এম.এ আজিজ রাসেল
পর্যটন নগরী কক্সবাজারে প্রতিদিন দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে পর্যটক বেড়াতে আসছে। এছাড়া এখানে চলমান মেগা প্রকল্পে ও রোহিঙ্গা ক্যাম্পে অসংখ্য বিদেশী কাজ করছেন। এ জন্য পর্যটন এই জেলা করোনা ভাইরাসের জন্য অধিক ঝুঁকিতে রয়েছে বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা। দেশে করোনা ভাইরাসে আক্রান্ত ৩ জন রোগী শনাক্ত হওয়ার পর থেকে উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা বিরাজ করছে মানুষের মনে। এছাড়া করোনাভাইরাস শনাক্তকরণে দেশে গত ২৪ ঘণ্টায় আরও ৭ জনের নমুনা পরীক্ষা করা হয়েছে এবং এতে কারও আক্রান্ত হওয়ার লক্ষণ মেলেনি । তবে বিদেশফেরত ৮ জনকে আইসোলেশনে (বিচ্ছিন্নভাবে) রাখা হয়েছে। এ নিয়ে সর্বত্র তোলপাড় চলছে। বর্তমানে বেড়ে গেছে মাস্ক ব্যবহারকারী সংখ্যা। সেই সাথে মানুষ এখন আগের তুলনায় স্বাস্থ্য সচেতন হয়ে উঠেছে।

করোনা ভাইরাস প্রতিরোধে জেলা প্রশাসন ও স্বাস্থ্য বিভাগ নানা পদক্ষেপ গ্রহণ করেছেন। এখানে আগত পর্যটকদের দেহে করোনাভাইরাস শনাক্তকরণে কক্সবাজার বিমানবন্দরে স্থাপন করা হয়েছে মেডিকেল বোর্ড। মেডিকেল বোর্ডের সক্ষমতা বৃদ্ধিতে আরও ৫ টি ইনফ্রারেড থার্মাল ইন্সট্রমেন্টের ব্যবস্থা করা হয়। কিন্তু স্থল পথে আসা কোন বাস কাউন্টারে এখনও এমন ব্যবস্থা করা হয়নি।

এছাড়া চীনের সঙ্গে মিয়ানমারের দীর্ঘ সীমান্ত রয়েছে। ওই সীমান্ত পথে চীনের পণ্য সরাসরি নিয়মিত মিয়ানমারে আসে। বাংলাদেশের পক্ষে খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, সীমান্ত হয়ে মিয়ানমারে চীনা পণ্য ও নাগরিকদের মিয়ানমারে আসতে খুব একটা বাঁধা নেই। নেই কোন করোনা ভাইরাস জীবাণু প্রতিরোধে ব্যবস্থা। আবার মিয়ানমারের পণ্যও চীনে যাচ্ছে অবাধে। আর চীন থেকে আসা এসব পণ্য মিয়ানমার হয়ে বাণিজ্যিকভাবে বাংলাদেশে ঢুকছে স্থলবন্দর, করিডোর ও সীমান্ত হয়ে। বিশেষ করে চীনের এসব পণ্য ট্রলারে করে আনছে মিয়ানমারের মাঝি মাল্লা ও সেখানকার নাগরিকরা। এ কারণে টেকনাফ স্থলবন্দর ও শাহপরীরদ্বীপ করিডোরে মিয়ানমার থেকে আসা পণ্য ও পশু বোঝাই জাহাজ, ট্রলারের মাঝি মাল্লা, মিয়ানমারের নাগরিকদের যাতায়াতে (রেড এলার্ট) সতর্কতা জারি করা হয়েছে।

