মাহমুদ আহমদ

পবিত্র কোরআন মজীদে মহান আল্লাহতায়ালা বলেছেন, ‘নিশ্চয় আমি তোমাদের কোন কর্মনিষ্ঠ ব্যক্তির কর্মকে বিনষ্ট করবো না, তা সে পুরুষ হোক বা নারীই হোক’ (সুরা আলে ইমরান : ১৯৫)। এই আয়াত থেকে স্পষ্টই বুঝা যাচ্ছে, সৃষ্টিকর্তার কাছে আমলের দিক থেকে সবাই সমান। সে পুরুষ হোক বা নারী, তাতে কিছু যায় আসে না। একটু চিন্তা করুন, ইসলাম আবির্ভাবের পূর্বে নারীর মর্যাদা কিরূপ ছিল। পুরুষেরা নারীদের সঙ্গে অবাধ মেলামেশা করতো। নারী, মদ ও গান-বাদ্যের মহোৎসব করতো। সে যুগে কন্যা সন্তানের জন্ম হওয়াকে তারা অমর্যাদাকর ও চরম লজ্জাস্কর মনে করতো। নারীকে অস্থাবর সম্পত্তি জ্ঞান করা হতো। তাদের অধিকার বলতে কিছু ছিল না। কিন্তু মানবতার মুক্তির দূত, নবীকূল শিরোমনি হজরত মুহাম্মদ মুস্তফা (সা.)-এর আবির্ভাবে নারীরা তাদের যথাযোগ্য সম্মান ও মর্যাদা প্রাপ্ত হয়। আল্লাহতায়ালা তার (সা.) প্রতি অবতীর্ণ পূর্ণাঙ্গ ঐশীগ্রন্থ আল কোরআনে শিক্ষা দিলেন, ‘তারা তোমাদের জন্য একপ্রকারের পোশাক এবং তোমরাও তাদের জন্য এক প্রকারের পোশাক’ (সুরা বাকারা : ১৮৭)। এখন দেখুন, পোশাকের কাজ কি? পোশাকের কাজ হচ্ছে নগ্নতাকে ঢাকা। তাই আল্লাহতায়ালা বলেছেন, তোমরা স্বামী-স্ত্রী অবশ্যই একে অপরের দোষ-ত্রুটি ঢেকে রাখবে। কেননা পোশাক সৌন্দর্য্য বৃদ্ধির কারণও হয়ে থাকে। এখানে নারী-পুরুষকে একে অপরের সহযোগী আখ্যায়িত করা হয়েছে।

অন্যত্র আল্লাহতায়ালা বলেন, ‘তোমাদের স্ত্রীগণ তোমাদের জন্য ক্ষেত্র স্বরূপ’ (সুরা বাকারা : ২২৩)। একজন ভালো কৃষক যেভাবে সর্বদা নিজের মূল্যবান জমিনের হিফাযত করে, পরিশ্রমের মাধ্যমে জমিনের পরিচর্যা করে, জমিকে ক্ষতিকর পোকামাকড়ের হাত থেকে রক্ষা করে, তেমনিভাবে ইসলামের শিক্ষা হচ্ছে, পুরুষরা যেন জেনে রাখে নারীরা তোমাদের অমূল্য-সম্পদ। সঠিকভাবে তাদের হিফাযত করা, তাদের ভালোমন্দের দিকে দৃষ্টি রাখা এবং তাদের সাথে উত্তম দাম্পত্য-জীবন যাপন করতে যেন কোনো ত্রুটি না করে। নারীদের প্রতি উত্তম আচরণের ব্যাপারে মহানবী (সা.) বিশেষভাবে দৃষ্টি রাখতেন।

তিনিই (সা.) সর্বপ্রথম পৃথিবীতে নারীর উত্তরাধিকার কায়েম করেছেন। বস্তুত কোরআন করিমের মাঝেই ছেলেদের সঙ্গে মেয়েদেরও সম্পত্তির উত্তরাধিকার সাব্যস্ত করে দেয়া আছে। একইভাবে মায়েদেরকে, স্ত্রীদেরকে, কন্যাদের এবং স্বামীদের সম্পত্তির এবং বিশেষ অবস্থায় বোনদেরকে ভাইদের সম্পত্তির উত্তরাধিকার সাব্যস্ত করা হয়েছে। ইসলামের পূর্বে পৃথিবীর বুকে আর কোনো ধর্মই এভাবে নারীদের অধিকার প্রতিষ্ঠিত করেনি। একইভাবে তিনি (সা.) নারীদেরকে তার সম্পদের নিরংকুশ মালিকানা দান করেছেন। স্বামীর এই অধিকার নেই যে, স্বামী হওয়ার কারণে সে তার স্ত্রীর সম্পত্তিতে হস্তক্ষেপ করবে। নারী তার সম্পদ খরচ করার ব্যাপারে পূর্ণ স্বাধীনতা রাখে।

নারীদের আবেগ-অনুভূতির প্রতিও তিনি (সা.) যথেষ্ট খেয়াল রাখতেন। মহানবী (সা.) যখন কোনো সফরে যেতেন তখন মহিলারাও সঙ্গে থাকতেন, যার ফলে সকলকে তিনি ধীরে ধীরে চলতে বলতেন। একবার এরকম এক অবস্থায় যখন সৈনিকরা তাদের ঘোড়া ও উটগুলিকে লাগাম ঢিলা করে দিয়ে জোরে তাড়া করতে শুরু করলো, তখন তিনি বললেন, ‘আরে করছো কি তোমরা! কাঁচের প্রতি খেয়াল রেখো! কাঁচের প্রতি খেয়াল রেখো! অর্থাৎ, করছো কি! মেয়েরাও তো সঙ্গে আছে। তোমরা যদি এভাবেই উট দাবড়াতে থাকো তাহলে তো ঐ কাঁচগুলি ভেঙ্গে চুরমার হয়ে যাবে’ (বোখারি)। একবার এক যুদ্ধের ময়দানে বিভ্রান্তি সৃষ্টি হওয়ার কারণে উট ও ঘোড়াগুলোকে কিছুতেই বাগে আনা যাচ্ছিল না। রাসুল করিম (সা.) পর্যন্ত ঘোড়া থেকে পড়ে গিয়েছিলেন। অনেক মহিলাও পড়ে গিয়েছিলেন। এক সাহাবী পিছন থেকে রাসুল (সা.) এর সাহায্যের জন্য এগিয়ে এলেন। রাসুলুল্লাহর (সা.) পা তখনো রেকাবের মধ্যে আটকে ছিল এবং তিনি ঝুলন্ত অবস্থায় ছিলেন। তিনি (সা.) তাড়াতাড়ি পা ছাড়িয়ে নিজকে মুক্ত করলেন এবং ঐ সাহাবীকে লক্ষ্য করে বললেন, ‘আমাকে ছাড়ো, ঐদিকে, মেয়েদের দিকে যাও।’

রাসুল করিম (সা.) এর ওফাতের সময় যখন ঘনিয়ে এলো, তখন তিনি সব মুসলমানদেরকে একত্রে সমবেত করে যে সব ওসীয়্যত করেছিলেন, তার মধ্যে একটি কথা ছিল, ‘আমি তোমাদেরকে আমার শেষ ওসীয়্যত (উপদেশ) এই করছি যে, নারীদের সঙ্গে যেন সর্বদা উত্তম আচরণ করা হয়।’ তিনি একথাও প্রায়ই বলতেন যে, ‘যার ঘরে মেয়েরা আছে এবং সে তাদের লেখাপড়া শিখায়, এবং ভালোভাবে তরবিয়ত করে, খোদাতাআলা কেয়ামতের দিন তার জন্য দোযখ হারাম করে দিবেন’ (তিরমিযি)।

আরবদের মধ্যে সাধারণত এটি রেওয়াজ ছিল যে, স্ত্রীলোকেরা যদি কোন ভুল-ত্রুটি করতো, তবে তাদেরকে মারধোর করা হতো। মহানবী (সা.) যখন বিষয়টা জানতে পারলেন, তখন তিনি বললেন, ‘নারীরা আল্লাহতায়ালার দাসী, তোমাদের নয়। তাদেরকে কখনোই মারধোর করবে না।’ তিনি (সা.) আরো বলেন, ‘যে ব্যক্তি তার স্ত্রীর সঙ্গে ভালো ব্যবহার করে না, কিংবা তাকে মারধোর করে, তার সম্পর্কে আমি তোমাদেরকে বলে দিচ্ছি যে, সে খোদার দৃষ্টিতে সৎ বলে বিবেচিত হবে না।’ এ ঘোষণার পর নারীর অধিকার রীতিমত প্রতিষ্ঠিত হয়। মহানবী (সা.) এর অনুগ্রহে প্রথমবারের মতো নারীরা স্বাধীনতার স্বাদ গ্রহণ করে। (আবু দাউদ, কিতাবুন নিকাহ)। হজরত মাবিয়া আল কুশায়বি (রা.) বলেছেন, ‘আমি রাসুল করিম (সা.) কে জিজ্ঞেস করেছিলাম, হে আল্লাহর রাসুল! আমাদের ওপর স্ত্রীদের অধিকার কী?’ তিনি বললেন,‘খোদা তোমাকে যা খেতে দিয়েছেন, তা তুমি তাকে খেতে দাও, খোদা তোমাকে যা পড়তে দিয়েছেন তা তুমি তাকে পড়তে দাও, এবং তাকে থাপ্পরও মেরো না, গালিও দিও না। এবং তাকে ঘর থেকে বের করে দিও না’ (আবু দাউদ)।

মহানবী (সা.) বলেছেন, নারীদেরকে পাঁজড়ের হাড় থেকে সৃষ্টি করা হয়েছে। তুমি যদি একবারে এটিকে সোজা করতে যাও, তবে ভেঙে ফেলবে। অর্থাৎ তাদের স্বভাবে কিছুটা বক্রতা রাখা হয়েছে। কিন্তু এটিই নারীদের সৌন্দর্য্য। তাদেরকে যদি একবারেই সোজা অর্থাৎ সংশোধন করার চেষ্টা করা হয় আর সেজন্য আশোভন ও কঠোর পদ্ধতি অবলম্বন করা হয়, তবে সেটি কখনো সম্ভব হবে না। এভাবে সেই হাড় ভেঙে যেতে পারে, অর্থাৎ নারীরা বিগড়ে যেতে পারে। প্রেম-ভালোবাসা, সহনশীলতা ও পরস্পরের প্রতি শ্রদ্ধাবোধের মাধ্যমে ধীরে ধীরে তাদের সংশোধন করতে হবে।

ইসলাম এমন একটি পবিত্র-ধর্ম, যা নারী-পুরুষ প্রত্যেকের অধিকার খুব সুন্দরভাবে সংরক্ষণ করে এবং একটি সুন্দর সমাজ গঠনে নারী-পুরুষ উভয়ের অবদান রাখার কথা ঘোষণা করে। তাই একথা স্বীকার করতে হবে, ইসলামে মহানবী (সা.) নারীর যে মর্যাদা, অধিকার ও সম্মান প্রতিষ্ঠা করেছেন তা বিরল। একটি পরিবারে নারীর ভূমিকা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। সন্তানের লালন পালন, স্বামীর সেবা যত্ন, সর্বোপরি একটি পরিবারকে আগলে রাখে একজন নারী। আল্লাহতায়ালা আমাদের সকলকে নারীদের এ মর্যাদা উপলব্ধি করে সেটি রক্ষা করার সৌভাগ্য দান করুন।

লেখক : ইসলামী গবেষক ও কলামিস্ট