আহমদ গিয়াস, কক্সবাজার :
একটি জালিয়াতচক্রের কারসাজিতে মামলার গ্যাঁড়াকলে পড়ে বেহাত হতে চলেছে কক্সবাজার শহরের কলাতলী সাগরতীরের প্রায় ১শ’ কোটি টাকা মূল্যের ২.৩৬ একর সরকারী সম্পত্তি। অভিযোগ ওঠেছে, একটি ভূমিদস্যুচক্র জালিয়াতি কাগজপত্র সৃষ্টির মাধ্যমে রাষ্ট্রপক্ষের বিরুদ্ধে মামলা করে সৈকতের এ মূল্যবান জমি আত্মসাতের চেষ্টা চালাচ্ছে। চক্রটি সম্প্রতি জেলা জজ আদালতের রায় হাসিলের পর এখন খতিয়ান সৃজনের চেষ্টা চালাচ্ছে। এ রায়ের বিরুদ্ধে রাষ্ট্রপক্ষ উচ্চ আদালতে শীঘ্রই আপীল না করলে শত কোটি টাকা মূল্যের সরকারী সম্পত্তি বেহাত হয়ে যাওয়ার আশংকা করা হচ্ছে।
আদালত সূত্র জানায়, কিছু ভূমিদস্যু চক্র দীর্ঘদিন ধরে মিথ্যা ও বানোয়াট ট্রেসম্যাপ দিয়ে জালিয়াতি দলিল বানিয়ে আদালতে একের পর এক মামলা করে কক্সবাজার সাগরপাড়ের শত শত কোটি টাকা মূল্যের সরকারী জমি আত্মসাতের চেষ্টা চালাচ্ছে। সম্প্রতি এই ধরনের বিতর্কিত দলিলের উপর ভিত্তি করে দায়েরকৃত ২টি মামলার রায় রাষ্ট্রের বিপক্ষে গেছে। এ দুটি রায়ের প্রেক্ষিতে কথিত ভূমিদস্যুরা এখন তাদের নামে খতিয়ান খোলারও চেষ্টা করছে। এ দুটি মামলায় রাষ্ট্রপক্ষ শীঘ্রই আপীল না করলে প্রায় শত কোটি টাকা মূল্যের জমি সরকারের হাতছাড়া হয়ে যেতে পারে। জাল ট্রেসম্যাপ তৈরি করে মিথ্যা ও কল্পিত দাগ দেখিয়ে মামলার রায় হাসিল করলেও এসব মামলা সরাসরি বাতিলযোগ্য বলে মনে করেন কক্সবাজার জেলা জজ আদালতের সরকারী কৌশুলী (জিপি) এডভোকেট মোহাম্মদ ঈসহাক। তিনি বলেন, প্রথমে একটি বানোয়াট ট্রেসম্যাপ দেখিয়ে একটি ভূমিদস্যু চক্র সরকারের বিরুদ্ধে মামলা করে মামলার রায় হাসিল করে। পরে একই ট্রেসম্যাপ নিয়ে ভিন্ন দাগের জমি দেখিয়ে আরেকটি মামলা করে। কিন্তু তারা একেক সময় একেক দাগের জমি দাবী করে মামলা করলেও ভুলভাবে রায় হাসিলে সক্ষম হয়েছে। তবে এ রায় নিয়ে জমি নয়, কাগজ পাওয়া যাবে মন্তব্য করে সরকারী কৌশুলী বলেন, মূলত: কাগজ বিক্রি করার জন্যই এসব দলিল বানানো হয়। দলিল বানানোর পর শুরু হয় দখল-বেদখল, মারামারি ও মামলাবাজির ঘটনা। কক্সবাজার সৈকতের জমি মূল্যবান হওয়ার কারণেই ভূমিদস্যু জালিয়াতচক্র এসব জমিকে কেন্দ্র করে মামলাবাজি করছে বলে তিনি মনে করেন।
কক্সবাজার সৈকতের পরিবেশ সংকটাপন্ন এলাকার শত কোটি টাকা মূল্যের জমি বেআইনীভাবে কি করে আত্মসাৎ করা যায় তা কেবল একটি দেওয়ানী মামলা নং অপর ১০২/২০১৮ (আপীল ৯০/২০১৯) বিশ্লেষন করলেই পরিস্কার হয়ে যাবে বলে মনে করেন পরিবেশবাদী সংগঠন ইয়ুথ এনভায়রনমেন্ট সোসাইটি ইয়েস’র প্রধান নির্বাহী ইব্রাহিম খলিল মামুন।
তিনি বলেন, এ মামলার গতি প্রকৃতি-কার্যক্রম তদন্ত করলেই স্পষ্ঠ হয়ে যাবে যে রাষ্ট্রের কত রাঘব-বোয়াল এ লুটপাটে জড়িত। রক্ষকই বড় ভক্ষক!
