সিবিএন ডেস্ক:

কুড়িগ্রামে মধ্যরাতে দরজা ভেঙে ঘরে ঢুকে সাংবাদিক নির্যাতনকারী জেলা প্রশাসনের আরডিসি (জ্যেষ্ঠ সহকারী কমিশনার-রাজস্ব) নাজিম উদ্দিন ২০১৮ সালের অক্টোবর থেকে ২০১৯ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত মাগুরার মহম্মদপুর উপজেলায় এসিল্যান্ড হিসেবে কর্মরত ছিলেন। মহম্মদপুরে থাকাকালে বিভিন্ন ব্যক্তির সঙ্গে খারাপ আচরণ, মারধর, বাড়িঘর-ভাংচুরসহ নানা অনিয়ম ও দুর্নীতির অভিযোগ ওঠে তার বিরুদ্ধে।ব্যক্তি মালিকানাধীন জমিকে খাস দেখিয়ে সরকারি বরাদ্দের নামে কোটি টাকা হাতিয়ে নেওয়ার অভিযোগে তার বিরুদ্ধে চলছে বিভাগীয় মামলা। উপজেলায় এসিল্যান্ড থাকাকালে তিনি যেন হয়ে উঠেছিলেন মহম্মদপুরের ‘নিজাম (নৃপতি বা শাসক)’।

মহম্মদপুর উপজেলার জোকা গ্রামের সৈয়দ ছদরুদ্দীন জানান, ২০১৮ সালের শেষ দিকে তিনি ছয় লাখ টাকা দিয়ে উপজেলা সদরের আলেক শাহ ফকির গংয়ের কাছ থেকে (মহম্মদপুর এসএ ৫৮ নং খতিয়ানের) সাড়ে ১২ শতক জমি কেনেন। কিন্তু জমি রেজিস্ট্রি করতে গেলে বাধে বিপত্তি। তৎকালীন এসিল্যান্ড নাজিম উদ্দিন মৌখিকভাবে মালিকানা দাবি করে সাব রেজিস্ট্রারকে জমি রেজিস্ট্রি করতে নিষেধ করেন। এরপর তাকে দেখা করতে বললে, তিনি

অফিসে গিয়ে দেখা করেন। এ সময় খাজনাসহ সরকারি বিভিন্ন খাত দেখিয়ে তিনি তার কাছে দুই লাখ টাকা দাবি করেন। ছদরুদ্দিন সরল বিশ্বাসে দেড় লাখ টাকা দিয়ে জমি রেজিস্ট্রির উদ্যোগ নেন। এতে নাজিম উদ্দিন তার ওপর ক্ষিপ্ত হয়ে ওঠেন। এরপর ছদরুদ্দিন জাল মুক্তিযোদ্ধা সনদের ব্যবসা করেন- অভিযোগে মোবাইল কোর্টের মাধ্যমে সাজা দিতে দলবল নিয়ে তার বাড়িতে হাজির হন। তাকে না পেয়ে দরজা ভেঙে ঘরে প্রবেশ করে আসবাবপত্র ভাংচুর করেন। এ সময় তার স্ত্রীকে ঘাড় ধাক্কা দিয়ে ফেলে দেন।

ছদরুদ্দিন অভিযোগ করেন, উপজেলা সদরসহ বিভিন্ন বাজারে নাজিম উদ্দিন প্রায় শতাধিক দোকান ঘর ও বিঘা বিঘা সরকারি জমি বরাদ্দের নামে এক বছরে মহম্মদপুর থেকে কমপক্ষে ৫ কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়েছেন। সেই টাকা দিয়ে যশোরের মনিরামপুর উপজেলার সদরে ও কাশিপুর নিজ গ্রামে প্রাসাদোপম বাড়ি বানিয়েছেন, যা তিনি নিজ চোখে দেখে এসেছেন। ঢাকাতেও তার নামে-বেনামে একাধিক প্লট ও ফ্ল্যাট থাকার কথা বিভিন্ন জনের কাছে শুনেছেন। এতদিন সাহস না পেলেও এখন তার বিরুদ্ধে মামলা করবেন বলেও জানান ছদরুদ্দিন।

