মো: কামাল হোসেন 

কর্মস্থল কক্সবাজার। নানা প্রয়োজনে সভায় অংশগ্রহণের জন্য প্রায়শই ঢাকা যেতে হয়। ভরসা উড়োজাহাজ। সরকারের নির্দেশ মেনে চেষ্টা করি বাংলদেশ বিমানে যাতায়াতের। তবে সময় আর প্রয়োজনের হেরফেরে অন্য বিমানেও যেতে হয়। কক্সবাজারের মহেশখালীতে বাস্তবায়িত হচ্ছে মাতারবাড়ী কয়লা বিদ্যুৎ প্রকল্প, এলএনজি টার্মিনাল, এসপিএম প্রকল্প, চার চারটি অর্থনৈতিক অঞ্চল, দোহাজারী হয়ে কক্সবাজার রেল লাইন নির্মাণ ও সমুদ্র বন্দরসহ নানা উন্নয়ন প্রকল্প। টার্গেট হচ্ছে মহেশখালী হবে বাংলাদেশের পাওয়ার হাব, ভবিষ্যতের সিঙ্গাপুর। ২০৩০ সালের মধ্যে এ মহেশখালীই সরবরাহ করবে আঠার হাজারের অধিক মেগাওয়াট বিদ্যুৎ। এ প্রকল্প বাস্তবায়নে জমি অধিগ্রহণ করা হচ্ছে অনেক। আর স্বভাবতই পেশা বা কর্ম পরিবর্তন হয়েছে কিছুসংখ্যক মানুষের। তাদের জন্যে জমির ক্ষতিপূরণের সাথে সাথে রাখা হয়েছে পুনবার্সনের নানা ব্যবস্থা। কারণ, খোদ মাননীয় প্রধানমন্ত্রী বলেছেন কাউকে পেশাচ্যুত করে উন্নয়ন নয়। তিনি নিজেই সংশ্লিষ্ট সকলকে সুস্পষ্ট নির্দেশনাও দিয়েছেন এ বিষয়ে। মহেশখালী মাতারবাড়ী অবকাঠামো নির্মাণ সংক্রান্ত কমিটির এক সভায় মাননীয় প্রধানমন্ত্রী নির্দেশ দিয়েছিলেন মহেশখালী মাতারবাড়ী ছেলেমেয়েদের সেখানকার কর্ম অনুযায়ী দক্ষ করে গড়ে তুলতে বিশেষ প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করতে হবে। গড়ে তুলতে হবে বিশেষ কারিগরি প্রশিক্ষণ কেন্দ্র। যার ভার পড়েছে বিদ্যুৎ বিভাগের উপর। আর তার কনসেপ্ট পেপার প্রস্তুতের সভায় যোগদেয়ার জন্য নভোএয়ারের একটি এটিআর বিমানে কক্সবাজার থেকে ঢাকা যাচ্ছিলাম। বিমানে উঠেই আমার নির্ধারিত আসনের সামনের দুটো আসনে বাবা ছেলে বসা। মা তার বিপরীতে। চলন বলন কথনে মনে হলো সম্ভ্রান্ত শিক্ষিত পরিবার। শিশুটির বয়স পাঁচ/ছয় বছরের বেশী হবে না। ভীষণ চঞ্চল ও অস্থির প্রকৃতির। আমি বরাবরই এ জাতীয় অস্থির চঞ্চল শিশুদের পছন্দ করি। আমার দু’টো কন্যা সন্তানের মধ্যে ছোটটি এ প্রকৃতির। আর সবাই বলে তাকে আমি বেশী পছন্দ করি। বড়টি এর উল্টো হলেও আমার অন্তরের অন্য একটা জায়গা দখল করে আছে সে। পৃথিবীর সকল বাবা মার কাছে মনে হয় সেরকমই।

বিমানের আইলে (aisle)  দাঁড়িয়ে হ্যান্ড লাগেজটি ওভারহেড লকারে রাখার চেষ্টা করছিলাম। কিন্তু শিশুটির ছুটাছুটি অস্থিরতার কারণে পারছিলাম না। বাবা, মা প্রাণান্ত চেষ্টা করছিলেন তাকে সরাতে। আমি হাসিমুখে তাদেরকে ব্যস্ত হতে না বলে কোনমতে আমার লাগেজটি রাখছিলাম। বিমান ছেড়ে দিলে কিছুক্ষণ পর শিশুটি আমার উইন্ডো সিট বরাবর সামনের সীটে বসে পিছন ফিরে আমাকে দেখছিল। আমি তাকাতেই আবার সরেও যাচ্ছিল। আমি অভ্যাসগতভাবেই বিমান যাত্রার এ পঞ্চাশ-ষাট মিনিট সময় পত্রিকা পড়ে পার করি। যথারীতি তাতেই মনোনিবেশ করলাম।

