মাহদী হাসান রিয়াদ

বন্ধু; খুব ছোট একটি শব্দ। এই শব্দে জড়িয়ে আছে নিঃস্বার্থ ভালোবাসা। ভালোলাগা। সুখ-দুঃখ ভাগাভাগি করে নেওয়া। সুসময়ে মিলেমিশে হাসা। ফের দুঃসময়ে একসাথে কাঁদা, কিংবা একে-অপরের চোখজল মুছে দেওয়া৷ বন্ধু শব্দের মাঝে আরো হাজারটা অর্থ নিহিত। যা হয়তো বলে শেষ করতে চাওয়াটা নেহাৎ বোকামি। এই ‘বন্ধু’ শব্দের সংজ্ঞা বলাটা অসাধ্য প্রায়। তাই অসাধ্যকে সাধন করার অপচেষ্টা না-করাটাই ভালো।

আমার ক্ষুদ্র জীবনে বন্ধু সেজে অনেকেই এসেছে। এসেছে না-বলে, না-কয়ে। ফের চলেও গিয়েছে একই স্টাইলে। ঠিক আসার সিস্টেমে। অবাক হয়নি মোটেও। জানতাম— তাদের প্রয়োজন মেটানোর জন্যই ক্ষণিকের এই আয়োজন। যা এখন মরিচীকার ন্যায় নিষ্ফল। বলাবাহুল্য যে— তারা চলে যাবার আগমুহূর্তে লম্বা-চওড়া একটি বাঁশ দিতে একদমই কৃপণতা করেনি। হয়তো উদারতার চরম দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছিল।

সবাই বলে— ‘আমি নাকি কৃপণ।’ নিজেকে নিজেও বলি— ‘ মন, তুই আসলেই কৃপণ।’ বাঁশ পাওয়ার পরও কৃপণতা করেছি তাদের সাথে। বন্ধু সেজে আসা সেই মেহমানদের সাথে। আমি ব্যর্থ হয়েছি বারংবার। অসংখ্য-অগণিত প্রশস্ত বাঁশ পেয়েও পারিনিই আস্ত লাটি দিয়ে তাদের উদারতাকে সম্মান জানাতে।

অসংখ্য বাঁশ পাওয়ার পর যখন হতাশ প্রায়, তখনই ঘটলো নতুন বন্ধুর আবির্ভাব। সে বলেকয়ে এসেছে। এসেছে অন্য ভাবে, প্রাক্তন বন্ধুদের চেয়েও ভিন্ন ভাবে। তখন ভেবেই নিয়েছিলাম— এই বন্ধু বোধহয় অতিথি বন্ধু নয়। মহাশূন্যে একা রেখে চলে যাবে না যখনতখন। সঙ্গী হিসেবে থাকবে আজীবন। এ বিশ্বাস সেদিন থেকেই ছিল, এখনো আছে। কিন্তু, আধমরা হয়ে!

দিনদিন মুগ্ধ হচ্ছিলাল তার প্রতি। তার কাজকর্মের প্রতি। তার চলনবলন একসময় আমাকে নিয়েগিয়েছিল মুগ্ধতার শেষ সীমানায়। বিশ্বাস করুন, মোটেও যেতে চাইনি আমি। তার ভালোবাসার জোর এতটাই প্রকট যে— যার ফলে একপর্যায়ে আমার মন বাধ্য হয়েছে একসাথে চলার। এভাবে ভালোবাসা বাড়তে থাকে। নিয়মিত ভালোবাসা আদানপ্রদান হত আমাদের মধ্যে। বড় আওয়াজে পাদ দিলেও শেয়ার করতাম তাকে। সে-ও তদ্রূপ এমনটা করত। বলতে পারেন ছোট্ট এক কুঁড়েঘরে দুই পাগলের বসবাস।

