শাহেদ মিজান, সিবিএন:

করোনা ভাইরাসের বিস্তার রোধে গত দুই দিন ধরে সারাদেশে সব কিছু বন্ধ রয়েছে। গত তিন দিন ধরে নিম্ন আয়ের মানুষ সকল উপার্জন বন্ধ। কিন্তু তারও আগেই বন্ধ হয়ে শ্রমজীবি মানুষের কাজ। কাজ বন্ধ হয়ে পড়ায় দিনে এনে দিনে খাওয়া এসব শ্রমজীবি মানুষের চরম অর্থভাবে পড়ে গেছে। ইতিমধ্যে অর্থভাবে তাদের ঘরে ডাল-ভাতের সংকট সৃষ্টি হয়েছে। দেশজুড়ে ‘লকডাউন’ অব্যাহত থাকায় সব দৈনিক ভিত্তিতে করা শ্রমজীবি মানুষগুলোই বেশি বিপাকে পড়ে গেছে।

অনেক শ্রমজীবি মানুষ জানান, প্রায় দৈনিক মজুরীর ভিত্তিতে কাজ পাওয়া গেলেও গত কয়েক দিন ধরে কাজতো দূরের কথা ঘর থেকেই হওয়া যাচ্ছে না। ফলে নির্মাণ কাজ, পরিবহন, লোড-আনলোড, গ্রামাঞ্চলের ক্ষেত-খামারে সহ দেশের একটি বিপুল সংখ্যার মানুষ দৈনিক মজুরিতে কাজে নিয়োজিত রয়েছে। করোনার কারণে এসব কাজ প্রায় বন্ধ। বিশেষ করে নির্মাণ কাজ, গণপরিবহন, মালামাল পরিবহন, বাসাবাড়ির মেরামত, লোড-আনলোড কাজ শতভাগ বন্ধ রয়েছে। এই পরিস্থিতিতে অর্থের সংকটে পড়ে গেছেন এসব কাজে নিয়োজিত শ্রমিকেরা। কারণ যারা দৈনিক ভিত্তিতে কাজ করেন তাদের দিনের আয় দিনেই শেষ হয়ে যায়।

কক্সবাজার শহরের নিয়মিত কয়েকজন শ্রমিক জানান, তারা বাসাবাড়ির মেরামত, পরিস্কার-পরিচ্ছন্নতা, মাটি কাটা, মাটি ভরাটসহ যেকোনো কাজ করি। দৈনিক সর্বনিম্ন ৫০০ থেকে ৬০০ টাকা দিয়ে কাজ করি। আবার অনেক সময় আরো কম টাকায় করতে হয়। কিন্তু পাঁচ-ছয়জনের একটি সংসারে খরচ করে এসব টাকার মধ্যে আর জমা রাখা যায় না। করোনার কারণে কাজ বন্ধ রয়েছে। তার আগে কেনা চাল-ডাল এখন শেষ হয়ে গেছে। এতে পরিবারের সদস্যদের খাবারে সংকট তৈরি হয়েছে।
কক্সবাজার শহরের ঘোনার নিয়মিত শ্রমিক আবুল কাশেম বলেন, আমাদের মতো দৈনিক শ্রমজীবি মানুষের টাকা জমা থাকে না। দৈনিক ৫০০-৬০০ টাকা কাজ করতে পারলেও কিন্তু প্রতিদিন কাজ পাওয়া যায়না। তাই একমাসে যে টাকা আয় হয় তা সংসার খরচে সাথে সাথে শেষ হয়ে যায়। ফলে টাকা জমা থাকে না। করোনা প্রভাব শুরু হওয়ায় গত এক সপ্তাহ ধরে কাজ করতে পারিনি। হাতে টাকাতো নেই, ঘরের বাজারও শেষ হয়ে এসেছে। এখন চোখে অন্ধকার দেখছি।

টমটম চালক মোঃ রিদুয়ান বলেন, করোনার প্রভাব শুরু হওয়ার পর থেকে কক্সবাজার শহরে যাত্রী সংখ্যা কমে গেছে। অন্তত ১৫ দিন ধরে এই অবস্থা চলার তিন ধরে গাড়ি চলাচল পুরো বন্ধ রয়েছে। যাত্রী না থাকায় এই সময়ে ভাড়ায় চালিত টমটমের ভাড়ার টাকাও উঠেনি। এতে বকেয়া পড়েছে ভাড়ার টাকাও। নিজের শ্রমের টাকা না পাওয়ায় গত ১৫ দিন ধরে চরম অর্থ সংকটে রয়েছি। এই সময় ঠিক মতো বাজার করতে পারিনি। ছেলেমেয়ের প্রয়োজনীয় কোনো জিনিষ কেনা যায়নি।

