আলমগীর মানিক, রাঙামাটি
অবৈধ দখলদারদের দাপটে আয়তনে ছোট হয়ে আসছে দক্ষিণ এশিয়ার বৃহত্তম কৃত্রিম হ্রদ রাঙামাটির কাপ্তাই লেক। ক্ষমতার দাপট দেখিয়ে একে একে বাঁধ দিয়ে লেকের আয়তন ছোট করার পাশাপাশি মৎস্য প্রজনন ক্ষেত্র ধ্বংসের উৎসবে মেতেছে এক শ্রেণীর অবৈধ দখলদার। বিগত বছরগুলোতে এই ধরনের অবৈধ দখলদারদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা না নেওয়ায় দখলের হিড়িক পড়েছে। ১৯৬০ সালে বিদ্যুৎ উৎপাদনের জন্য রাঙামাটির কাপ্তাই উপজেলার কর্ণফুলী নদীর ওপর বাঁধ দেওয়া হয়। এ বাঁধের ফলে ৭২৫ বর্গকিলোমিটার এলাকাজুড়ে বিশাল জলাধার সৃষ্টি হয়। হ্রদের কারণে জেলার ৫৪ হাজার একর কৃষিজমি পানিতে ডুবে যায়, যা পার্বত্য চট্টগ্রামের চাষযোগ্য জমির প্রায় শতকরা ৪০ ভাগ। এছাড়া এ বাঁধের কারণে সম্পত্তি ও ঘরবাড়ি ক্ষতি ছাড়াও এক লাখের বেশি লোকজন উদ্বাস্তু হয়। তবে এ হ্রদের ফলে কাপ্তাই জলবিদ্যুৎ কেন্দ্রের ৫টি ইউনিট থেকে ২৩০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদনের পাশাপাশি মৎস্য উৎপাদন করে বিপুল পরিমাণের রাজস্ব আয় হচ্ছে। সারাদেশের মানুষের আমিষের চাহিদা মেটানোর অন্যতম উপদায়ক বিশাল এই কৃত্রিম হ্রদটি বাংলাদেশের মৎস্য সম্পদসহ জীববৈচিত্র্যের সংগ্রহশালাও বটে। কাপ্তাই হ্রদকে বহু বৈশিষ্ট্য সম্পন্ন একটি জলাশয় হিসেবে নানামুখি স্বপ্ন দেখা হলেও এই হ্রদের মূল্যবান সম্পদ রক্ষাসহ হ্রদের সৌন্দয্য রক্ষায় উল্লেখযোগ্য কোনো উদ্যোগ সরকারী সংশ্লিষ্ট্য কর্তৃপক্ষ এখনো পর্যন্ত নিয়েছে বলে দৃশ্যমান হয়নি।
ইতোমধ্যেই কাপ্তাই হ্রদের বিভিন্ন পাহাড়ি এলাকার ঘোনাগুলো এক শ্রেণীর প্রভাবশালী ব্যক্তি বাঁধ দিয়ে নিজেদের মতো করে ব্যবসা-বানিজ্য পরিচালনা করছে। এতে করে হ্রদের আয়তন ছোট হয়ে যাওয়ার পাশাপাশি প্রজনন ক্ষেত্র কমে মৎস্য সম্পদের উৎপাদনও কমে আসছে ক্রমান্বয়ে। এছাড়াও রাঙামাটির একটি ছাড়া বাকি নয়টি উপজেলার সাথে যোগাযোগের অন্যতম প্রধান রুট হলো কাপ্তাই হ্রদ। হ্রদের বিভিন্ন পাহাড়ি ঘোনাগুলোতে অবৈধভাবে মাটি ভরাট করে বাঁধ দেওয়ার ফলে নৌ-চলাচলেও ব্যাঘাতের সৃষ্টি হচ্ছে।
