সিবিএন ডেস্ক:

সুখের কোনো বিশেষায়িত সংজ্ঞা নেই। একে ধরা যায় না, ছোঁয়া যায় না। অনেকটাই উপলব্ধির বিষয়। আমরা কি আসলেই সুখী হতে চাই? হয়তো সারাজীবন এ প্রশ্ন থেকেই যাবে। তাতেও প্রকৃত সুখ খুঁজে পাওয়া যাবে না। সুখ খুঁজতে গিয়ে হয়তো অসুখেও ভুগতে হতে পারে।

যদি ছোটবেলায় ফিরে যাই, তবে আমরা এভাবে সুখ খুঁজতাম। যখন স্কুলে যেতাম; ঠিক তখন মনে হতো পৃথিবীর সব সুখ মনে হয় আমাদের। সকালে ঘুম থেকে উঠে গ্রামের মাঠ চষে বেড়ানো। স্কুলে গিয়ে বন্ধুদের সাথে আড্ডা। স্কুল পালানোর পায়তারা। পকেটে সামান্য দু’-চারটি টাকা হলে বুক ফুলিয়ে বলা, ‘আজ সারাটা দিন আমার’। বাটার বন আর বাকি টাকা দিয়ে বুট-বাদাম খেয়ে বন্ধুদের সাথে জম্পেস আড্ডা দেওয়া। আহা, স্কুল পালানোর দুরন্তপনা অসাধারণ এক সুখকর স্মৃতি।

চাহিদা বলতে কোনো একটি মাঠে খেলতে পারলেই চাহিদার ষোলোকলা পূর্ণ হতো। প্রয়োজন ছিল না দামি শার্ট, দামি প্যান্ট, আধুনিকতার ছোঁয়াও গায়ে লাগেনি। নাড়া (খড়) ক্ষেতে বিকেল বেলা খেলতে পারার মাঝেই লুকিয়ে ছিল সব সুখ। ছিল না কে ধনি, কে গরিব- তার বৈষম্য। বন্ধু-বন্ধুই। ছিল না কোনো প্রেসটিজ ইস্যু। শিক্ষিত-মূর্খ ছিল না বিভেদ। কার কোন ধর্ম, তা নিয়েও ছিল না মাথাব্যথা।

গাদা গাদা বই পড়ার এত সময় ছিল না। প্রকৃত সুখ তো খুঁজে পেতাম সবুজ-শ্যামল মাঠের বুকে ঘুরে বেড়ানোয়। বর্ষায় কাঁদাযুক্ত মাঠে ফুটবল নিয়ে মেতে ছিলাম। বাড়ি থেকে বলতে হয়নি পড়তে বসো। ইচ্ছে হলে পড়তাম, না হলে দূর ছাঁই, এত সময় কই? লুকোচুরি খেলতাম আমার এক প্রিয় বন্ধু আলমগীরের (চিকু) সাথে। আলমগীর লেখাপড়া না করলেও সে তো আমার খেলার সাথী। বয়সে হয়তো কিছুটা ছোট, তাতে কি? আমরা তো খেলায় আনন্দ খুঁজতাম। সুতরাং আমরা সমান-ই। সমান চোখে দেখতাম।

sukh-in1

কে এতো বড় হতে চায়? বড় বড় মানুষ হলে না-কি সুখ বেশি। লোকের মুখে শুনতাম। তবে আবার ভাবনার জগতে ছুটে গেলে নিজে নিজে বলতাম, ‘অত বড় হয়ে কী হবে? সুখ তো ওই গাঁয়ে, হারিকেনের আলোর মাঝে লুকিয়ে আছে।’ দিন দিনই বড় হচ্ছি, সুখগুলো লুকাচ্ছে। আহা, আবার ভাববেন না যেন অর্থ-বিত্তে বড় হচ্ছি। বয়স বাড়ছে এই আর কি।

তবে সে সুখ এখন আর খুঁজে পাই না। সেই দুরন্তপনা এখন আর আমাকে ডাকে না। চারিদিকে শুধু স্বার্থপরতার গল্প। কে কাকে ঠকিয়ে বড় হবে সে চিন্তায় ব্যস্ত। প্রজন্ম তৈরি হচ্ছে, একা খাও-একা বাঁচো নীতিতে। আর হবেই বা না কেন?