রিকসা চালক করিম উল্লাহ বলেন, সব দুর্যোগকালীন সময়ে আমরা শ্রমজীবিরাই মরি। সরকারি কর্মকর্তারাব বা বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে মাসিক ভিত্তিতে যারা কাজ করে তাদের এই দুর্ভোগে পড়তে হয় না। কাজ না চলেও তারা মাস শেষ হওয়ার আগেই বেতন পায়। দেশে যত দূর্যোগ আসুক উনাদের কোনো সমস্যা নেই। যত সমস্যা সব আমাদের মত গরীব মানুষের।

কলাতলীর এক হোটেলের বয় মিজানুর রহমান বলেন, আমি শহরের একটি হোটেলে চাকরি করতাম। তবে কয়েক দিন আগে লোকজন আসা বন্ধ করে দেওয়ায় আমাদের হোটেলও বন্ধ হয়ে গেছে। তাই আমাদের ছুটি দিয়ে দিয়েছে। পুরো মাসের বেতনও দেয়নি। তাই এখন ঘরে বসে আছি। আমরা গরীব মানুষ কিছু না করলে খাব কিভাবে। এখন দেখছি ছোটখাট কাজও মিলছেনা। জানিনা এখন কি করবো।

শ্রমজীবি মানুষের অর্থ সঙ্কট বিষয়ে কক্সবাজার জেলা শ্রমিকলীগে সাধারণ সম্পাদক শফিউল্লাহ আনসারী বলেন, করোনা পরিস্থিতির কারণে এখন সব কিছু লকডাউন। দেশ মন্দা অবস্থার দিকে চলে যাচ্ছে। এতে অর্থনীতিও স্থবির হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। যা করোনার চেয়েও ভয়াবহ। সাধারণ মানুষ তেমন ঘর থেকে বের হচ্ছে না। আবার যাদের বাসাবাড়িতে কাজ ছিল তারাও কাজ বন্ধ করে দিয়েছে এবং বিভিন্ন উন্নয়ন কাজও বন্ধ। তাই শ্রমজীবি মানুষ সমস্যায় আছে এটা সত্য। আমার মতে জেলার অতি দরিদ্র মানুষের একটি তালিকা করে সরকারের পক্ষ থেকে তাদের প্রয়োজন মতো সহায়তা করা জরুরী।

করোনার প্রভাবে শুধু শ্রমজীবি মানুষ নয়; ভ্রাম্যমাণ ক্ষুদ্র ব্যবসায়িরাসহ অর্থ সঙ্কটে পড়েছেন। অনেকে বলছেন, দিন আনে দিনে খাওয়া মান্ষুগুলো অসহায় হয়ে পড়ছে। তারা ভিক্ষা করতেও বের হতে পারছে না। করোনায় আক্রান্ত নাহলেও খাদ্য অভাবে এই মান্ষু গুলো অসহায় হয়ে পড়েছে।

এদিকে খেটে খাওয়া অসহায় মানুষের জন্য সরকারিভাবে চালসহ নিত্যপ্রয়োজনীয় সরঞ্জাম বরাদ্দ দেয়ার ঘোষণা দেয়া হয়েছে। তবে এই বরাদ্দ বিতরণ এখনো শুরু হয়নি। শুরু হলেও সবাইকে এই বরাদ্দ দেয়া সম্ভব হবে না বলে অনেকে মনে করছেন।
জানা গেছে, করোনার প্রভাবে গৃহবন্দি কক্সবাজারের দিনমজুর মানুষগুলোকে সহায়তা দেয়ার জন্য কক্সবাজারের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার ইকবাল হোসেনের নেতৃত্বে কক্সবাজারের নাগরিক সমাজ উদ্যোগ নিয়েছে বলে জানা গেছে। নাগরিক সমাজ গরীব অসহায় মানুষকে নিত্যপণ্য সহায়তা করবেন বলেন জানিয়েছেন, অতিরিক্ত পুলিশ সুপার ইকবাল হোসেন।
তিনি বলেন, ‘এই সংকটকালীন মুহূর্তে সমাজের প্রতিটি বিত্তবান মানুষকে গরীব-অসহায় মানুষদের সাহাযোগ্য এগিয়ে আসা উচিত। সবাই যদি এগিয়ে আসেন তাহলে আমরা করোনা মোকাবেলায় সামগ্রিক জয়ী হবো।’

জেলা প্রশাসক মোঃ কামাল হোসেন বলেন, ‘কক্সবাজার জেলার হতদরিদ্র, অসহায়, একেবারে নিতান্তই গরীব মানুষের আপদকালীন সহায়তার জন্য ৫শ’ মেট্টিক টন চাল ও ১৩ লক্ষ টাকা বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে। চাল ও টাকা ইতিমধ্যে কক্সবাজার এসে পৌঁছেছে। করোনা ভাইরাস প্রতিরোধে যে কোন সংকটকালীন মুহুর্তে এগুলো বন্ঠন ও সরবরাহ করা হবে।’