জে. জাহেদ, চট্টগ্রাম:
চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের (চসিক) কাউন্সিলর পদে আওয়ামী লীগের বিদ্রোহী প্রার্থীদের সরিয়ে দেওয়ার মিশনে ব্যর্থ হয়েছেন কেন্দ্র থেকে দায়িত্ব পাওয়া নির্বাচন সমন্বয়কারী ও দলের প্রেসিডিয়াম সদস্য ইঞ্জিনিয়ার মোশাররফ হোসেন।

প্রায় তিন ঘণ্টা বৈঠক করে বিদ্রোহীদের বিরুদ্ধে ‘জিরো টলারেন্স’ ঘোষণা করেও কারও মন গলাতে পারেননি মোশাররফ। বরং বিদ্রোহীরা অভিন্ন সুরে নির্বাচনে আওয়ামী লীগের সমর্থন প্রত্যাহার করে কাউন্সিলর পদ উন্মুক্ত করে দেওয়ার দাবি জানিয়েছেন। বৈঠকের শেষ পর্যায়ে হট্টগোল শুরু হলে তড়িঘড়ি করে সভাস্থল ছেড়ে যান মোশাররফ।

বৃহস্পতিবার (৫ মার্চ) সকাল ১১টা থেকে দুপুর ২টা পর্যন্ত নগরীর থিয়েটার ইনস্টিটিউট মিলনায়তনে এ বৈঠক হয়েছে। বৈঠকে মোশাররফ ছাড়াও নগর আওয়ামী লীগের ভারপ্রাপ্ত সভাপতি মাহতাব উদ্দিন চৌধুরী, সহসভাপতি খোরশেদ আলম সুজন, সাধারণ সম্পাদক মেয়র আ জ ম নাছির উদ্দীনসহ জ্যেষ্ঠ নেতারা ছিলেন। আওয়ামী লীগের সমর্থন পাওয়া কাউন্সিলর প্রার্থী এবং বিভিন্ন ওয়ার্ডে সমর্থন অমান্য করে মনোনয়নপত্র জমা দেওয়া প্রার্থীরাও ছিলেন।

জানতে চাইলে খোরশেদ আলম সুজন বলেন, ‘বৈঠকে কোন ওয়ার্ডে কতজন প্রার্থী, দল কাকে সমর্থন দিয়েছে এবং বিদ্রোহী কারা সেটা নিয়ে পর্যালোচনা হয়েছে। কাউন্সিলর প্রার্থীরা যারা মূলত বিদ্রোহী হিসেবে মনোনয়নপত্র জমা দিয়েছেন, তারা বিভিন্ন অভিযোগ লিখিত আকারে জমা দিয়েছেন। মোশাররফ ভাই বলেছেন, সেটা তিনি কেন্দ্রে পাঠিয়ে দেবেন। এর বাইরে কোনো সিদ্ধান্ত হয়নি। সবাইকে দলের সিদ্ধান্ত মেনে মনোনয়নপত্র প্রত্যাহারের অনুরোধ করা হয়েছে। ৮ মার্চ আমাদের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের সাহেব আসবেন এবং বর্ধিত সভায় উপস্থিত থাকবেন। সেখানেও বিদ্রোহীদের বিষয়ে আলোচনা হবে।’

বৈঠক শেষে বেরিয়ে যাওয়া পথে আ জ ম নাছির উদ্দীন সাংবাদিকদের বলেন, ‘আমরা বিদ্রোহীদের বোঝানোর চেষ্টা করেছি। তাদের বলেছি, রাজনীতি করতে হবে নীতি-আদর্শের ওপর ভিত্তি করে। সাময়িক পাওয়া-না পাওয়াকে বিবেচনায় না নিয়ে দলের সিদ্ধান্ত মেনে রাজনীতি করাই একজন প্রকৃত রাজনৈতিক কর্মীর কাজ। দল যাদের মনোনয়ন দিয়েছে, তাদের মেনে নিতে হবে। তাদের জিতিয়ে আনতে হবে। দলকে এগিয়ে নিতে হবে।’