সেদিন দেখলাম, এক ভদ্রমহিলা তার সন্তানকে স্কুলের গেইটে দাঁড়িয়ে বলছে- ‘শোন, গতকাল তোর খাবার ওরা খেয়ে ফেলেছে। আজ ভুলেও ওদের খাওয়াবি না। একা খাবি।’ আমি ভাবলাম, আহা রে! ছেলেটার সুখগুলো সব ধুলায় মিশিয়ে দিলো। বয়সে বড় হয়ে সে যখন বড় কোনো অফিসার হবে, তখন সে একা খাও-একা বাঁচো নীতিই অনুসরণ করবে। দূর ছাঁই, আমি তো সুখী।

কিছুদূর যাওয়ার পরই দেখলাম আরেক দৃশ্য। সন্তানকে একজন শেখাচ্ছেন, যার-তার সাথে বন্ধুত্ব করবি না। যে দেখবি ভালো পড়া পারে, তাকে বন্ধু বানাবি। আহা রে, বেচারার সুখটা মাটিতে মিশিয়ে দিলো। সব পড়া পারা বন্ধু কি ভালো বন্ধু হতে পারে? শেষ বেঞ্চের শিক্ষার্থীও তো ভালো বন্ধু হতে পারে। আর যা-ই হোক, সে কিন্তু সারাদিন পড়ালেখা নিয়েই ব্যস্ত নয়, সে জিপিএ-৫ নয়, সে কোনরকম পাসের জন্যই ছোটে। অন্ততপক্ষে প্রতিযোগিতা করতে গিয়ে অন্যায় পথ তো সে অবলম্বন করবে না।

sukh-in1

আচ্ছা, এ যুগে মানুষ সুখ কোথায় খোঁজে? দিন দিন আমি কেমন যেন সুখ খুঁজতে গিয়ে অসুখে ভুগছি। সবাই বলে ভালো একটি চাকরি করলে নাকি ঘরে সুখ আসবে। চাকরিটা হতে হবে সরকারি। আচ্ছা, তবে কি সোনার হরিণ পেলে সুখ মিলবে?

দূর, কে এসবে সুখ খোঁজে। আমি তো সুখ খুঁজি মনের ভেতরে। আমি তো সুখ খুঁজি মানুষের মাঝে। আমি তো সুখ খুঁজি অন্যের চোখের জল মুছে দেওয়ার মাঝে। আমি তো সুখ খুঁজি অনাহারীর মুখে দু’মুঠো অন্ন জোটানোর মাঝে। আমি সুখ খুঁজি ভালোবাসার মাঝে, প্রকৃতির মাঝে।

রবীন্দ্র কিংবা নজরুল নয়, আমি ‘আমিই’ হতে চাই। এর মাঝেই সুখের সন্ধান করি। লোকে পাগল বলবে, বলুক না। তাতে কী! পাগলের সুখ তো মনে মনে। আচ্ছা একবার ভাবুন তো, আপনি বড় অফিসার। জীবনে অনেক বড় কিছু হয়ে গেলেন। গাড়ি-বাড়ি সব কিছুই দামি আপনার। দুর্ভাগ্য আপনি সময়ের জন্য প্রকৃতির আলো-বাতাসের সংস্পর্শে আসতে পারছেন না। এতটাই ব্যস্ত যে, আপনি রক্ত-মাংসে গড়া মানুষ; সেটাই ভুলে যান মাঝে মাঝে। তবে কি এতে সুখ মেলে?

