অধ্যাপক রায়হান উদ্দিন
জন্মের ক্ষন,দিন,তারিখ,মাস,সাল জানা নেই।বাবা মা লিখে রাখলেও তা জানা সম্ভব হয়নি।নিজে নিজে প্রশ্নের মাধ্যমে বেরিয়ে এসেছে জন্ম সাল ১৯২৭। আবার কোন কোন ম্যাগাজিনে তাঁর স্মৃতি চারনমুলক লেখায় কেউ কেউ ১৯২৩ ইংরেজিতে ওস্তাদজীর জন্মসাল এর কথা উল্রেখ করেছেন। ওস্তাদজীর সাথে আলাপচারিতায় কসবাজারের বিশিষ্ট সংগীতবিশারদ জনাব আসম আবু বকর সিদ্দিকীর জন্মসালকে ১৯২৭ ইংরেজীকে এভাবেই মেনে নেওয়া হয়।

আট নয় বৎসর বয়সেই ওস্তাদজীর মেঝদা মরহুম বজলুর রহীম চৌধুরীর এসরাজ বাজানোর সুর তাঁর খুব ভালো লাগতো।পরবর্তিতে আমরা দেখতে পাই তিনি এই এসরাজ হাতে তুলে নেন। সেতারে তাঁর হাত ভিষন মিস্টি ছিল। প্রায় রাতে যখন কেউ থাকতো না একা একা সেতার বাজাতেন।বাসায় গ্রামোফোন ছিল । ওস্তাদজি নীরবে শুনতেন । নিজে নিজে তন্ময় হয়ে যেতেন। এভাবে গানের সাথে মিশে গিয়েছিলেন।

ফটিকছড়িতে তাঁর পিতৃনিবাস হলেও শৈশব কেটেছে ককসবাজার শহরেই।রাখাইন সংখ্যাগরিষ্ট ককসবাহারে পরবর্তীতে হিন্দু আধিক্য গড়ে উঠে।মুসলিম আবাস গড়ে উঠে অনেক পরে।তখন ওস্তাদজীর যৌবন কাল।

যতদুর জানা যায় ১৯৩৭ সনে ককসবাজারে প্রাথমিক শিক্ষালাভের পর তাঁর পিতৃনিবাস ফটিকছড়িতে কর্পোরেশন হাই স্কুলে তিনি ভর্ত্তি হন।১৯৪২ সালে দশম শ্রেনীতে অধ্যয়ন কালে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় ওস্তাদজীর পিতা ইন্তেকাল করেন। এসময় আর্থিক অনটনের কারনে তিনি ব্রিটিশ সেনাবাহিনীতে যোগ দেন।অবজার্ভার কোরের টেলিফোন অপারেটরের দায়িত্ব পান তিনি। ওখানে তিনবৎসর কাজ করার পর মার নির্দ্দেশে সেনাবাহিনী থেকে পালিয়ে আসেন। তখন তিনি সেনাবাহিনীর দৃস্টি এড়াবার জন্য সিরাজুল হক নামে ছদ্মনামও ধারন করেন।সেনাবাহিনী থেকে পালিয়ে আসার পর তিনি ঢাকার লায়ন সিনেমায় বুকিং ক্লার্ক হিসেবে চাকরী নেন।পরে বদলী হয়ে একই পদে চট্টগ্রাম লায়ন ক্লাবে চাকরী নেন। ঐসময় তিনি চট্গ্রাম আর্যসঙ্গীত বিদ্যাপীঠে ওস্তাদ সুরেশ চক্রবর্তীর কাছে সঙ্গীতে তালীম নেন।১৯৪৬ সালে হিন্দু মুসলিম দাঙ্গায় অধ্যক্ষ মহোদয় কলকাতায় পালিয়ে যান।আমি আগেই বলেছি তিনি মুন্সী রঈসউদ্দিনের কাছেও সঙ্গীতে তালীম নেন।উচ্চাঙ্গ সঙ্গীতের শিক্ষানবীস হিসেবে ১৯৪৮ সাল পর্যন্ত চর্চা করেন এরপর ১৯৪৭ সালে প্রাইভেট পরীক্ষার্থী হিসেবে মেট্রিক পাশ করেন।নানা অসুবিধা , আর্থিট অনটনের কারনে আর পড়াশুনা করা হয়ে উঠৈনি।১০৯৫০ সালে কোওপারেটিভ ব্যাংক ককসবাজার শাখায় ।১৯৬৪ সালে পাবলিক লাইব্রেরীর গ্রন্থাগারিক পদে যোগ দেন।১৯৮৭ ইং পর্যন্ত নিরবিচ্ছিন্নভাবে গ্রন্থাগারিক পদে থেকে ককসবাজারের ঐতিহ্যবাহী এই পাবলিক লাইব্রেরীর উন্নয়নে বিশেষ ভুমিকা রেখে নিজেই অব্যহতি নেন। ।এর পর তিনি ককসবাজারে ফিরে আসেন।তখন ওস্তাদ জগদানন্দ বড়ুয়ার কাছে সঙ্গীতে তালিম নেন। এসময় ককসবাজারে ডা: হরিমোহন সেন, আমার ফুফাত ভাই কবি শিণ্পী সাহিত্যিক জনাব ওহিদুল আলম, শিক্ষক, শিল্পী ,বিজ্ঞানী দেবপ্রসাদ ভট্টাচায্র্,এডজুটেন্ড মুস্তাক আহমেদ, বজল আহমেদ,হরিবাবু যিনি আমাদের শিল্পী দোলন চাঁপার বাবা সহ আরো অনেকে।