বৈঠকে উপস্থিত কয়েকজন নেতার সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, বৈঠকে কেবল ইঞ্জিনিয়ার মোশাররফ হোসেন এবং আ জ ম নাছির উদ্দীন বক্তব্য রাখেন। বৈঠকের শুরুতেই কয়েকজন বিদ্রোহী কাউন্সিলর পদ দলের সমর্থনের বাইরে রেখে উন্মুক্ত করে দেওয়ার দাবিতে স্লোগান দেন। এসময় মোশাররফ হোসেন তাদের শান্ত করেন। তিনি বলেন, ‘উন্মুক্ত করে দেওয়ার কোনো সুযোগ নেই। প্রার্থী পরিবর্তনেরও কোনো সুযোগ নেই। কারণ যাদের সমর্থন দেওয়া হয়েছে, তাদের সমর্থন দিয়েছেন জননেত্রী শেখ হাসিনা। নেত্রীর অর্ডার হচ্ছে, যাদের সমর্থন দেওয়া হয়েছে, তাদের অবশ্যই জিতিয়ে আনতে হবে।’

দলের সিদ্ধান্ত অমান্যের বিষয়ে জিরো টলারেন্সের ঘোষণা দিয়ে মোশাররফ বলেন, ‘৮ মার্চ আমাদের ওবায়দুল কাদের ভাই আসবেন। সেখানেও আলোচনা হবে। তবে কেউ যদি দলের সিদ্ধান্ত অমান্য করে তাহলে তাকে ছাড় দেওয়ার সুযোগ নেই। দলের পদ-পদবিতে থাকুক আর না-ই থাকুক, দলের নাম তারা কেউ ব্যবহার করতে পারবে না। দলের কোনো সুযোগ-সুবিধা তারা ভোগ করতে পারবে না। এ ব্যাপারে দলীয়ভাবে জিরো টলারেন্স অবস্থান থাকবে।’

মুজিববর্ষে চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের মেয়র এবং সব কাউন্সিলর পদ আওয়ামী লীগকে উপহার দেওয়ার জন্য সবার প্রতি আহ্বান জানান মোশাররফ।

বৈঠকে আ জ ম নাছির উদ্দীন বলেন, ‘যারা মনোনয়ন পাননি, তাদের মধ্যে হয়তো অনেকে যোগ্য আছেন। কিন্তু আমাদের মানতে হবে, দল যাদের যোগ্য মনে করেছে, তাদের মনোনয়ন দিয়েছে। মনোনয়ন বোর্ডের সিদ্ধান্ত চূড়ান্ত। নিজেকে বঞ্চিত মনে করার কোনো সুযোগ নেই। যারা আজ মনোনয়ন পাননি, আগামীতে নিশ্চয় তাদের মূল্যায়ন করা হবে। কিন্তু দলের সিদ্ধান্ত মেনে কাজ করতে হবে।’

বৈঠকের মধ্যে কয়েকজন কাউন্সিলর উত্তেজিত হয়ে বক্তব্য দেন। তবে বারবার অনুরোধের পরও একজনও তার প্রার্থিতা প্রত্যাহারের বিষয়ে বৈঠকে কোনো অঙ্গীকার করেননি।

বৈঠকের শেষ মুহূর্তে বিদ্রোহী প্রার্থীরা সমস্বরে ‘ওপেন, ওপেন’ বলে চিৎকার করতে থাকলে কিছুটা বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি হয়। এর মধ্যে মোশাররফ হোসেন দ্রুত বেরিয়ে গাড়িতে উঠে চলে যান। আ জ ম নাছির উদ্দীন বেরোনোর সময় তার গাড়ি আটকে রাখেন বিদ্রোহীরা। এসময় তারা আবারও ‘ওপেন, ওপেন’ বলে স্লোগান দিতে থাকেন।