কক্সবাজার-ঢাকা রুটে মাঝে মধ্যে গতিময় মেঘ প্রবাহ কিংবা দুর্যোগপূর্ণ আবহাওয়ায় ঝাকুনি অনুভুত হয়। তবে নভেম্বর-মার্চ সময়ে এটি কমই হয়ে থাকে। কয়েকবারতো এমন হয়েছিল যে, এখনই বিমান চুরমার হয়ে পড়ে যাবে। মাঝে মধ্যে পণ করে ফেলি এরপর সড়ক পথেই যাতায়ত করব। কিন্তু তা কী সম্ভব। কক্সবাজার-ঢাকা ৩৯৮.৩ কিলোমিটার পথ। যানজট আর সর্পিল গতিপথের কারণে সড়ক পথে পাড়ি দিতে সময় লাগে দশ-বার ঘন্টা। তাই বহুবার পণ করলেও গত দু’ বছরে একবারও তা সম্ভব হয়নি। মাসে এক দু’বার চট্টগ্রামে সভায় যোগদান করতে হয়। দেড়শ কিলোমিটার এ সপিল পথ পাড়ি দিতে সময় লাগে তিন-চার ঘন্টা। শতাধিক বাঁকের গতিপথের ভ্রমনে শরীর অবসাদগ্রস্ত, ক্লান্ত হয়। অবশ্য অপেক্ষায় আছি দোহাজারী কক্সবাজার ঘুনধুম রেল লাইন নির্মাণের কাজ কবে শেষ হবে। এডিবির অর্থায়নে ইতোমধ্যে কাজ শুরু হয়েছে। ২০২৪ সাল নাগাদ আশা করা যায় সহজলভ্য, আরমদায়ক মধ্যবিত্তের এ বাহনটি আমাদের স্বপ্ন পূরণ করবে। রেল চালু হলে, কক্সবাজারে পর্যটকদের আনাগোনা বাড়বে বহুগুনে। পাইলট ঘোষণা করছিলেন কেবিন ক্রু প্রিপার ফর ল্যান্ডিং। এ সময় আবারও বিমানে কিছুটা বাম্পিং হচ্ছিল।

বিমানের পুরুষ কেবিন ক্রু দেখছিল সবার সিট বেল্ট বাঁধা আছে কিনা। আমার সামনে বসা শিশুটিকে তার মা বার বার চেষ্টা করছিল নির্ধারিত সীটে বসানোর এবং সীট বেল্ট বাঁধার। কিন্তু একেবারেই পারছিলেন না। শিশুটি চিৎকার করে কাঁদছিল। সে কোনমতেই সীটে বসবে না, হাটাহাটি করবে। ক্রু বলছিল, “ম্যাম আপনার কোলে নিয়ে সীট বেল্ট বাঁধুন।” ভদ্র মহিলা বলছিলেন, “চেষ্টাতো করছি, পারছি না।” “ম্যাম বাম্পিং হচ্ছে, ওর সিকিউরিটির জন্য সীট বেল্ট বাঁধতেই হবে” কেবিন ক্রু বলছিলেন। নিরুপায় হয়ে ভদ্র মহিলা বলছিলেন দেখুন, আমার সন্তান স্পেশাল চাইল্ড, বোঝার চেষ্টা করুন। শিক্ষিত, লম্বা সুদর্শন ক্রু অনেকটা বিরক্ত হয়ে বলছিলেন, “ম্যাম স্পেশাল চাইল্ড দ্বারা কি বুঝাতে চাচ্ছেন? বুঝলাম না। তাকে তো সীট বেল্ট বাঁধতেই হবে! বাম্পিং হচ্ছে।” তখন সন্তানকে কোলে জড়িয়ে শক্ত করে ধরলেন মা। অসহায়ত্বের বিষন্নতায় আচ্ছন্ন মায়ের দিকে তাকিয়ে ছিলাম। কেবিন ক্রু না পেরে চলে গেলেন। পরপরই চলে আসলেন সুদর্শিনী, সুহাসিনী, সুনয়না অপর কেবিন ক্রু বললেন, “আপনার শিশুকে সীট বেল্ট বাঁধতে হবে। আমরা অস্বস্তিতে আছি।” ভদ্র মহিলা তারপরও বললেন, “আমার বাচ্চাতো স্পেশাল চাইল্ড, সীট বেল্ট পরানো অসম্ভব আপু।” বিরক্ত হয়ে সেও চলে গেল। স্পেশাল চাইল্ড বলাতে আমি একটু বিশেষ মনোযোগী হলাম পুরো ঘটনার প্রতি। এ বিশেষ শিশুদের ভালোবেসেই কক্সবাজারে প্রতিষ্ঠা করেছি ‘অরুণোদয়’। শিশুটি কোন মতেই বসতে চাচ্ছিল না; দাঁড়াবে হাটবে। মা তাকে জোড়ে বুকে চেপে ধরে অপলক দৃষ্টিতে সামনে চেয়েছিলেন। লক্ষ্য করলাম দু’চোখ অশ্রুসিক্ত, গড়িয়ে পড়ছে পাহাড়সম কষ্টের নোনাজল। অনুভব করলাম কত দুর্ভাগ্য আমাদের স্পেশাল চাইল্ড এর মানে কি তাও অনেকে জানি না এখনও। মনের গহীনে ভীষণ কষ্ট অনুভব করছিলাম, একজন মায়ের চরম অসহায়ত্ব দেখে মনে মনে বলছিলাম, ক্ষমা করুন আমাদের। আমরা এখনও বুঝাতে পারেনি বিশেষ শিশুর মানে কি? বিমানের মত একটি পরিবহনের শিক্ষিত, সুদর্শন, স্মার্ট তরুণরাই বুঝতে পারেনি বিশেষ শিশু কী? আর তাই চোখের জল ফেলে অনেকটাই আমাদের প্রতি সকল ব্যাথা, সকল কষ্ট, সকল ক্ষোভ প্রকাশ করছিলেন।

