রহিম আব্দুর রহিম

 

চারণ সাংবাদিক মোনাজাত উদ্দীনের লেখা, ‘পথ থেকে পথে’ বইয়ে পড়েছিলাম তার সাংবাদিকতা জীবনের বেশ কিছু অভিজ্ঞতার কথা। ওই বইতে তিনি উল্লেখ্য করেছিলেন, তাঁর এক সহযোদ্ধা ঢাকা যাচ্ছিলেন, তিনি ওই সাংবাদিকের কাছে একটি রিপোর্ট খামে ভরে দিয়ে বলেছিলেন, ‘এই প্যাকেটটি পুরনো পল্টন সংবাদ অফিসে পৌঁছে দিতে। দুর্ভাগ্য এই সাংবাদিক এই প্যাকেটটি সংবাদ অফিসে পৌঁছে দেননি, এমনকি তা মোনাজাত উদ্দীনকে ফেরতও দেননি। চারণ সাংবাদিক মোনাজাত উদ্দীন ঢাকা যাওয়ার পথে লঞ্চ দুর্ঘটনায় যমুনা নদীতে পড়ে মারা গেছেন। লেখার প্রারম্বে এই উদাহরণটি কেনো দাঁড় করলাম, তা পরে খোলসা করব। যে বিষয়টি নিয়ে লেখা সেই আলোচনায় যাচ্ছি। সম্প্রতি কুড়িগ্রামের প্রত্যাহার হওয়া জেলা প্রশাসক সুলতানা পারভীন ঢাকা ট্রিবিউনের কুড়িগ্রাম প্রতিনিধি, সাংবাদিক আরিফুল ইসলাম আরিফকে মধ্যরাতে বাড়ি থেকে তুলে নিয়ে তার অধঃস্তন কর্মকর্তাকে দিয়ে নির্মম নির্যাতন করেছেন। মাদক মামলায় ফাঁসিয়ে ওই সাংবাদিককে ভ্রাম্যমান আদালতের মাধ্যমে জেল হাজতে প্রেরণ করেছেন, আবার তিনি তাঁকে জামীনও করছেন। সাংবাদিক আরিফুলের কি দোষ? কেনো তাকে নির্যাতন, আবার মিথ্যা মামলায় জেল হাজতে প্রেরণ? বাসা থেকে তুলে নিয়ে যাওয়ার সময় সাংবাদিককে ক্রস ফায়ারে মেরে ফেলার হুমকিই বা কেন? এধরণের প্রশ্নের জবাব খুঁজতে বেরিয়ে আসে সাংবাদিক আরিফুল ইসলামের সাহসিকতার কথা, অন্যদিকে প্রকাশ পায় জেলা প্রশাসক সুলতানা পারভীনের অনিয়মের ফিরিস্তি। সাংবাদিক পেটানোর ঘটনার ১০ মাস আগে সাংবাদিক আরিফ ডিসি’র অনিয়মের বিরুদ্ধে একটি রিপোর্ট করেছিলেন। কুড়িগ্রামের অনেক সাংবাদিক যখন ডিসির গুণ-কীর্তনে ব্যস্ত, তখন সাংবাদিক আরিফুলের ডিসির বিরুদ্ধে সংবাদ! বিষয়টি মনে রেখেছিলেন সুলতানা পারভীন। সংবাদ প্রকাশের ১০ মাস পর , যে সাংবাদিকের নুন্যতম পান সিগারেটের নেশা নেই, সেই সাংবাদিক বেমালুম হয়ে গেলেন মাদক ব্যবসায়ী। রাতের অন্ধকারে ৪০ জনের সদস্য নিয়ে গঠিত ডিসির ট্রাক্সফোর্স ওই সাংবাদিকের বাড়িতে। মধ্যযুগীয় কায়দায় ম্যাজিস্ট্রেট নাজিমউদ্দীন সাংবাদিককে বেদম মারধর শুরু করে এবং বাসা থেকে তাকে টেনে হেঁচড়ে বাইরে এনে চোখ বেঁধে ফেলে। তাকে কলেমা পড়ার জন্য নির্দেশ দেয়, কারণ কিছুক্ষণের মধ্যেই তাকে এ্যানকাউন্টারে মেরে ফেলা হবে। মারধর, হুমকি এক পর্যায় তাকে ডিসি অফিসে এনে ভ্রাম্যমান আদালত বসিয়ে জেল হাজতে প্রেরণ করে। তার পরে যা হবার তাই, বিষয়টি অতিদ্রুত ‘টক অব দ্যা কান্ট্রিতে’ পরিণত হয়। এই ক্ষমতাধর জেলা প্রশাসক বেমালুম ভুলে গিয়েছিলেন জনপ্রশাসন রাষ্ট্রের এমন একটি স্তর, যে স্তরটি দেশের তৃণমূল পর্যায়ের জনমানুষের সরাসরি খেদমত করার গুরুত্বপূর্ণ হাতিয়ার। এই জনপ্রশাসন মন্ত্রনালয়টি বর্তমান প্রধানমন্ত্রী নিজে দেখেন। প্রধানমন্ত্রী নিজে মহিলা এবং নারীর ক্ষমতায়নে তিনি ও তাঁর সরকার অত্যন্ত গুরুত্ব দেওয়ায় দেশের ৬৪ জেলার প্রায় এক