বাংলা ট্রিবিউন
সাংবাদিক আরিফুল ইসলাম রিগানকে মধ্যরাতে মারধর করে বাসা থেকে তুলে নিয়ে মোবাইল কোর্টের মাধ্যমে সাজা দেওয়ার ঘটনা নিয়ে এখনও মিথ্যাচার চালিয়ে যাচ্ছেন জেলা প্রশাসক সুলতানা পারভীন। প্রত্যাহারের পর তিনি মঙ্গলবার (১৭ মার্চ) তার ফেসবুক আইডিতে স্ট্যাটাস দিয়েছেন। সেখানে তিনি জেলা মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদফতরের চাহিদা অনুযায়ী এই মোবাইল কোর্ট পরিচালনা করা হয়েছে বলে দাবি করেন। তবে জেলা প্রশাসনের একটি সূত্র জানায়, জেলা প্রশাসক সুলতানা পারভীনের নির্দেশনা অনুযায়ী ম্যাজিস্ট্রেট রিন্টু বিকাশ চাকমা এই মোবাইল কোর্ট পরিচালনা করেন। এজন্য তিনি পুলিশ সুপারের কাছে পুলিশ চেয়ে একটি চিঠিও দিয়েছিলেন।

এই মোবাইল কোর্ট পরিচালনা নিয়ে মিথ্যাচার করা প্রসঙ্গে যোগাযোগ করা হলে সদ্য প্রত্যাহার হওয়া জেলা প্রশাসক সুলতানা পারভীনের কোনও বক্তব্য পাওয়া যায়নি। প্রত্যাহার হওয়ার পর থেকেই তিনি সাংবাদিকদের ফোন ধরছেন না।

জেলা প্রশাসক কার্যালয়ের একটি সূত্র থেকে প্রাপ্ত তথ্যে দেখা গেছে, গত ১৩ মার্চ জেলা প্রশাসকের কার্যালয়ের এক্সিকিউটিভ ম্যাজিস্ট্রেট রিন্টু বিকাশ চাকমা স্বাক্ষরিত একটি চিঠি পুলিশ সুপার, জেলা বিশেষ শাখা, কুড়িগ্রাম বরাবর পাঠানো হয়। যার স্মারক নং-০৫.৪৭.৪৯০০.০৩৬.০১.০০১.২০-১২। ওই চিঠিতে বিষয় হিসেবে উল্লেখ রয়েছে মোবাইল কোর্ট পরিচালনায় পুলিশ ফোর্স নিয়োগ প্রসঙ্গে। চিঠিতে বলা হয়, উপযুক্ত বিষয়ের প্রেক্ষিতে অদ্য ১৩/৩/২০২০ খ্রি. তারিখে রাত ১১.০০ ঘটিকার সময় মোবাইল কোর্ট পরিচালনা করা হবে। উক্ত মোবাইল কোর্ট পরিচালনাকালে একজন পুলিশ অফিসারের নেতৃত্বে পুলিশ লাইনের প্রয়োজনীয় সংখ্যক (৭) সশস্ত্র পুলিশ ফোর্স নিয়োগের প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করার জন্য অনুরোধ করা হলো। চিঠিটির কুড়িগ্রামের অতিরিক্ত জেলা ম্যাজিস্ট্রেট, নেজারত ডেপুটি কালেক্টর (গাড়ি সরবরাহ করার জন্য), পুলিশ লাইন্সের আর আই (রিজার্ভ ইন্সপেক্টর) বরাবর অনুলিপি দেওয়া হয়।

কিন্তু, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসুবকে দেওয়া স্ট্যাটাসে জেলা প্রশাসক সুলতানা পারভীন দাবি করেছেন, ‘গত ১৩ মার্চ ২০২০ দিবাগত রাতে নিয়মিত কার্যক্রমের আওতায় কুড়িগ্রাম মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদফতরের চাহিদার পরিপ্রেক্ষিতে ৬ জন পুলিশ, ৫ জন আনসার এবং মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদফতরের ইন্সপেক্টরসহ ৩ জন এবং এক্সিকিউটিভ ম্যাজিস্ট্রেটের নেতৃত্বে টাস্কফোর্স অভিযানের অংশ হিসেবে ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালিত হয়।’ কিন্তু মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদফতরের পরিদর্শক জাহিদুল ইসলাম বলেছেন, ‘আমাদের কোনও রিকুইজিশন ছিল না। এর বাইরে আমি আর কিছু বলতে পারবো না।’