মহম্মদপুর সদরের ওষুধ ব্যবসায়ী বাদশা ফকিরের পৈত্রিক জমির কিছু অংশ তার বাবার নামে ও কিছু অংশ সরকারের নামে রেকর্ড ছিল। কোনো মামলা ছাড়াই সরকারি কাগজপত্র সংশোধন করে গোটা জমি তদের নামে রেকর্ড করার জন্য তিন লাখ টাকা ঘুষ নেন নাজিম উদ্দিন। পরে তিনি রেকর্ড সংশোধন তো দূরের কথা বিভিন্ন মানুষের কাছ থেকে লাখ-লাখ টাকা নিয়ে ওই জমি বরাদ্দ দেওয়া শুরু করেন। এ সময় টাকা ফেরত চাইলে তার ওপর সন্ত্রাসী হামলা ও গুলি করে হত্যার হুমকি দেন নাজিম উদ্দিন। এ ব্যাপারে জীবনের নিরাপত্তা চেয়ে তিনি মহম্মদপুর থানায় জিডি ও টাকা ফেরত পেতে আদালতে মামলা করেন। এতে ক্ষিপ্ত হয়ে নাজিম উদ্দিন দলবল নিয়ে রাতে বাড়িতে গিয়ে তার স্ত্রীকে মারধর করেন। পরে মোবাইল কোর্ট পরিচালনা করে অবৈধ গর্ভপাতের মিথ্যা অভিযোগে তাকে এক বছরের কারাদণ্ড ও ২ লাখ টাকা জরিমানা করেন।

নাজিম উদ্দিন এভাবে তাকে বিনা অপরাধে ২ মাস ৩ দিন জেল খাটান অভিযোগ করে বাদশা ফকির বলেন, নাজিম উদ্দিনের মতো খারাপ ও ঘুষখোর অফিসার মহম্মপুরবাসী আগে কখনো দেখেনি। এ ধরনের অফিসার কোনো গুরুত্বপুর্ণ দায়িত্বে থাকলে রাষ্ট্রের বড় ধরনের ক্ষতির আশঙ্কা রয়েছে।

মহম্মদপুরের রাজাপুর গ্রামের মিষ্টি ব্যবসায়ী অজয় সাহা বলেন, মোবাইল কোর্ট পরিচালনার নামে নাজিম উদ্দিন তার দোকানে এসে ফার্নিচার ভাংচুর করেন। এ সময় তিনি তাকে অশ্রাব্য ভাষায় গালি দেন। কারও ব্যবহার এতো খারাপ হতে পারে- এটা ভেবে তিনি অবাক হন।

২০১৯ সালের সেপ্টেম্বর মাসে নাজিম উদ্দিন মহম্মদপুরে বিভিন্ন ব্যক্তির মালিকানাধীন জমি খাস দাবি করে তাতে থাকা দোকান ভাংচুর করেন। এ সময় একাধিক ব্যবসায়ী তার হাতে লাঞ্ছিত ও মারধরের শিকার হন। পরে ব্যবসায়ীদের তোপের মুখে পিছু হটেন তিনি। মিরাজুল ইসলাম নামের এক ব্যবসায়ী জানান, ওই সময়ে নহাটা বাজারের ব্যবসায়ীরা তার বিরুদ্ধে বিক্ষোভ সমাবেশ, ঝাটা মিছিল ও সংবাদ সম্মেলন করেছিলেন।

মহম্মদপুর উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি অ্যাডভোকেট আব্দুল মান্নান বলেন, সাবেক এসিল্যান্ড নাজিম উদ্দিন মহম্মদপুরে নানা অনিয়ম, দুর্নীতি করে গেছেন। যার সঙ্গে স্থানীয় একটি প্রভাবশালী মহল জড়িত ছিল।

জেলা প্রশাসক ড. আশরাফুল আলম বলেন, অসাদচারণ, অনিয়ম, দুর্নীতিসহ নানা অভিযোগে মহম্মদপুর উপজেলার সাবেক এসিল্যান্ড নাজিম উদ্দিনের বিরুদ্ধে বিভাগীয় মামলা চলছে। যেটি বিভাগ থেকে তদন্ত করা হচ্ছে।

বর্তমানে কুড়িগ্রাম জেলা প্রশাসনের আরডিসি নাজিম উদ্দিন এসব অভিযোগ অস্বীকার করে সমকালকে বলেন, তারা যেসব জমির নিয়ে অভিযোগ করেছে সেগুলো হাটের সীমানাভুক্ত সরকারি খাস জমি। আর ওই বিষয় নিষ্পত্তিও হয়ে গেছে। বলে তিনি ফোন কেটে দেন।