তখন এই গানের স্কুলের জন্য নিবেদিত প্রাণ অনেকে ছিলেন। প্রয়াত এডভোকেট সুরেশ চক্রবর্তী, এডভোকেট জোত্যিশ্বর চক্রবর্তী সহ আরো অনেকে এই প্রতিষ্টানটির প্রতি নিবেদিত প্রান ছিলেন।আসলে ১৯৫৯ সালের কোন এক সন্ধায় ওস্তাদজী পাবলিক লাইব্রেরীতে গান গেয়েছিলেন।ওখা্নে শ্রোতা হিসেবে ছিলেন তখনকার ডি এফ ও অর্থাৎ বন কর্মকর্তা এম এ আলীম সাহেব।পরের দিন তিনি ওস্তাদজীর সাথে দেখা করতে বাড়িতে গাড়ি পাঠালেন এবং ওস্তাদজী সেই গাড়িতেই এম এ আলীমের সাথে দেখা করতে গেলেন।প্রথম দেখাতেই এম এ আলীম সাহেব ওস্তাদজীর ভুয়সী প্রশংসা করলেন।সঙ্গে সঙ্গে তিনি তাঁর মেয়ে মিলিয়াকে গান শেখাবার জন্য ওস্তাদজীকে দায়িত্ব নিতে বললেন।মাস খানেক মিলিয়াকে গান শেখানোর পর আলীম সাহেব ওস্তাদজীকে ককসবাজারে একটি সঙ্গীত প্রতিষ্টান গড়ে তোলার জন্য অনুরোধ করেন।১৯৬০ সালে বন কর্ম কর্তা আলীম সাহের চেস্টায় গঠিত হয় এক কমিঠি , যার দায়িত্বে ছিলেন,বাবু মনোমুহন সেন, নুরুল হুদা, ভোলানাথ দাশ, অনিল দে, দেবপ্রাসাদ ভট্টাচার্য,দুলাল পাল এবং তিনি নিজে আহবায়কের দায়িত্ব পালন করেন্। ওস্তাদজী প্রতিষ্টাতা অধ্যক্ষের দায়িত্ব পান।

চট্টগ্রামের আর্যসঙ্গীতের অধ্যক্ষ জনাব মিহিল লালা ওস্তাদজীর ছাত্র ছিলেন। তাঁর অগুনিত ছাত্র ছাত্রী এখন বিভিন্ন ক্ষেত্রে প্রতিষ্ঠা লাভ করেছেন।তাঁর অন্যান্য ছাত্র ছাত্রীদের মধ্যে শিবানী ধর,শ্রাবন্তী ধর,আলপনা,হোসনে আরা স্বপ্না,রায়হান,ছানাউল্বলা, গানের শ্ক্ষিক আবদুশুক্কুর, ইলিয়াস মামুন যিনি দীর্ঘ দিন সঙ্গীতায়তনে ছিলেন,দোলন চাঁপা, শিক্ষক নুরুল মোক্তাদীর,জয়ন্তী বড়ুয়া, দিল মোহাম্মদ, মঞ্জু, দিল মোহাম্মদ, আক্তার জাহান,নায়িকা কল্পনা, সাইফুল ইসলাম সহ আরো অনেকে রয়েছেন।

সঙ্গীতায়তন প্রতিষ্ঠা লাভ করে ১৯৬০ সালে। ডি এফ ও আবদুল আলীমের সহযোগীতায়।বর্তমান প্রেস ক্লাবের সামনে মরহুম সাবেক পৈারচেয়ারম্যান আবদুস সালাম সাহেবের ভাড়াটিয়া বাসায়।১৯৬৩ সালে প্রচন্ড সাইক্লোনে সেই ভাড়াটিয়া ঘর ভেঙ্গে যায়।তাই বর্তমান লালদিঘীর পাড়ে পৈত্রিক নিবাসেই সঙ্গীতায়তনের সাইনবোর্ড টাঙিয়ে দেওয়া হয়। ঐখানেই সঙ্গীতের কার্যক্রম শুরু হয়।

১৯৮৪ সাল হতে বাংলাদেশে ‘ধ্রুবপরিষদ’ নামে একটি সরকার অনুমোদিত প্রতিষ্টান সংগীতায়তনে সংগতের কোর্স সমুহ চালু করে। এটির প্রতিষ্ঠাতা ছিলেন ওস্তাদ জগদানন্দ বড়ুয়া।

