মুহাম্মদ আবু সিদ্দিক ওসমানী :

আজ রবিবার ৮ মার্চ ‘প্রজন্ম হোক সমতার, সকল নারীর অধিকার’ প্রতিপাদ্যকে সামনে রেখে পালন হচ্ছে আন্তর্জাতিক নারী দিবস। আর এ প্রতিপাদ্যকে সামনে রেখেই প্রশ্ন দাঁড়ায়, আইনে বঞ্চনার জায়গা রেখে কীভাবে সেই সমতায় প্রজন্ম পৌঁছাবে?

আন্তর্জাতিক নারী দিবসে কক্সবাজার জেলার বিচারবিভাগে কর্মরত ২ জন নারী বিচারকের গল্প বলবো-তাঁদের একজন হলেন  কক্সবাজার চীফ জুডিসিয়াল ম্যাজিস্ট্রেসীর অধীন ৪ নম্বর আদালতের সিনিয়র জুডিসিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট তামান্না ফারাহ্। বিচারক সিনিয়র জুডিসিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট তামান্না ফারাহ’র জন্ম চট্টগ্রাম শহরের আগ্রাবাদ এলাকায় ১৯৮২ সালের ৯ মে।
তামান্না ফারাহ চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন অনুষদের দশম ব্যাচের কৃতি ছাত্রী ছিলেন। প্রখর দূরদর্শী ও অত্যন্ত মেধাবী তামান্না ফারাহ্ সম্মান সহ এল.এল.এম পাশ করেছেন রেকর্ড সংখ্যক নম্বর পেয়ে। ছাত্রজীবনে প্রথম বেঞ্চের শিক্ষার্থী ছাড়াও তিনি তুখোড় বিতার্কিক ছিলেন। চট্রগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে তামান্না ফারাহ্ শ্রেষ্ঠ বিতার্কিক সহ জাতীয় পর্যায়ে বিতর্ক প্রতিযোগিতায় চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের গৌরবময় প্রতিনিধিত্ব করেছিলেন।

২০১০ সালে বাংলাদেশ জুডিসিয়াল সার্ভিস কমিশনের (বিজেএসসি) চতুর্থ ব্যাচে কৃতিত্বের সাথে উত্তীর্ণ হয়ে ২০১০ সালের ১৭ জানুয়ারী সহকারী জজ পদে সরকারি চাকুরী জীবন শুরু করেন। চাকুরী জীবনের প্রথম যোগদান মৌলভীবাজার জেলায় জুডিসিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট হিসাবে। এরপর সিনিয়র জুডিসিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট হিসাবে রাষ্ট্রপতি ও জাতীয় নেতা তৈরীর কারখানা হিসাবে খ্যাত কিশোরগঞ্জ জেলা জজশীপে সিনিয়র সহকারী জজ হিসাবে দায়িত্ব পালন করেন। ২০১৬ সালের ১১ ডিসেম্বর তামান্না ফারাহ কক্সবাজার চীফ জুডিসিয়াল ম্যাজিস্ট্রসীতে যোগ দিয়ে সিনিয়র জুডিসিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট হিসাবে কক্সবাজার-৪ নম্বর (সদর) আদালতের বিচারকের দায়িত্ব পাললন করছেন অদ্যাবধি। একজন দ্রুত বিচারিক সিদ্ধান্ত নিতে পারা ডায়নামিক বিচারক হিসাবে সকল কর্মক্ষেত্রে সুনাম রয়েছে সিনিয়র জুডিসিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট তামান্না ফারাহ্’র। নান্দনিক ও নিপুন অনুষ্ঠান উপস্থাপনায় সিনিয়র জুডিসিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট তামান্না ফারাহ্ এর জুড়ি মেলা ভার।

তামান্না ফারাহ্ জীবনসঙ্গী হিসাবে বেচে নিয়েছেন কক্সবাজার জেলা জজশীপের সিনিয়র সহকারী জজ (সদর) আলাউল আকবরকে। বিচারক আলাউল আকবর এবং তামান্না ফারাহ্ বিচারক দম্পতির মুকুট ও নুসাইবা নামক ফুটফুটে চোখ জুড়ানো ২ কন্যা সন্তান রয়েছে।

অপর নারী বিচারক হলেন  কক্সবাজার চীফ জুডিসিয়াল ম্যাজিস্ট্রেসীর অধীন ২ নম্বর আদালতের সিনিয়র জুডিসিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট জেরিন সুলতানা। বিচারক জেরিন সুলতানা চট্টগ্রাম জেলার রাউজান উপজেলার পূর্ব উরকির চর গ্রামের ঐতিহ্যবাহী লাল মিয়া চৌধুরী বাড়িতে ১৯৮৫ সালের ১৮ সেপ্টেম্বর জম্মগ্রহন করেন। তাঁর পিতা হচ্ছেন-মরহুম জামাল উদ্দিন চৌধুরী ও মাতা গুলনাহার। বিচারঙ্গনে অত্যন্ত সুনামের অধীকারী জেরিন সুলতানা চট্টগ্রাম সিটি বিশ্ববিদ্যালয় কলেজ থেকে এইসএসসি পাশ করেন কৃতিত্বের সাথে। এরপর চট্টগ্রাম প্রিমিয়ার বিশ্ববিদ্যালয় থেকে সফলতার সাথে এলএলবি অনার্স ও মাস্টার্স সম্পন্ন করেন।

খুবই দক্ষ ও মেধাবী বিচারক জেরিন সুলতানা বাংলাদেশ জুডিসিয়াল সার্ভিস কমিশন (বিজেএসসি) এর পঞ্চম ব্যাচের পরীক্ষায় অংশ নিয়ে কৃতিত্বের সাথে উত্তীর্ণ হন। অসাধারণ গৌরব অর্জন করেন বিচার বিভাগের একজন সদস্য হয়ে। বিচারক হয়ে সহকারী জজ হিসাবে প্রথম যোগদেন কুমিল্লা জেলা জজশীপে। এরপর সিলেট চীফ জুডিসিয়াল ম্যাজিস্ট্রেসীতে একজন জুডিসিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট হিসাবে এবং সিনিয়র জুডিসিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট হিসাবে সুনামগঞ্জ চীফ জুডিসিয়াল ম্যাজিস্ট্রেসীতে দায়িত্ব পালন করছেন সততা ও দক্ষতার সাথে। সর্বশেষ ২০১৮ সালের ১০ অক্টোবর তিনি সিনিয়র জুডিসিয়াল ম্যাজিষ্ট্রেট হিসাবে কক্সবাজার চীফ জুডিসিয়াল ম্যাজিস্ট্রেসীতে যোগদান করেন। দক্ষ ও মেধাবী বিচারক জেরিন সুলতানা তখন থেকে অদ্যাবধি কক্সবাজার চীফ জুডিসিয়াল ম্যাজিস্ট্রেসীর ২ নম্বর আদালতের সিনিয়র জুডিসিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট হিসাবে সফলভাবে দায়িত্ব পালন করছেন। বিচারক জেরিন সুলতানা সিনিয়র জুডিসিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট মোঃ দেলোয়ার হোসেন শামীমকে ২০১৩ সালের ১৮ অক্টোবর জীবনসঙ্গি হিসাবে বেচে নেন।
বিচারক জেরিন সুলতানা ও বিচারক মোঃ দেলোয়ার হোসেন শামীম দম্পত্তি ফুটফুটে প্রাণজুড়নো জুহাইরা হোসেন মেহরিস নামক এক কন্যা সন্তানের জনক ও জননী।

নারী পুরুষের ক্ষমতার সমতা বিধানে অনন্য দৃষ্টান্ত স্থাপন করছেন এই ২ নারী বিচারক। শুধু তাই নয়, একইসাথে এ দু’টি বিচারক দম্পতি পরস্পর স্বামী-স্ত্রী হওয়া সত্বেও একে অপরের পরিপূরক হিসাবে সবক্ষেত্রেই কাজ করে যাচ্ছেন কোন জেন্ডার ভেদাভেদ ছাড়াই। পূরুষ শাসিত এ দেশের দীর্ঘদিনের গড়ে উঠা সামাজিক সংস্কৃতি ও শিষ্টাচারে তাঁরা বিশ্বাসী ও অভ্যস্থ নয় মোটেও। নারীকেই শুধু গৃহস্থালির কাজ করতে হবে, সন্তানকে লালনপালন করতে হবে, অথচ সম্পদ অর্জিত হবে শুধু স্বামীর নামে, স্ত্রীর নামে নয়-এদেশে দীর্ঘদিনের গড়ে উঠা এমন কুসংস্কৃতি তাদের কাছে হার মেনেছে।

এই ২ বিচারক দম্পতি কর্মক্ষেত্রে নারী-পুরুষের ক্ষমতার সমতা বিধানের শুধু উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত নয়, কর্মক্ষেত্রে একই বিভাগে একই প্রকৃতির কর্মে নিরন্তর কর্মরত থাকা উদাহরণ যোগ্য দু’জন সফল নারী বিচারকও। এই ২ জন বিজ্ঞ নারী বিচারক নিজ নিজ কর্মক্ষেত্রে অসাধারণ প্রতিভার স্বাক্ষর রেখে চলছেন প্রতিনিয়ত। যেন সবার মাঝে “সেরাদের সেরা” হওয়ার নিরব এক প্রতিযোগিতা। অপ্রতিরোধ্য এ প্রতিযোগিতা যেন থামবার নয়। যাঁদের কর্মক্ষেত্র, সামাজিক ও পারিবারিক জীবন এদেশের মানুষকে প্রতিনিয়ত উৎসাহিত, প্রেরণা ও প্রত্যয়ে সমৃদ্ধ করছে। জীবনযুদ্ধে হার নামানা অদম্য গতিতে অবিচল এগিয়ে চলা এ ২ নারী বিচারক যেন আমাদের নতুন প্রজম্মের জন্য এক আদর্শ ও দুরন্ত সাহসের এক বাতিঘর।