চতুর্থাংশ জেলার জেলা প্রশাসক নারী। দৃঢ়তার সাথে বলা যায়, স্বাধীন বাংলাদেশের সাংবাদিক বান্ধব একমাত্র রাষ্ট্রনায়ক ছিলেন জাতির পিতা শেখ মুজিবুর রহমান। তাঁর কন্যা জননেত্রী বর্তমান সরকারের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাও সাংবাদিক বান্ধব। অথচ তাঁর সরকারের তৃণমূল প্রশাসন কিছু হলুদ তোষণকারী সাংবাদিকদের লালন-পালন করছে মাত্র। বিশ্লেষকরা মনে করেন, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা মনে প্রাণে বিশ্বাস করেন, বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ইসলামের কবিতার বাণী, ‘যা কিছু সৃষ্টি চির কল্যাণকর, অর্ধেক তার এনেছে নারী, অর্ধেক তার নর।’ সমাজ বাস্তবতায় স্বীকার করতেই হয়, পৃথিবীর সকল সুন্দর ও সৌন্দর্যের নির্মাতা নারী সমাজ। বিপরীতে বলতে দ্বিধা নেই, সমাজ-রাষ্ট্রে নারী সমাজের একটি বৃহৎ অংশ লোভ-লালসার অন্ধকারে নিমজ্জিত। এরা টাকা পয়সাকে মহর মনে করে। উচ্চ শিক্ষা তাদের বিবেকবান করতে পারে নি। গত ১০ বছরে যতজন পুুরুষ দুর্নীতির ফাঁদে পা রেখেছেন, তাদের প্রায় সবাই বিজয়ালক্ষী ঘরের স্ত্রীদের চাহিদা পূরণ করতেই করেছেন। কোন কোন ক্ষেত্রে ওই ব্যক্তির কর্মধর্মের সকল চাবি স্ত্রী কো-অপ্ট করায় তারা দুর্নীতির মতো পাপ কাজ করতে বাধ্য হয়েছেন। হাজারো ভালো মানুষের মধ্যে মুক্তিযোদ্ধা সন্তান কুড়িগ্রামের সাবেক ডিসি কোন ক্যাটাগরিতে পড়েছেন, তা আমাদের জানা নেই। তবে তিনি যে সাংবাদিক আরিফুল ইসলামকে শিক্ষা দেওয়ার পরিকল্পনাটি নিজেই করেছেন, এতে কোন সন্দেহ নেই। ঘটনার পর জেলা প্রশাসককে প্রত্যাহার করা হয়েছে। প্রত্যাহার হওয়ার পর তিনি সোশ্যাল যোগাযোগ মাধ্যমে বিশাল এক খোলা চিঠির মাধ্যমে অনেক কিছুই জাতিকে জানানোর চেষ্টা করেছেন। তার প্রকাশিত খোলা চিঠির বিশেষ বিশেষ অংশ তুলে ধরছি। ‘সম্মানিত কুড়িগ্রাম জেলাবাসীর দৃষ্টি আকর্ষণ করে জানাচ্ছি যে, জেলা প্রশাসক হিসেবে, কুড়িগ্রাম জেলায় যোগদানের পর আজ পর্যন্ত এই জেলার আর্থ সামাজিক এবং মানবিক উন্নয়নে যে সব কাজ করেছি তার প্রত্যেকটি কাজেই প্রিন্ট এবং ইলেক্ট্রনিক্স মিডিয়ার সাংবাদিক ভাইয়েরা আমার পাশে ছিলেন।’ সাংবাদিক হিসেবে যতটুকু জানি, কুকুর যখন মানুষ কামড়ায়, তখন সংবাদ হয় না, মানুষ যখন কুকুর কামড়ায় তখনই সংবাদ হয়। কুড়িগ্রাম জেলা প্রশাসক ভাগ্যবান এই বলে যে, ওখানকার সাংবাদিকরা তার কর্মের স্বীকৃতি দিয়ে সংবাদ প্রকাশ করেছেন। তার বিশাল চিঠির এক জায়গায় উল্লেখ করেছেন, ‘তা কর্মের স্বীকৃতি স্বরূপ তিনি রংপুর বিভাগের মধ্যে দু’দুবার শ্রেষ্ঠ ডিসি হবার গৌরব অর্জন করেছেন।’ আপনার কর্মই আপনাকে শ্রেষ্ঠ করেছে এজন্য আপনাকে ধন্যবাদ দিতে কারো আপত্তি নেই। আপনার স্মরণ রাখার উচিত ছিল, যে সমস্ত হলুদ সাংবাদিকরা আপনার তোষণকারী হিসেবে ছিল, ওই ব্যক্তিরা আপনাকে শেষ রক্ষা করতে পারবে না কারণ ওরা বিবেক দ্বারা পরিচালিত নয়, স্বার্থের জন্যই পরিচালিত হয়। ডিসি সুলতানা পারভীন যোগদানের পর থেকে প্রত্যাহারের পূর্বমুহুর্ত পর্যন্ত কুড়িগ্রামের বিশাল উন্নয়নের যে ফিরিস্তি তুলে ধরে আত্মপক্ষ সমর্থন করে চিঠি লেখেছেন, এতে স্বাভাবিকভাবেই প্রশ্ন ওঠে, আপনি কি ব্যক্তিগত সহায় সম্পত্তি উন্নয়নে ব্যয় করেছেন? নাকি প্রজাতন্ত্রের কর্মচারী হিসেবে রুটিনওয়ার্ক করেছেন? আপনি প্রজাতন্ত্রের কর্মচারী হিসেবে যা করেছেন, তাতে আপনার গৌরব করার কিছুই নেই। তুলনামূলক ভাবে ভালো কাজের জন্য আপনার আত্মতৃপ্তিই যথেষ্ট। সাবেক ডিসি সুলতানা পারভীন লেখেছেন, এতো ভালো করার পরও একটি মাত্র কাজের জন্য সকল অর্জন ধ্বংস হয়ে যেতে পারে না, আমরাও তাই মনে করি। আপনার কথায় এটাই স্পষ্ট, একজন সাংবাদিককে মধ্যরাতে বাড়ি থেকে তুলে নিয়ে নির্যাতন, মিথ্যা মামলায় জেল হাজতে প্রেরণের ঘটনাটি একেবারেই তুচ্ছ বিষয়! মুসলিম হিসেবে আাপনি শয়তান সৃষ্টির ইতিহাস না জানলেও সারা পৃথিবীর মানুষ তা জানেন। আল্লাহ তালার সবচেয়ে প্রিয় ফেরেস্তা ছিলেন, আজাজিল। শ্রষ্টা শখ করে সৃষ্টি করলেন, সৃষ্টির শ্রেষ্টজীব মানবকুল। সৃষ্টির পর এই মানবকুলকে সেজদা করার জন্য নূরের তৈরি ফেরেস্তা আজাজিলকে আল্লাহ-তালা নির্দেশ দিলেন, আজাজিল নূরের তৈরি, বিধায় মাটির তৈরি মানুষকে সেজদা করতে অবজ্ঞা করল। আল্লাহর তালার আদেশ অমান্য করায় এই আজাজিল ইবলিশ শয়তান হিসেবে প্রতিষ্ঠা পেল। প্রত্যাহার হওয়া ডিসি মহোদয় আপনি কি করেছেন, তা আপনিই বিবেচনা করুন, ভাবুন, উত্তর খুঁজে পাবেন। একমাত্র অনুতপ্তের মধ্যেই আপনার বিচার শেষ হওয়ার কথা নয়। আপনি ছিলেন, রাষ্ট্রের দায়িত্বপ্রাপ্ত অভিভাবক। সম্প্রতি অনলাইন একটি পোর্টালে এক সংবাদে প্রকাশ পেয়েছে, প্রত্যাহার হওয়ার জেলা প্রশাসক সুলতানা পারভীনের আত্মীয় স্বজনরা তার এলাকার এক নিরীহ ব্যক্তির বৈধ ৪ একর জমি ভুয়া দলিল পত্রের মাধ্যমে দখল করে রেখেছিলেন। ডিসি পতনের পর ওই জমির মূল মালিক তা ফিরে পেয়েছেন। এই লেখাটি যখন তৈয়ার করি, তখন এক ব্যক্তি জানালেন, পতিত ডিসি সুলতানা পারভীনের এক ভাই ফারুক হোসেন, তিনি প্রাইমারি স্কুলের শিক্ষক। ওই ব্যক্তি প্রাইমারি স্কুলের চাকুরী দেওয়ার নাম করে অনেকের কাছ থেকেই টাকা পয়সা লুটে নিয়েছে। যে ব্যক্তি এটি আমাকে জানিয়েছেন, তিনি একজন ভুক্তভোগী চাকুরী প্রার্থী বেকার মহিলা। লেখার প্রারম্ভে সাংবাদিক মোনাজাত উদ্দীনের একটি লেখার উদ্বৃতি দিয়ে শুরু করেছিলাম, যা এখন শেষ করছি। সাংবাদিক মোনাজাত উদ্দীন সাঁতার জানতেন না, এই সাঁতার না জানা সাংবাদিক হঠাৎ নদীতে পড়ে মারা গেলেন, অথচ বহনকারী লঞ্চটি চরে আটকে পড়ে নি, অন্য কোন লঞ্চের সাথে তার বহনকারী লঞ্চটি মুখোমুখি সংঘর্ষ হয়নি। কেন এমনটি হলো! ধারণা করা যায়না। তার সাঁতার না জানা বিষয়টি যারা জানেন, তাদের কেউ তাকে ফলো করেছিলেন এবং শত্রুতার খায়েশ মিটিয়েছে। চারণ সাংবাদিক মোনাজাত এবং নির্যাতিত আরিফুলের ঘটনাটি আমার কাছে প্রায় কাছাকাছি মনে হচ্ছে।

রহিম আব্দুর রহিম, শিক্ষক, লেখক, নাট্যকার ও কলামিস্ট।