জেলা প্রশাসক সুলতানা পারভীন ফেসবুকে বলেন, ‘আমি পরদিন সকালে ১৪ মার্চ ২০২০ সালে ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালনা ও আদেশের বিষয়টি অবহিত হই। সংশ্লিষ্ট এক্সিকিউটিভ ম্যাজিস্ট্রেটের কাছে বিষয়টি সম্পর্কে বিস্তারিত জানতে চাই। তিনি যথাযথ প্রক্রিয়া অবলম্বন করে মোবাইল কোর্ট পরিচালনা করা হয়েছে মর্মে আমাকে অবহিত করেন। অভিযান এবং ভ্রাম্যমাণ আদালতের রায়ের প্রেক্ষিতে মিডিয়া ও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে যে অবস্থা সৃষ্টি হয়েছে তা অনাকাঙ্ক্ষিত এবং এ বিষয়ে আমাকে দায়ী করে যে সংবাদ প্রকাশিত ও পরিবেশিত হচ্ছে তাতে আমি প্রচণ্ডভাবে মর্মাহত।’

ডিসি সুলতানা পারভীন ফেসুবকে দেওয়া স্ট্যাটাসে এক্সিকিউটিভ ম্যাজিস্ট্রেট অপেক্ষাকৃত অনেক নবীন উল্লেখ করে বলেন, ‘যেহেতু আদালত কিছু বিধিবিধান এবং পদ্ধতির মাধ্যমে পরিচালিত হয় সেহেতু উক্ত বিধিবিধান এবং পদ্ধতি প্রয়োগে অনিচ্ছাকৃত ভুল হতেই পারে। সার্বিক বিষয় বিবেচনায় নিয়ে আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে আপিল মঞ্জুর করে একদিন পর অর্থাৎ ১৫ মার্চ পূর্বাহ্ণে আরিফুল ইসলাম রিগানকে জামিন দেওয়া হয়। নিয়মিত কার্যক্রমের আওতায় অভিযানটি পরিচালিত হয়, যাতে আমার সামান্যতম কোনও হস্তক্ষেপ ছিল না। কিন্তু আমাকে প্রত্যক্ষভাবে জড়িয়ে এবং হস্তক্ষেপের বিষয়টি উল্লেখ করে নিষ্ঠুরভাবে দোষী সাব্যস্ত করা হচ্ছে। অভিযান পরিচালনাকালে যদি সংশ্লিষ্ট ম্যাজিস্ট্রেট কোনও পদ্ধতিগত ভুল করেও থাকে, সেটির দায়ভার কি সরাসরি আমার ওপর বর্তায়?

মোবাইল কোর্ট অ্যাক্ট ২০০৯-এ জেলা পর্যায়ে মোবাইল কোর্ট পরিচালনা প্রসঙ্গে ডিস্টিক্ট ম্যাজিস্ট্রেটের নির্দেশেই নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেটরা মোবাইল কোর্ট পরিচালনা করবেন বলে উল্লেখ রয়েছে। জানতে চাইলে সাবেক সিনিয়র জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট ও সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী আজিজুল হক দুলু বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘মোবাইল কোর্ট ২০০৯-এর আইনের পাঁচ ধারা অনুযায়ী জেলা ম্যাজিস্ট্রেটের অনুমতি ছাড়া জেলার কোনও নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট মোবাইল কোর্ট পরিচালনা করতে পারেন না। তার মানে জেলা ম্যাজিস্ট্রেট লিখিত অনুমতি দেন। এর অর্থ জেলা প্রশাসক কোনোভাবেই দায় এড়াতে পারবেন না।’

মাদক কর্মকর্তার উপস্থিতি নিয়েও ধূম্রজাল
জেলা প্রশাসক সুলতানা পারভীনের মতো সাংবাদিক আরিফুল ইসলাম রিগানকে তুলে নিয়ে মারধর করে মোবাইল কোর্টের মাধ্যমে দণ্ড দেওয়ার বিষয়ে মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদফতরের কর্মকর্তারাও মিথ্যাচার করছেন। মোবাইল কোর্টের নথিপত্রে দেখা গেছে, জব্দ তালিকায় স্বাক্ষর করেছেন জেলা মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদফতরের পরিদর্শক জাহিদুল ইসলাম। নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট রিন্টু বিকাশ চাকমা তার আদেশে বলেন, ‘আরিফুলের বাসগৃহ থেকে ১০০ গ্রাম গাঁজা ও ৪৫০ গ্রাম ইথাইল অ্যালকোহল জব্দ করা হয়। উপস্থিত, মো. জাহিদুল ইসলাম, পরিদর্শক, মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদফতর, জেলা কার্যালয়, কুড়িগ্রাম পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে জানান, তিনি মাদকদ্রব্য সেবনও করেছেন।’

তবে যোগাযোগ করা হলে জেলা মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদফতরের পরিদর্শক জাহিদুল ইসলাম বলেন, ‘ঘটনার সময় আমি উপস্থিত ছিলাম না। আমি রংপুরে ছিলাম। আমি আর কিছু বলতে পারবো না।’