বিবিসি বাংলা

দু’হাজার চার সালে বিবিসি বাংলা একটি ‘শ্রোতা জরিপ’-এর আয়োজন করে। বিষয়টি ছিলো – সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালি কে? তিরিশ দিনের ওপর চালানো জরিপে শ্রোতাদের ভোটে নির্বাচিত শ্রেষ্ঠ ২০জনের জীবন নিয়ে বিবিসি বাংলায় বেতার অনুষ্ঠান পরিবেশিত হয় ২০০৪-এর ২৬শে মার্চ থেকে ১৫ই এপ্রিল পর্যন্ত।

বিবিসি বাংলার সেই জরিপে শ্রোতাদের ভোটে শ্রেষ্ঠ বাঙালির তালিকায় ১৯তম স্থানে আসেন জেনারেল জিয়াউর রহমান। আজ তাঁর জীবন-কথা।

বাংলাদেশের জাতীয় জীবনে জিয়াউর রহমানের আর্বিভাব হয়েছিল হঠাৎ করেই ১৯৭১ সালে। তাঁর কণ্ঠে বাংলাদেশের স্বাধীনতার ঘোষণা সেসময় দেশটির এক প্রান্ত থেকে অপর প্রান্তে মানুষের মনে সাহস জাগিয়েছিল, সৃষ্টি করেছিল প্রেরণা।

প্রাক্তন রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানের জন্ম ১৯৩৬ সালের ১৯শে জানুয়ারি বগুড়া জেলার গাবতলি উপজেলায় বাগবাড়ি গ্রামে।

তাঁর পিতা মনসুর রহমান ছিলেন কলকাতায় একটি সরকারি দপ্তরের কেমিস্ট। ভারত ভাগ হওয়ার পর তিনি করাচী বদলি হয়ে গেলে জিয়াউর রহমান সেখানেই অ্যাকাডেমি স্কুলে পড়াশোনা করেন।

করাচীতে লেখাপড়া শেষ করে তিনি ১৯৫৩ সালে সামরিক বাহিনীতে যোগ দিয়েছিলেন একজন ক্যাডেট অফিসার হিসাবে।

Destroyed streets of Madhabpur during the Independence War of Bangladesh in1971.
পাকিস্তান থেকে নতুন সেনাদল আসছে, অস্ত্র আসছে। আমাদের কী করণীয়?
কর্নেল ওলি আহমেদ
অষ্টম ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টে জিয়াউর রহমানের সহকর্মী

মি. রহমান ৫৫ সালে কমিশনপ্রাপ্ত হবার পর সামরিক বাহিনীর গোয়েন্দা শাখা সহ বিভিন্ন বিভাগে কাজ করেছেন।

বাংলাদেশে স্বাধীনতা যুদ্ধ শুরুর আগে ১৯৭০ সালে তিনি চট্টগ্রাম সেনাবাহিনীর অষ্টম ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টে সহ-অধিনায়ক হিসাবে সেখানে বদলি হন।

তাঁর ওই রেজিমেন্টের একজন সহকর্মী কর্নেল ওলি আহমেদ বিবিসি বাংলাকে বলেন তখনই জিয়াউর রহমান বাংলাদেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতির প্রেক্ষাপটে সেনাবাহিনীতে বিদ্রোহ করার পরিকল্পনা নিয়েছিলেন।

“প্রায় সময় দেখতাম তিনি দেশের ব্যাপারে খুব চিন্তিত থাকতেন। এক পর্যায়ে তিনি আমাকে বললেন, নির্বাচনের পরে পাকিস্তান থেকে নতুন সেনাদল আসছে, অস্ত্র আসছে। মনে হয় পশ্চিম পাকিস্তানের সেনা বাহিনীর সদস্যরা শেখ মুজিবুর রহমানকে প্রধানমন্ত্রী হিসাবে মেনে নেবে না। বা বাঙালিদের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তর করবে না। এতে আমাদের কী করণীয়?”