অথচ গণপরিবহনে বিশেষ শিশুদের জন্য বিশেষ ব্যবস্থা থাকার কথা ছিল, বিশেষ সীট সংরক্ষিত রাখার কথা ছিল। প্রতিবন্ধি ব্যক্তির অধিকার ও সুরক্ষা আইন, ২০২৩ এর ৩২(১) ধারায় যেমন বলা হয়েছে, ‘‘আপাতত বলবৎ অন্য কোন আইনে যাহাই থাকুকনা কেন, সরকার কর্তৃক সরকারি গেজেট প্রজ্ঞাপন ধারা নির্ধারিত সময় সীমার মধ্যে সকল গণপরিবহনের মালিক বা কর্তৃপক্ষ তৎ পরিবহনের মোট আসন সংখ্যার শতকরা পাঁচ ভাগ আসন প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের জন্য সংরক্ষিত রাখিবেন।” আর গণপরিবহন বলতে স্থল, জল ও আকাশপথে ভাড়ার বিনিময়ে যাত্রী পরিবহন করে এমন সকল সাধারণ পরিবহনকেই বোঝানো হয়েছে। বাংলাদেশের প্রতিটি গণপরিবহনে শতকরা পাঁচ ভাগ সীট বিশেষ চাহিদা সম্পন্ন মানুষের জন্য সংরক্ষিত থাকার কথা থাকলেও তার বাস্তবায়ন আদৌ চোখে পড়েনি। কক্সবাজারে তা বাস্তবায়নের উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়েছে। আমাদের অভ্যন্তরীন চলাচলের বিমানগুলো বিশেষ চাহিদা স¤পন্ন শিশুদের জন্য আলাদা সিট/স্পেস বরাদ্দ রাখে না। এমনকি বাস, লঞ্চ, ট্রেন কোন গণপরিবহনেও তা নিশ্চিত করা যায়নি। এ আইন অমান্য করলে রয়েছে শাস্তিরও ব্যবস্থা। সহকর্মী মাসুদ বলছিলেন, একসময় ঢাকা-নারায়নগঞ্জ রুটের শতিল পরিবহনে কয়েকটি সীট সংরক্ষিত ছিল। একদিন এক যাত্রী বাসে উঠেই সে সংরক্ষিত সীটে বসে পড়ছিলেন। সহযাত্রী একজন প্রতিবাদ করলে তিনি বলে বসলেন “আমি নিজেই প্রতিবন্ধী” গা বাঁচাতে মিথ্যার আশ্রয় নিতেও দ্বিধান্বিত হননি। অর্থাৎ যাত্রী হিসেবে আমরাও সচেতন নই, প্রস্তুত নই প্রতিবন্ধী মানুষের অধিকার সুরক্ষায়। তাই গণপরিবহন সংশ্লিষ্টদের সাথে সাথে সাধারন মানুষকেও সংবেদনশীল করার কার্যকরী উদ্যোগ নিতে হবে।