এদিকে কাপ্তাই হ্রদের মৎস্য সম্পদ রক্ষার দায়িত্বে থাকা বাংলাদেশ মৎস্য উন্নয়ন কর্পোরেশন বিএফডিসি কর্তৃপক্ষ স্বল্প জনবল নিয়ে এসব অবৈধ দখলদারদের বিরুদ্ধে কঠোর অবস্থানে যেতে হিমসীম খাচ্ছে। বিএফডিসির সূত্রে জানাগেছে, কাপ্তাই হ্রদে প্রায় অর্ধশত অবৈধ বাধ দিয়েছে প্রভাবশালীরা। যেগুলোর প্রায় অীধকাংশই জাতীয় ও আঞ্চলিক রাজনৈতিক ছত্রছায়ায় থাকা প্রভাবশালী ব্যক্তিদের দখলে রয়েছে। প্রাপ্ত তথ্যানুসারে হ্রদের অন্যতম প্রধান মৎস্য সম্পদ নির্ভর লংগদু ও বাঘাইছড়ি উপজেলার বিভিন্ন এলাকায় অবৈধ বাঁধের সংখ্যাই বেশি। স্থানীয় ও আঞ্চলিক রাজনৈতিক নেতাদের মাধ্যমে এসব এলাকায় নামে-বেনামে সমিতি বা ব্যক্তি বিশেষের নামে মৎস্য প্রকল্পের নাম দিয়ে কাপ্তাই হ্রদের ঘোনাগুলোতে মাটির বাঁধ দিয়ে অবৈধভাবে দখল করা হয়েছে।
ইতিমধ্যেই কাপ্তাই হ্রদের বিভিন্ন স্থানে অবৈধভাবে মাটি ভরাট করে গড়ে তোলা বিভিন্ন বাঁধ ধ্বংসের অভিযানে নামলেও স্থানীয় প্রভাবশালীমহলের বাধার মুখে পড়ছে বাংলাদেশ মৎস্য উন্নয়ন কর্পোরেশন বিএফডিসি’র রাঙামাটি কর্তৃপক্ষ। বিষয়টি নিয়ে জানতে চাইলে বিএফডিসি রাঙামাটি কেন্দ্রের ব্যবস্থাপক নৌবাহিনীর কর্মকর্তা মোঃ তৌহিদুল ইসলাম জানিয়েছেন, কাপ্তাই হ্রদে মাছের অন্যতম উৎস হলো কাচালং ও মাইনী নদীর মোহনা। কিন্তু সাম্প্রতিক সময়ে সেসব এলাকায় মাছের উপস্থিতি কম হতে থাকায় বিষয়টি আমাদের ভাবিয়ে তুলে। পরবর্তীতে আমরা খোঁজ নিয়ে জানতে পারি অবৈধভাবে বাঁধ দিয়ে হ্রদ দখল করে রাখায় মাছের অবাধ চলাচল বিঘিœত হচ্ছে এবং এতে করে প্রজনন ক্ষেত্রও কমে এসেছে। তাই আমরা স্থানীয় জনপ্রতিনিধি, ইউএনও ও তৃণমুল পর্যায়ের জনসাধারণকে নিয়ে মতবিনিময় করে মৎস্য সম্পদ রক্ষায় অবৈধ ঁবাধগুলো ধ্বংস করার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করি। যার ধারাবাহিকতায় আমরা ইতিমধ্যেই লংগদু উপজেলায় কয়েকটি বাঁধ কেটে দিয়ে হ্রদের সাথে পূর্বেরন্যায় মিশিয়ে দিই। এক প্রশ্নের জবাবে ব্যবস্থাপক জানান, আমরা কিছু কিছু এলাকায় বাঁধার সম্মুখীন হচ্ছি এটা ঠিক। কিন্তু যেকোনো মূল্যেই আমরা অবৈধ বাঁধের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিবো ধারাবাহিকভাবে। ব্যবস্থাপক জানান, এভাবে অবৈধভাবে যদি কাপ্তাই হ্রদ দখলের মহোৎসব চলতে থাকে তাহলে, মৎস্য উৎপাদন কমে যাওয়ার পাশাপাশি নৌ-চলাচলে ব্যাঘাত ঘটবে এবং খুব শীঘ্রই অত্রাঞ্চলের জলবিদ্যুৎ কেন্দ্রেও বিদ্যুত উৎপাদন কমে আসবে। এছাড়াও দক্ষিণ পূর্ব এশিয়ার সর্ববৃহৎ কৃত্রিম হ্রদের খেতাবটাও হারাতে হবে আমাদের।