মি. আহমেদ বলেন: “এর এক পর্যায়ে আমরা বিদ্রোহের পরিকল্পনা করলাম।”

পূর্ব পাকিস্তান রাইফেলস-এর সৈন্যরা প্রশিক্ষণ নিচ্ছেন। এপ্রিল ১৯৭১।বিভিন্ন সেনা ব্যারাকে তখন প্রশিক্ষণ নিচ্ছিলেন পূর্ব পাকিস্তান রাইফেলস-এর সৈন্যরা

উনিশশ একাত্তর সালের ২৫শে মার্চ রাতে নিরস্ত্র মানুষের ওপর পাকিস্তানি বাহিনীর আক্রমণের ঘটনার পর অষ্টম ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের সদস্যরা বিদ্রোহ করেন জিয়াউর রহমানের নেতৃত্বে, বলেছেন কর্নেল ওলি আহমেদ।

“২৫শে মার্চ রাতে যখন আমরা শুনলাম পাকিস্তান সেনাবাহিনী বর্বর ও নৃশংস হত্যাকাণ্ডের মাধ্যমে সমগ্র ঢাকাকে তাদের নিয়ন্ত্রণে নিয়ে এসেছে, চট্টগ্রাম থেকে একমাত্র তখন শহীদ রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানের নেতৃত্বে আমরা বিদ্রোহ করি।

“পরবর্তী পর্যায়ে ২৭ তারিখ আমরা সিদ্ধান্ত নিলাম, জিয়া সাহেব দেশের স্বাধীনতা ঘোষণা করবেন। এবং তিনি বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণা করলেন,” মি. আহমেদ বলেন।

তবে মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসের দলিলের তথ্য মতে, কয়েকজন ব্যক্তি ২৬ এবং ২৭ তারিখে স্বাধীনতার ঘোষণা পাঠ করেছিলেন। তৎকালীন মেজর জিয়াউর রহমানও তার ঘোষণাটি আওয়ামী লীগ প্রধান শেখ মুজিবুর রহমানের নামে পাঠ করেন।

“বাংলাদেশের একটা মানুষের ঘোষণার অধিকার ছিলো, আর তিনি হলেন শেখ মুজিবুর রহমান। এটা নিয়ে যে বিতর্ক আসতে পারে সেটাই তো কেউ কখনো চিন্তা করেনি,” মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক গবেষক আফসান চৌধুরী বিবিসি বাংলাকে বলেন।

বাংলাদেশ সরকারের তথ্য মন্ত্রণালয় কর্তৃক ১৯৮২ সালে প্রকাশিত বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্র ৩য় খণ্ডে বলা হয়েছে, ২৬শে মার্চের প্রথম প্রহরে পাকিস্তানী বাহিনীর হাতে আটকের আগেই শেখ মুজিবুর রহমান বাংলাদেশকে স্বাধীন ঘোষণা করে একটি তারবার্তা পাঠান।

এতে বলা হয়, ২৫শে মার্চে মধ্যরাতের পর অর্থাৎ ২৬শে মার্চের প্রথম প্রহরে এ ঘোষণা দেন তিনি। যা তৎকালীন ইপিআর- এর ট্রান্সমিটারের মাধ্যমে সারাদেশে ছড়িয়ে পড়ে।

পরে চট্টগ্রামের স্থানীয় একটি বেতারকেন্দ্র থেকে ২৬ ও ২৭শে মার্চ বেশ কয়েকজন শেখ মুজিবের পক্ষে স্বাধীনতার ঘোষণা পাঠ করেন।

জিয়াউর রহমান প্রথমে সেক্টর কমাণ্ডার এবং পরে জেড ফোর্সের কমাণ্ডার হিসাবে স্বাধীনতা যুদ্ধ করেন। স্বাধীনতা লাভের পর ১৯৭২ সালে তাঁকে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর উপ-প্রধান করা হয়।

রাষ্ট্রবিজ্ঞানী অধ্যাপক এমাজউদ্দিন আহমেদ বিবিসি বাংলাকে বলেন পঁচাত্তরে যেসব পট পরিবর্তন হচ্ছিল, সেই পটভূমিতে বাধ্যতামূলকভাবে পদত্যাগ করা এবং আটক অবস্থায় থাকা জিয়াউর রহমানকে মুক্ত করে এনে ক্ষমতায় বসানো হয়েছিল।

আর সেভাবেই একজন সামরিক কর্মকর্তা পরবর্তীতে জনপ্রিয় রাজনীতিক হওয়ার সুযোগ পেয়েছিলেন বলে মনে করেন মি. এমাজউদ্দিন আহমেদ।