এ সংক্রান্ত আইনের ৩২ (২) ধারায় বলা হয়েছে, “কোন গণপরিবহন মালিক বা কর্তৃপক্ষ বর্ণিত আসন সংখ্যা নির্ধারিত না রাখলে কিংবা কোন গণপরিবহনের চালক, সুপারভাইজার বা কন্ট্রাক্টর কোন প্রতিবন্ধী ব্যক্তিকে সংরক্ষিত আসনে আসন গ্রহণ করতে সহায়তা না করলে বা আসন গ্রহণ করতে বাঁধার সৃষ্টি করলে এ আইনে গঠিত কমিটি সত্যতা নিরুপনপূর্বক উক্ত পরিবহনের রেজিস্ট্রেশন বাতিল কবিরার জন্য যথাযথ কর্তৃপক্ষকে সুপারিশ প্রদান করবেন।” এর ব্যত্যয় পরিলক্ষিত হলেও এর প্রয়োগ হয়েছে সম্ভবত এমন একটি নজিরও জানা নেই। জেলা প্রশাসকরা সকলকে নিয়ে জেলায় জেলায় প্রতিবন্ধিদের জন্য গণপরিবহনে তার মোট আসনের শতকরা পাঁচভাগ আসন সংরক্ষিত রাখা এবং তৎস্থলে এ জাতীয় পরিবহন সংশ্লিষ্টদের প্রতিবন্ধিতা সম্পর্কে সচেতনতা বাড়াতে প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা গ্রহণ করতে পারেন।

আমাদের দেশে কোনও গণপরিবহনে বিশেষ করে বাস, ট্রেন, লঞ্চে প্রতিবন্ধী মানুষের আসন সংখ্যা নির্ধারিত রাখার নজির দেখা যায় না। বিমানতো আরও উচ্চমার্গের বিষয়। শুধু সীট বরাদ্দ নিশ্চিত করলেও তাও যথেষ্ট হবে না। গণপরিবহনে সেবাদানের সাথে কর্মরত সকলের প্রতিবন্ধি মানুষ, তাদের অধিকার সম্পর্কে ধারণা যে একেবারেই সীমিত তা বিমানের কেবিন ক্রুর কথায় সহজেই অনুমেয়। অল্প শিক্ষিত বা অশিক্ষিত গণপরিবহন সংশ্লিষ্ট অন্যান্যদের ক্ষেত্রে তাতো আরও প্রকট। প্রতিবন্ধিতা সম্পর্কে এদের সকলকে সাধারন ধারনা, তাদের অধিকার সংরক্ষণ বিষয়ে প্রতিষ্ঠানিক প্রশিক্ষণ প্রয়োজন। এদের লাইসেন্স প্রদানের ক্ষেত্রে এ বিষয়ে প্রশিক্ষণের বাধ্যবাধকতা করা যায় কিনা তা ভেবে দেখা দরকার। গণপরিবহনের সাথে সংশ্লিষ্টদের কিভাবে এ সম্পর্কে প্রতিষ্ঠানিক প্রশিক্ষণের মাধ্যমে বিশেষ চাহিদা সম্পন্ন শিশু ও অন্যান্যদের প্রতি সংবেদনশীল করা যায় তার উদ্যোগ গ্রহণ করা জরুরী। না হয় প্রতিবন্ধিতায় আক্রান্ত দেশের প্রায় শতকরা দশভাগ মানুষতে উন্নয়নের মূলশ্রোতে আনা শুধুই কথার কথা থেকে যাবে, আর আনতে না পারলে ২০৩০ সালের মধ্যে টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা অর্জন কষ্টসাধ্য হবে। টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যের অন্যতম দর্শন হচ্ছে- No one will be left behind অর্থাৎ কাউকে পেছনে ফেলে উন্নয়ন নয়। টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্য একটি সর্বাত্নক উন্নয়ন ধারণা। প্রতিবন্ধিরা যদি উন্নয়ন থেকে বঞ্চিত হয় তবে টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্য সুদুরপরাহত থেকে যাবে। রবীন্দ্রনাথ যথাযর্থই বলেছেন- ‘যারে তুমি নিচে ফেল সে তোমারে বাঁধিবে যে নিচে, পশ্চাতে রেখেছ যারে সে তোমারে পশ্চাতে টানিছে।’ একজন বিশেষ শিশুর মা-বাবাই জানেন এবং বোঝেন তাঁদের কষ্টের গভীরতা কত বিস্তৃত। প্রতিদিন এ ধরনের কত মায়ের ভালবাসার প্রকাশ কষ্টের নোনাজলে প্রকাশ পায়।

 

মো: কামাল হোসেন
জেলা প্রশাসক, কক্সবাজার