিজ্ঞ গবেষকদের পরামর্শ গুরুত্বের সাথে নিতে হবে।

এটি যুদ্ধ, এটি জীবন মরণের সমস্যা। সুতরাং কথাই কথাই সরকারকে এক হাত দিলে হবে না। দল, মত নির্বিশেষে সবাইকে দুহাত দিয়ে সরকারকে সহযোগিতা করতে হবে। আমরা সরকারের সমালোচনা করবো, সরকারের পাশেও থাকবো। এটাই সুনাগরিকের কাজ। দেশের অনেক মহৎ প্রাণ এগিয়ে এসেছে, নানান ভাবে সহযোগিতার হাত বাড়াচ্ছে। আরো অনেকে আসবে- অনেককেই আসতে হবে। আমাদের সময় অল্প, খুব ছোট্ট অবহেলা বড়ো ক্ষতির কারণ হয়ে দাঁড়াবে। তাই দ্রুত কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে। আল্লাহ আমাদের শক্তি দিন যেন এ মহামারীকে পরাস্ত করতে পারি, আমিন।

রফিকুল কবির। প্যারিস, ফ্রান্স।