“জিয়াউর রহমান রাজনীতিতে এলেন ১৯৭৫ সালের ৭ই নভেম্বরের সিপাহী-জনতা বিপ্লবের মাধ্যমে। তবে এই বিপ্লব অবশ্য তার ইনিশিয়েটিভে (উদ্যোগে) হয়নি, এই বিপ্লবের অন্য কারণ ছিল। কিন্তু এটা বলতে পারি যে এই বিপ্লবের ফলশ্রুতিই বরং তাঁকে বাংলাদেশের রাজনীতিতে মুখ্য ভূমিকা পালনের জন্য ক্ষেত্র তৈরি করে দিয়েছিল।”

Former President of Bangladesh, Major General Ziaur Rahman, during a press conference in London. February 17, 1978
তিনি যে বাঙালি জাতির অন্যতম একজন শ্রেষ্ঠ সন্তান সে বিষয়ে কোন সন্দেহ নেই।
এমাজউদ্দিন আহমেদ
রাষ্ট্রবিজ্ঞানী অধ্যাপক

এমাজউদ্দিন আহমেদ মনে করেন জিয়াউর রহমানের বড় মাপের নেতা হওয়া বা জনপ্রিয়তা পাওয়ার মূল কারণ ছিল তিনি তাঁর দল বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল, বিএনপি প্রতিষ্ঠা করার পাশাপাশি সব দলের রাজনীতি করার সুযোগ সৃষ্টি করেছিলেন।

“জিয়াউর রহমান সাহেব অনুভব করেছিলেন যে একটি দেশকে ভালভাবে শাসন করতে হলে দল গঠন অপরিহার্য। আর বিশেষ করে গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় বহু দল তো অপরিহার্য। এই বহুদলীয় গণতন্ত্র প্রবর্তনের লক্ষ্যে তিনি প্রথমে এক্সিসটিং (সেসময় কার্যকর) দলগুলোকে স্বীকৃতি তো দিলেন, এবং সেইসঙ্গে নিজের দল করলেন ১৯৭৮ সালের পহেলা সেপ্টেম্বর।”

নিজের দেশের রাজনীতির গণ্ডী ছাড়িয়ে দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে সহযোগিতা বাড়ানোর লক্ষ্যে সার্ক জোট গঠনের ক্ষেত্রে ভূমিকা রাখা সহ আন্তর্জাতিক অঙ্গনেও মি. রহমান নিজের একটা অবস্থান করে নিয়েছিলেন।

জিয়াউর রহমান স্ত্রী খালেদা জিয়াকে নিয়ে ভারত সফরে ১৯৮০ সালে। ডানে ভারতের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীজিয়াউর রহমান স্ত্রী খালেদা জিয়াকে নিয়ে ভারত সফরে ১৯৮০ সালে

অধ্যাপক এমাজউদ্দিন আহমেদ বলছেন: ”জিয়াউর রহমানকে যেদিক থেকেই বিবেচনা করা হোক্ না কেন তিনি যে বাঙালি জাতির অন্যতম একজন শ্রেষ্ঠ সন্তান সে বিষয়ে কোন সন্দেহ নেই।”

“উনিশ ৮১ সালের ৩০শে মে -একটি দু:খবহ ঘটনার দিন। তিনি হয়ত দলীয় অথবা জাতীয় কোন সমস্যা সমাধানের জন্য চট্টগ্রাম গিয়েছিলেন। কিন্তু চট্টগ্রামে যখন তিনি নৃশংসভাবে নিহত হলেন তাঁর সহযোগী, সামরিক বাহিনীরই কিছু কর্মকর্তার হাতে, তখন সেই সংবাদ কিন্তু গোটা দেশ খুব কষ্টের সঙ্গে গ্রহণ করেছিল।”

জিয়াউর রহমানের মৃত্যুর পর তাঁর স্ত্রী খালেদা জিয়ার নেতৃত্বেই বিএনপি দল হিসাবে টিকে রয়েছে।

সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালির তালিকায় বিশতম স্থানে আসা হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীর জীবন কথা পড়তে এখানে ক্লিক করুন।