আমি সুখ দেখেছি একজন দিনমজুরের মাঝে। সারাদিনের তীব্র খাটুনির পর রাতে নুন-ভাত খেয়ে শান্তির ঘুমে আচ্ছন্ন সে। জীবনের প্রকৃত সুখ তো তার কাছে। গাড়ি-বাড়ি দামি না হলেও মিষ্টি ঘুম ধরা দিচ্ছে তার কাছে। পাড়া-প্রতিবেশীর খবরও নিতে পারছে। প্রকৃত সুখ তো তার কাছেই ধরা দিয়েছে। আপনি তো কৃত্রিম সুখের পেছনে ছুটছেন।

সুখ খুঁজতে অনেকেই বিলেতে পারি জমান। সেখানে গেলে না-কি সুখ পাওয়া যায়। মস্ত মস্ত দালানের ভিড়ে সত্যিই কি সুখের সন্ধান মেলে? কামীনি রায় ‘সুখ’ কবিতায় লিখেছেন-
‘নাই কিরে সুখ? নাই কিরে সুখ?
এ ধরা কি শুধু বিষাদময়?
যাতনে জ্বলিয়া কাঁদিয়া মরিতে
কেবলি কি নর জনম লয়?’
প্রকৃত সুখী মানুষ তো সে, যে কি-না নির্মল বাতাসের মাঝে দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলতে পারে- ‘আমি ভালো আছি, তুমি ভালো থেকো।’

sukh-in1

তবে এ ভালো থাকার মানুষগুলো দিন দিনই যান্ত্রিকতার ছোঁয়ায় হারিয়ে যাচ্ছে। এখন আর কেউ কৃষক হতে চায় না, শ্রমিক হতে চায় না, থাকতে চায় না গ্রামে। শহরের টানে, জীবিকার সন্ধানে ছুটে যায় ইট-পাথরের শহরে। সেখানে সুখের সন্ধান করতে গিয়ে অসুখের তাড়নায় ধুঁকে ধুঁকে মরতে হয়।

তবু লোকে সুখ খোঁজে। ভালোবাসায়ও সুখ আছে। সে সুখ খুঁজতে গিয়ে মান্না দে গেয়েছিলেন, ‘সবাই তো সুখী হতে চায়/তবু কেউ সুখী হয়, কেউ হয় না/জানি না লোকে যা বলে, সত্য কী না/কপালে সবার নাকি সুখ সয় না/সবাই তো সুখী হতে চায়।’

ভালোবাসার মাঝে যে সুখ লুকিয়ে আছে, তা-ও স্বার্থপরতার কাছে মাঝে মাঝে হার মেনে যায়। কখনো সংসারে অভাব, কখনো বা চাহিদা মেটানোর তাগিদ। সব মিলিয়ে হাঁপিয়ে ওঠা এক জীবন। যে জীবনে সুখের চেয়ে দুঃখের ঘানি বেশি টানতে হয়। অতঃপর যখন সুখ এসে সত্যিই ধরা দেয়, ঠিক তখন নতুন কোনো অসুখে সেই সুখটাও বিনষ্ট হতে চলে। সুখ খোঁজার জন্য দুঃখকে বরণ করতে যেন মহাব্যস্ত গোটা পৃথিবী।

গোটা পৃথিবী এখন বৈষম্যের চাদরে ঢাকা। যে যেভাবে পারছে; সেভাবেই বৈষম্যের সৃষ্টি করছে। সুখের সন্ধান করতে গিয়ে অন্যের জান-মাল নিয়েও ছিনিমিনি খেলছে। নীতি-নৈতিকতার বড়ই অবক্ষয়। সবাই শুধু গাড়ি-বাড়ির পেছনে ছুটতে গিয়ে সত্যিকারের সুখটাকে জলাঞ্জলি দিচ্ছে। তবু আমরা সুখের জন্য দুঃখের বীণায় সুর তুলছি অবিরত। তবুও বসুন্ধরায় নেমে আসুক সুখ- এমনটাই এখন স্রষ্টার কাছে প্রার্থনা।