খুনসুটি যে হত না এমনটা কিন্তু নয়! নিয়মিত খুনসুটি হত। খুনসুটি লেগেই থাকত৷ কতশত বার যে আড়ি দিয়েছি, তার কোনো হিসাব নেই। কিন্তু মজার ব্যাপার হলো— আমাদের খুনসুটির স্থায়ীত্ব বলে কিছুই ছিল না। পাখিরা যেমন হুট করে উড়ে এসে ডালে বসে, আবার হুট করে উড়েও যায় খোলা আকাশে, ঠিক এমনই ছিল আমাদের খুনসুটি। মাত্র দু’মিনিট আগেও যে ঝগড়া করে ক্লান্ত হয়েছি, সেকথা মনেই থাকত না। ধুয়েমুছে ছাফ হয়ে যেত। একাউন্টিং নিয়ে অনার্স-মাস্টার্স করার তুমুল ইচ্ছা জেগেছে; নামকরা কোনো ব্যাংকের উচ্চপদস্থ ম্যানেজার হওয়ার জন্য নয়! আমরা যে কতবার আড়ি দিয়েছি, স্রেফ সে হিসাবটা মেলানোর জন্য।

চরম পর্যায়ের হিংসুটে পাবলিক আমি! ওর সাথে কেউ কথা বললে হিংসা হয় আমার। খুব জ্বলে। মন চাই গলাটিপে হত্যা করি লোকগুলো কে, তার নবাগত বন্ধুগুলো কে। দিন বাড়ার সাথেসাথে তার বন্ধু সংখ্যাও বাড়তে লাগল। অনেক বন্ধু হয়েছে এখন। চারপাশে বন্ধুতে ছেয়ে গিয়েছে। যা আমার জন্য নেতিবাচক! ভয় হত, তারা যদি আমাদের বন্ধুত্বের মাঝখানে ভাগ বসিয়ে দেয়? কিংবা বাঁধা হয়ে দাঁড়ায়? খুব ভয় হত এটা ভেবে! আস্তে আস্তে ভয়ের মাত্রা বাড়তে লাগল। অনেক অনেক বেড়েছেও বটে। অসয্য হয়ে ওঠলাম। একপর্যায়ে সহ্যসীমার বাইরে চলে যায়। এই অসয্যতা আমাকে মানসিক রোগী বানিয়ে ফেলে। নিয়মিত মানসিক টর্চার করতাম তাকে। অল্পতে রেগে যেতাম। শর্ত জুড়ে দিতাম হাজারটা। যা মেনে চলা কোনো সুস্থ মানুষের পক্ষে সম্ভব নয়। তবুও দিতাম।
নিশ্চয়ই ‘কারণ’ তল্লাশি করছেন আপনারা? কারণ তো একটু আগেই বললাম— বর্তমানে মানসিক রোগী আমি, সহজ ভাষায় যাকে বলা হয় পাগল। একজন পাগল তো এমন অস্বাভাবিক আচরণ করতেই পারে, খুব স্বাভাবিক। পাগলের কাছ থেকে এরচে’ ভালো কিছু আশা করাটা নেহাৎ বোকামি।

অস্পষ্ট কারণে কিছুদিন আগে তুমুল ঝগড়া হয়েছে তার সাথে! যা আমাদের বন্ধুত্বের জন্য কাল হয়ে দাঁড়িয়েছে আজ। একজন মানুষ আর কত অত্যাচার সয্য করবে? আর কত মেনে নিবে আমার উদ্ভট শর্ত? এসবের দোহাই দিয়ে সে-ও বিদায় নিয়েছে। বিদায় নিয়েছে চিরতরে! তবে, বলেকয়ে বিদায় নিয়েছে। চোরের মত নিশ্চুপে চলে যায় নি সে, গিয়েছে বীরের মতো। যাওয়ার সময় কি বলে গিয়েছে জানেন? বলেছে— সে নাকি মরে গিয়েছে। বেঁচে থেকেও নাকি আমার জন্য মৃত সে!