১৯৯৫ সালের ১লা আগস্ট ওস্তাদজি ইনতেকাল করেন। এর পর তার ভ্রাতুষ্পুত্রেরা এসে সংগীতায়তনের গৃহসমুহ নিজের বলে দাবী করে মামলা করে।তখনকার কমিটি দীর্ঘদিন সংগীতায়তন পরিচালনা করার পর এই ক্রান্তিকালে দায়িত্ব অন্যদের উপর ন্যস্ত করেন। এসময় সঙ্গীতাযতনের সভাপতির দায়িত্বে ছিলেন অধ্যাপক মুফিদুল আলম চৌধুরী। ত্খন সংগীতায়তনের অবস্থা অত্যান্ত খারাপ হতে থাকে। যেহেতু ওস্তাদজীর কোন পুত্র সন্তান ছিলনা তাই বর্তমান সংগীত বিদ্যাপীঠ নানা সমস্যার সম্মুখীন হতে থাকে। ওস্তাদজীর বাড়ীর সামনে যে দোকান ছিল তা ভ্রাতুস্পুত্রেরা জোর করে ভেঙ্গে ফেলে।স্কুলের সামনে ভিটেমাটি খুড়ে নিয়ে যেতে থাকে। সঙ্গীতায়তনের বিরোদ্ধে নানা হুমকি দমকি আসতে থাকে।তখন আমি এর সভাপতির দায়িত্ব গ্রহন করি। আমার বিরোদ্ধে চাঁদাবাজীর মামলা থেকে শুরু করে অনেক হুমকি আসতে থাকে।দফায় দফায় ওস্তাদজীর ভ্রাতুস্পুত্রদের সাথে বৈঠক চলে। এমন কি ককসবাজার সদর আসনের এমপি জনাব সাইমুম সরওয়ার কমলের বাড়ীতে ও ওস্তাদজীর ভ্রাতুস্পুত্র এবং ভাতিজী সবার সাথে বৈঠক অনুস্ঠিত হয়। তাঁরা কেউ সংগীতায়তনের জায়গা দেওয়ার ব্যাপারে রাজী নয়। অথচ সঙ্গীতায়তনের নিজস্ব জায়গা রয়েছে স্কুলে।তারা সরাসরি সঙ্গীতের বিপক্ষে গিয়ে কথা বলতে থাকেন। প্রায় দুই বছর মামলা চলার পর মান্যবর জজ সাহেবের চেস্টায় উভয় পক্ষ সোলেনামা মুলে সঙ্গীতায়তন দুই শতক জায়গা ফিরে পায়।

এখন সঙ্গীতায়তন নিজস্ব জায়গায় ঘর করেছে। এতে রয়েছে একটি ছোট্ট মঞ্চও। প্রায় শ দুয়েক ছাত্র ছাত্রী সহ প্রশিক্ষক রয়েছে। ককসবাজারে বিভিন্ন জাতীয় দিবসে অংশ গ্রহন করে অনেক সুনাম কুড়িয়েছে।মাননীয় সাংসদ সাইমুম সরওয়ার কমল,জেলা পরিষদ চেয়ারম্যান জনাব মুসতাক আহমেদ চৌধুরী,পৌর চেয়ারম্যান জনাব মুজিবর রহমানের চেস্টায় এই প্রতিষ্টানটি নুতন উদ্যমে চলা শুরু করেছে।একসময় ওস্তাদজীর কাছে তখনকার জেলা প্রশাসক এম এ কামাল জমি ও টাকা দিয়ে এই প্রতিষ্টানকে সাহায্য করতে চেয়েছিলেন, তিনি সবিনয়ে প্রত্যাখান করেছিলেন।ছাত্র ছাত্রীদের মাসিক চ্াঁদা ও স্যারের টিউশানি এবং প্রয়োজনে দোকান ভাড়ার টাকাও সঙ্গীতায়তনের কাজে খাটানো হয়।

ওস্তাাদজী ব্যক্তিগত জীবনে নিয়মিত নামাজ পড়তেন।এশার নামাজ সেরে বই পত্রিকা পড়ে গান নিয়ে রাত চলে যেতো তাঁর।নির্ঘুম এই সঙ্গীত সাধনা নিয়মিত চলতো । ফজরের নামাজ সেরে ঘুমিয়ে পড়তেন। বিকেল বেলায় নিয়মিত ক্লাশ চলতো।আরেকটা কথা না বললে নয়, তিনি বলতেন সঙ্গীতের সাথের ধর্মের কোন সংঘাত আছে বলে তিনি মনে করতেননা। তাঁর মত , নামাজ পড়পর জন্য সহজ ভাষায় আহবান করার চেয়ে সংগীতের মাধ্যমে মানুষকে অনেক বেশী আকর্ষণ করা যায়। তিনি আরো বলেন, নজরুলের সেই ‘রোজা রাখ , নামাজ পড়, কলমা পড় ভাই ‘ গানটির উদ্ধৃতি দেন।

এই বিরল সংগীত সাধকের চেষ্টায় প্রতিষ্ঠিত ঐতিহ্যবাহী শুদ্ধ স্বরের বিদ্যাপীঠ “সঙ্গীতায়তন” কে আজীবন ধরে রাথার জন্য আমাদের চেস্টা চালিয়ে যেতে হবে।