চট্টগ্রাম নগরীর আন্দরকিল্লা, দেওয়ানবাজার ও চকবাজার নিয়ে গঠিত সংরক্ষিত ওয়ার্ডের তিনবারের কাউন্সিলর আনজুমান আরা বেগম এবার দলের সমর্থন পাননি। বিক্ষোভের মধ্যে তিনি সাংবাদিকদের বলেন, ‘নেত্রীর অগোচরে একটি মহল অজনপ্রিয় ও বিতর্কিতদের দলের মনোনয়ন এনে দিয়েছে। যোগ্য ও জনপ্রিয়দের বাদ দেওয়া হয়েছে। আমরা চ্যালেঞ্জ দিচ্ছি, ওপেন ইলেকশন হোক।’

১৯ নম্বর দক্ষিণ বাকলিয়া ওয়ার্ডের প্রার্থী আব্দুল মান্নান বলেন, ‘আমাদের ওয়ার্ডের কাউন্সিলর বিএনপির ইয়াছিন চৌধুরী আছু। এবার আওয়ামী লীগ থেকে সমর্থন পেয়েছে তার ভাই। উনি গতবার ইলেকশন করে ৯০০ ভোট পেয়ে তৃতীয় হয়েছিলেন। আমি সাড়ে তিন হাজার ভোট পেয়ে দ্বিতীয় হয়েছিলাম। আমি গত পাঁচ বছর বিএনপির কাউন্সিলরের বিরুদ্ধে এলাকায় লড়াই-সংগ্রাম করেছি। আমাকে মনোনয়ন দেওয়া হয়নি। আমরা বলছি, কাউন্সিলর পদে কাউকে সমর্থন দেওয়ার দরকার নেই। এটা ওপেন করে দেওয়া হোক।’

এদিকে মোশাররফ হোসেনের ডাকা বৈঠকে বিদ্রোহীদের নিয়ে কোনো সমঝোতা না হওয়ায় হতাশ হয়ে পড়েছেন আওয়ামী লীগের সমর্থন পাওয়া অনেক কাউন্সিলর প্রার্থী। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক কয়েকজন বলেন, ‘আমরা ভেবেছিলাম, আজকেই বৈঠকেই সমাধান হবে। কিন্তু একজনও দলের সিদ্ধান্ত মানছেন না। ৮ তারিখ ওবায়দুল কাদের ভাই আসবেন। সেদিন মনোনয়নপত্র প্রত্যাহারের শেষ দিন। আজ-কালের মধ্যে কোনো সমঝোতা না হলে ইলেকশন আওয়ামী লীগের জন্য কঠিন হবে। আমাদের মেয়র প্রার্থীর ওপরও এর প্রভাব পড়বে।’

আওয়ামী লীগ সমর্থিত বর্তমান কাউন্সিলরদের মধ্যে এবার ১৯ জন দলের সমর্থন পাননি। তাদের মধ্যে ১৮ জনই মনোনয়নপত্র জমা দিয়েছেন। ঘোষিত তফসিল অনুযায়ী আগামী ২৯ মার্চ চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশন নির্বাচনের ভোটগ্রহণ হবে।

বৈঠকে আরও ছিলেন চট্টগ্রামের সাংসদ এম এ লতিফ, নগর আওয়ামী লীগের সহসভাপতি নঈম উদ্দিন চৌধুরী, ইব্রাহিম হোসেন চৌধুরী বাবুল ও আলতাফ হোসেন বাচ্চু, কোষাধ্যক্ষ আবদুচ ছালাম, সম্পাদকমণ্ডলীর সদস্য চন্দন ধর, মশিউর রহমান ও প্রচার সম্পাদক শফিকুল ইসলাম ফারুক, মহিলা আওয়ামী লীগের সভানেত্রী হাসিনা মহিউদ্দিন।