আদালতের নথি সূত্রে জানা যায়, রামুর দক্ষিণ মিঠাছড়ি ফকিরাঘোনা এলাকার মৃত আবদুল খালেক ও কক্সবাজার শহরের কলাতলীর মৃত কালা মিয়া ১৭/৫৯-৬০ বন্দোবস্তি মামলা মূলে ঝিলংজা মৌজার ২.৩৬ একর জমি পান দাবী করে তাদের ওয়ারিশরা সরকারের বিরুদ্ধে রেকর্ড সংশোধনীর আর্জিতে মামলা করে। ২০১১ সালে কক্সবাজারের যুগ্ম জেলা জজ (১ম) আদালতে দায়েরকৃত এ মামলায় (নং অপর ২১৬/২০১১) সরকারের বিরুদ্ধে রায় হয় ২০১৭ সালের সেপ্টেম্বরে। এরপর অক্টোবর মাসে ডিক্রিও প্রাপ্ত হন বাদী পক্ষ। এ মামলার রায় ডিক্রির বিষয়ে রাষ্ট্রপক্ষ আদালতে উল্লেখ করেন যে, মামলায় সংযুক্ত কথিত বন্দোবস্তি ট্রেসম্যাপে একটি মাত্র বাটা দাগের উল্লেখ থাকলেও মামলায় আরো একটি কাল্পনিক বাটা দাগের কথা উল্লেখ করে বাদীপক্ষ মিথ্যাভাবে সরকারের বিরুদ্ধে রায় হাসিল করেছেন।
রাষ্ট্রপক্ষ আরো উল্লেখ করেন, বাদীর দাবীকৃত কথিত ট্রেপম্যাপে নালিশী জমির আরএস ৫৪৬/৯২৪৮ বাটা দাগের জমির তুলনামূলক বিএস ২০০২০ দাগে ০.২০ একর, বিএস ২০০২১ নং দাগে ০.৪৬ একর ও ২০০০৩ নং দাগে ১.৭ একর বলে দাবী করে রায় হাসিল করেন। এরপর ২.৩৬ একর জমির মধ্যে কালামিয়ার অংশ ১.১৮ একর এবং এ জমির তুলনামূলক বিএস দাগ নং ২০০২৫, ২০০২৬ ও ২০০০১ দাবী করে তার কথিত ওয়ারিশরা ২০১৮ সালে সরকারের বিরুদ্ধে আরো একটি মামলা করে (কক্সবাজার সিনিয়র সহকারী জজ আদালতের মামলা নং অপর ১০২/২০১৮ )। আর ওই বছরের আগস্টেই বাদীর পক্ষে সরকারের বিরুদ্ধে এ মামলার রায় ও ডিক্রি হয়। আর এ রায় ডিক্রির বিরুদ্ধে জেলা জজ আদালতে আপীল করে রাষ্ট্রপক্ষ (অপর আপীল নং ৯০/২০১৯)। সূত্র জানায়, আগামী মাসের (মার্চ) শুরুতে এ মামলার ধার্য তারিখ ছিল। কিন্তু জেলা জজের বদলী আদেশের প্রেক্ষিতে মামলাটির রায়ের দিনক্ষণ এগিয়ে আনার আবেদন করে রাষ্ট্রপক্ষ। এরপর জেলা জজের বদলীর ২ দিন আগে ২৬ জানুয়ারী রায়ের দিনক্ষণ নির্ধারণ করা হয়। ২৬ জানুয়ারী যথারীতি মামলার রায় ঘোষণা করা হয় এবং রায়ে রাষ্ট্রপক্ষের আপীল খারিজ করে দেয়া হয়। বাদীপক্ষ চুড়ান্ত রায়ে জিতে যাওয়ার পর তাদের নামে নতুন খতিয়ান সৃজনের জন্য আবেদন করেছে সদর উপজেলা সহকারী কমিশনারের কাছে। সেখানে তাদের নামে খতিয়ান সৃজন করা হলেই তারা জমির মালিক হিসাবে দলিল পাবেন।
জিপি মোহাম্মদ ইসহাক জানান, জমির দাগ, ট্রেসসহ সবকিছু ঠিক থাকলে বাদীদের নামে খতিয়ান সৃজনের জন্য নিয়ম মোতাবেক তার দপ্তরের পক্ষ থেকে অনাপত্তি পত্র দেয়া হয়েছে। এখন উর্ধতন মহলের অনুমতি পেলে উচ্চ আদালতে (হাইকোর্ট) আপীল করা হবে।
এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে কক্সবাজারের জেলা প্রশাসক মো. কামাল হোসেন বলেন, আমি বিষয়টি অবগত ছিলাম না। এখন খোঁজ-খবর নিয়ে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেব।