সিবিএন ডেস্ক:

বাংলাদেশের মুক্তি সংগ্রামের ইতিহাসে অনন্য দিন ৭ মার্চ, এইদিন রেসকোর্সের (বর্তমানে সোহরাওয়ার্দী উদ্যান) দিন। ফাগুনের উজ্জ্বল এই দিনে সকাল থেকেই দলে দলে জনতার ঢল নামে পথে। সবার আগ্রহের, আলোচনার, আর অপেক্ষার বিষয় ছিল— আজ বঙ্গবন্ধু কী বলবেন। সমবেত জনতা অপেক্ষা করেছেন সেই বিশেষ মুহূর্তের জন্য— বঙ্গবন্ধু হয়তো আজ কোনও যুগান্তকারী সিদ্ধান্ত ঘোষণা করবেন, যার পথ ধরে বাংলাদেশ নতুন দিনে উত্তরণের জন্য বেঁচে থাকার যুদ্ধে উদ্দীপ্ত হবে, গড়বে নতুন কোনওে ইতিহাস।

বঙ্গবন্ধু একাই বক্তা ছিলেন
দুপুর তখনও হয়নি। তার আগেই ময়দান লোকে লোকারণ্য। লাখো কণ্ঠে বজ্র শপথ নিয়ে সেদিন ঢাকার রেসকোর্স গর্জে উঠলো। অবিরাম স্লোগানে ফেটে পড়লো চারপাশ। সবার কণ্ঠে, ‘জয়বাংলা’, ‘বাংলাদেশ স্বাধীন করো’। পতাকা উড়ছে সেই সবুজের ভেতর লাল, আর তার মাঝে বাংলার মানচিত্র। সেদিন মাওলানা আব্দুর রশিদ তর্কবাগীশ কোরআন তেলোয়াত করেন এবং তাজউদ্দিন আহমেদ সভা শুরুর ঘোষণা দেন। বঙ্গবন্ধুই সেদিন একমাত্র বক্তা ছিলেন। বেলা তিনটা ২২ মিনিটে প্রথম বঙ্গবন্ধুর কণ্ঠ ভেসে এলো। সেই পরিচিত কণ্ঠস্বর ‘ভাইয়েরা আমার, আপনারা সবকিছু জানেন এবং বোঝেন। আজ দুঃখ ভারাক্রান্ত হৃদয় নিয়ে আপনাদের সামনে দাঁড়িয়েছি…’

বেতারে সম্প্রচার হয়নি
বঙ্গবন্ধু একে একে তার নির্দেশনা দিতে থাকেন। তিনি বক্তৃতা করে যাচ্ছেন, কখনও আবেগ, কখনও উত্তেজনায়, কখনও ক্ষুব্ধ, কখনও প্রতিশোধ স্পৃহায় দৃঢ়। আবার কখনও নির্দেশের সুরে বঙ্গবন্ধু বলে চলেছেন। সারা মাঠ নিশ্চুপ, নিরিবিলি। মাথার ওপরে টল দিচ্ছে জান্তার একটি হেলিকপ্টার। বক্তৃতার ফাঁকে বঙ্গবন্ধু জানালেন— এইমাত্র তিনি জানতে পেরেছেন, তার বক্তৃতা বেতার থেকে রিলে করা হচ্ছে না। বক্তৃতার মূল বক্তব্য ছিল ২২ মিনিটের। ঐতিহাসিক সেই বক্তৃতার সবচেয়ে তাৎপর্যপূর্ণ একটি অংশ ছিল— ‘এবারের সংগ্রাম মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম।’
বক্তব্যের মূল কথা
সেদিনের সেই বক্তৃতার একটি মূলকথা হলো— সামরিক শাসন তুলে নিতে হবে। বঙ্গবন্ধু একে একে দাবিগুলো জানাতে গিয়ে বলেন, ‘সেনাবাহিনীকে ছাউনিতে ফিরিয়ে নাও, ক্ষমতা হস্তান্তর করো। হত্যার তদন্ত করতে হবে। এরপর বিবেচনা করা হবে জাতীয় পরিষদে যাবো কিনা। রক্ত যখন দিয়েছি রক্ত আরও দেবো। এদেশের মানুষকে মুক্ত করে ছাড়বো ইনশাল্লাহ। তোমাদের যা কিছু আছে তাই নিয়ে প্রস্তুত থাকো। ঘরে ঘরে দুর্গ গড়ে তোলো। আর আমরা যখন মরতে শিখেছি তখন কেউ আমাদের দাবায়ে রাখতে পারবা না। এবারের সংগ্রাম মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম।’
যে বক্তব্যের অপেক্ষায় ছিল সবাই
মাঠ-ঘাট পেরিয়ে সবাই রেসকোর্সে হাজির হয়েছিল ‘এরপরে তারা কী করবে জানতে’। বঙ্গবন্ধু সেদিনের বক্তব্যে কতগুলো যুগান্তকারী নির্দেশনা দিয়েছিলেন, স্বাধীনতাকামী বাংলাদেশের জনগণের প্রতি। তিনি বলেন, ‘অসহযোগ শুরু। খাজনা-ট্যাক্স বন্ধ থাকবে। বেতার- টিভি আমাদের বক্তব্য প্রচার করবে। রেলওয়ে বন্দর চালু হবে। টাকা পশ্চিম পাকিস্তানে চালান দেওয়া যাবে না। প্রতিটি গ্রামে মহল্লায় আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে সংগ্রাম কমিটি গড়ে তুলতে হবে। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, সেক্রেটারিয়েট, সরকারি সব অফিস বন্ধ থাকবে। যেসব অফিস বন্ধ থাকবে, কর্মচারীরা মাসের শেষে বেতন নিয়ে আসবেন।’
যুদ্ধের দামামা বাজলো
প্রত্যেক ঘরে ঘরে দুর্গ গড়ে তোলার যে নির্দেশ, সেটিই সবাইকে প্রস্তুত করে তুলেছিল। বিকাল বেলা রেসকোর্সের মেলা ভাঙলো যখন, সবাই যেন শপথ নিয়ে ফিরছে। পত্রিকার সংবাদ বলছে, বাংলার মানুষ সেদিন রেসকোর্স থেকে অগ্নি শপথ নিয়ে এলো বঙ্গবন্ধুর কাছ থেকে। সবার মুখে মুখে একটি বাক্য, ‘এবারের সংগ্রাম মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম। পুরো যুদ্ধক্ষেত্রে এই ভাষণই ছিল মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য জীয়নকাঠির মতো।