কক্সবাজার নাগরিক আন্দোলন এর সমন্বয়ক সাংবাদিক এইচ,এম নজরুল ইসলাম বলেন, বাংলাদেশে করোনা ভাইরাসে আক্রান্ত রোগী সনাক্ত হওয়ার পর থেকে মানুুষের মনে এক প্রকার আতংক বিরাজ করছে। এ নিয়ে পাড়া-মহল্লায় চলছে তুমুল আলোচনা। বলতে গেলে এখন করোনা ভাইরাস টপ অব দ্য কান্ট্রিতে পরিণত হয়েছে। তবে দুঃখজনক হল বিষয়টিকে কেন্দ্র করে কতিপয় অসাধু ব্যবসায়ী বাণিজ্য করছে। ১০ টাকার মাস্ক বিক্রি করছে ১০০ থেকে ১৫০ টাকা পর্যন্ত। বেড়ে গেছে জীবাণু সরক্ষা হ্যান্ড ওয়াশের দাম। এই পরিস্থিতি আরও ভীতিকর অবস্থার সৃষ্টি করছে। তবে স্বাস্থ্য সচেতন হওয়াই এই রোগের প্রধান প্রতিষেধক।

এ ব্যাপারে জেলা প্রশাসক মোঃ কামাল হোসন বলেন, জেলার সার্বিক পরিস্থিতি সম্পূর্ণ স্বাভাবিক রয়েছে। উদ্বিগ্ন ও আতংকিত হওয়ার কোন কারণ নেই। কক্সবাজার জেলা প্রশাসন ও জেলা স্বাস্থ্য বিভাগ করোনা ভাইরাস রোগী সনাক্ত হলে তাদের চিকিৎসায় প্রয়োজনীয় সব ব্যবস্থা নিয়েছে। সংশ্লিষ্ট বিভাগকে সর্বোচ্চ সতর্ক অবস্থায় রাখা হয়েছে। বাংলাদেশ-মিয়ানমার সীমান্ত, টেকনাফ স্থলবন্দর, কক্সবাজার বিমানবন্দরেও প্রয়োজনীয় সব পদক্ষেপ কার্যকর রয়েছে। উখিয়া-টেকনাফের রোহিঙ্গা শরনার্থী ক্যাম্পগুলোতেও সেখানে কর্মরত আইএনজিও ও এনজিও সমুহের সহায়তায় করোনা ভাইরাস বিষয়ে সব ধরনের প্রাক প্রস্তুতি নেয়া হয়েছে। জেলা প্রশাসকের কার্যালয় ও সিভিল সার্জন অফিসে জরুরি নিয়ন্ত্রণ কক্ষ খোলা হয়েছে। করোনা ভাইরাস জীবাণু আক্রান্ত রোগীদের চিকিৎসায় রামু ও চকরিয়াতে ৫০ শয্যা করে ১শ’ শয্যার হাসপাতাল প্রস্তুত করে রাখা হয়েছে। জেলা প্রশাসনের নিয়ন্ত্রণ কক্ষের জরুরি মোবাইল ফোন নম্বর হলো : ০১৭২৮৮৮৯১৯২।

জেলা প্রশাসক আরও বলেন, সারাবিশ্বে করোনা ভাইরাসে আক্রান্ত রোগীদের মধ্যে মাত্র ২’৩% মারা গেছে। বাকীরা সব সুস্থ হয়ে গেছে। যারা মারা গেছে তাদের মধ্যে সকলের বয়স ৪০ বছরের উর্ধ্বে। এছাড়া মায়ানমারের সাথে চীনের সীমান্ত থাকায় টেকনাফ স্থলবন্দরে ২ টি বিশেষজ্ঞ মেডিকেল টিম সেখানে নিয়মিত কাজ করছে। করোনা ভাইরাস জীবানু শরীরে প্রবেশের ন্যুনতম ১৪ দিন পর সেটি সংক্রমিত হয়। ২৩ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রায় করোনা ভাইরাস জীবাণু মরে যায়। বাংলাদেশের সার্বিক তাপমাত্রা ক্রমান্বয়ে বাড়তে থাকায় এদেশের মানুষ করোনা ভাইরাস জীবাণুতে আক্রান্ত হওয়ার আশংকা খুবই কম।

এ প্রসঙ্গে হোপ হসপিটালের চীফ মেডিকেল অফিসার মোঃ শহীদুল ইসলাম বলেন, করোনা ভাইরাস এবং কক্সবাজার এটি একটি গুরুত্বপূর্ণ ইস্যু। কেননা রোহিঙ্গাদের সেবায় জাতিসংঘসহ বিশ্বের বহু সংস্থা নিয়োজিত হয়েছে। এসব সংস্থায় কাজ করছে বহু সংখ্যক বিদেশি। তারা যাওয়া-আসা করছে। এই কারণে কক্সবাজারই সবচেয়ে বেশি ঝুঁকিপূর্ণ। তাই এসব বিদেশীদের বিমান বন্দরেই কয়েকবার চেকআপ করা দরকার। সম্ভব হলে কক্সবাজারে প্রবেশের সময়ও চেকআপ করা দরকার।

ডা. শহীদুল ইসলাম আরও জানান, সরকার ইতিমধ্যে করোনা ভাইরাস প্রতিরোধে নানা উদ্যোগ নিয়েছে। এই মুহূর্তে প্রধান করণীয়, বিদেশ থেকে আসাদের নিবিড়ভাবে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করেই দেশে প্রবেশ করানো। পাশপাশি স্বাস্থ্য বিভাগকে প্রয়োজনীয় প্রস্তুত রাখতে হবে এবং জনসচেনতা বাড়াতে হবে। এই জন্য মসজিমের ইমাম, স্কুলের শিক্ষক এবং স্বেচ্ছাসেবক সংগঠনগুলোতে এই রোগ সম্পর্কে জনসচেতনতা তৈরি করতে হবে।

সদর হাসপাতালের আবাসিক মেডিকেল অফিসার ডাঃ শাহীন আবদুর রহমান বলেন, রোগটা যাতে সংক্রমণ হতে না পারে সে দিকে আমাদের লক্ষ্য রাখতে হবে। তার জন্য বিদেশ থেকে আসা মানুষগুলোকে নিবিড়ভাবে পরীক্ষা-নিরীক্ষা এবং পর্যবেক্ষণ করতে হবে। এটিই হবে প্রধান কাজ। পাশাপাশি সব সময় পরিস্কার-পরিচ্ছন্ন থাকতে হবে। কাশির সময় সতর্ক হতে হবে। খোলাভাবে কাশি দেয়া যাবে না। বাহুতে অথবা টিস্যু দিয়ে কাশি দিয়ে কাশির পর ভালোভাবে সাবান দিয়ে অন্তত ২০ সেকেন্ড পর্যন্ত হাত ধুতে হবে। খাবার আগে, বাথরুম ব্যবহারের পরে অবশ্যই হাত হাত ধুতে হবে। মাস্ক ব্যবহার করতে হবে। জনসমাগম স্থান এড়িয়ে চলতে হবে। প্রয়োজন না হলে ঘর থেকে বাইর না হওয়া ভালো। জ্বর-কাশি হলে পরীক্ষা করা হতে হবে এবং মাস্ক অবশ্যই পরতে হবে। নাকে হাত দেয়ার পর মুখে ও চোখে হাত দেয়া যাবে না। হ্যান্ডশেক ও কোলাকুলি এড়িয়ে চলতে হবে। প্রয়োজন না হলে বাইরে না যাওয়া ভালো হবে। যেহেতু এই রোগের এখনো ওষুধ আবিস্কার হয়নি তাই সতকর্তাই সর্বোত্তম উপায়!

জেলা সিভিল সার্জন ডাঃ মোঃ মাহবুবুর রহমান বলেন, করোনা ভাইরাস নিয়ে আতংকিত হওয়ার কিছু নেই। প্রতিরোধে সরকার ব্যাপক প্রস্তুতি গ্রহণ করেছে। কক্সবাজারেও জেলা স্বাস্থ্য বিভাগ বিভিন্ন পদক্ষেপ গ্রহণ করেছে। এছাড়া কক্সবাজার নিয়ে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের আলাদা নজরদারি রয়েছে।

কক্সবাজার জেলা প্রশাসক মোঃ কামাল হোসেন বলেন, করোনা ভাইরাস নিয়ে কোন ব্যক্তি বা মহল অহেতুক গুজব ছড়ালে তাদের বিরুদ্ধে কঠোর আইনানুগ ব্যবস্থা নেওয়া হবে। তিনি এক বার্তায় গুজবে কান না দিয়ে করোনা ভাইরাস সম্পর্কে সকলকে সচেতন হওয়ার জন্য অনুরোধ জানিয়েছেন।