আহমদ গিয়াস

‘জাহান্নামের জ্বালানী হবে মানুষ ও পাথর’ পবিত্র কোরআনের সুরা বাকারার ২৪ নং আয়াত ও সুরা তাহরীমের ৬ নং আয়াতে বর্ণিত আল্লাহর এ সরল কথা আমরা (মুসলিমরা) বিশ্বাস করি। আল্লাহ পবিত্র কোরআনকে সহজ ভাষায় নাজিল করেছেন বলে উল্লেখ করেছেন। যাতে সকলেই সহজে বুঝতে পারেন। আবার পবিত্র কোরআনকে তিনি ‘কোরআনুল হাকিম বা ‘বিজ্ঞানময় কোরআন’ হিসাবেও আখ্যায়িত করেছেন। অর্থাৎ কোরআন একটি জ্ঞান-বিজ্ঞানের উৎস, আল্লাহর সরল কথার মাঝেও রয়েছে গভীর জ্ঞানের ইঙ্গিত। তাই কোন জ্ঞান-বিজ্ঞানময় মানুষের মনে প্রশ্ন আসবে, পাথরতো আগুণে পুড়ে না। তাহলে কিয়ামতের দিনে এটাকে কীভাবে জ্বালানী বানাবেন আল্লাহ? নিশ্চয় এরমধ্যে এমন কিছু আছে!
তবে পাথরে কী আছে, তা নিয়ে ১৪শ বছরেও কোন গবেষণা করেনি মুসলিমরা। কিন্তু গত শতাব্দির মাঝামাঝি সময়ে ইহুদী-খৃস্টান বিজ্ঞানীরা পাথরে পাওয়া সেই জ্বালানী দিয়ে তৈরি করে ফেলে পারমানবিক বোমা।
পারমানবিক বোমা অথবা চুল্লীর জ্বালানী ইউরেনিয়াম শুধু পাথরে নয়, আছে মানুষের শরীরের মাঝেও। তবে সব মানুষের শরীরে সমান ইউরেনিয়াম থাকে না। কার শরীরে কতটুকু ইউরেনিয়াম আছে, তা নির্ভর করে পরিবেশ থেকে তার ইউরেনিয়াম গ্রহণ ও ছাড়ার পরিমাণের উপর।
জ্বালানী হিসাবে ইউরেনিয়ামের শক্তি কয়লা বা তেলের তুলনায় ২০ লক্ষ থেকে ৩০ লক্ষ গুণ বেশি। গবেষণায় দেখা গেছে, সাধারণত: ২ থেকে ৪ মাত্রার ঘনত্ব বিশিষ্ট পাথরে ইউরেনিয়াম পাওয়া যায়। আবার এসব পাথর ক্ষয়ে গিয়ে এর কোয়ার্টজ কনা আলাদা হয়ে গেলেও এসব কনাতে ইউরেনিয়াম পাওয়া যায়। যেমন মোনাজাইট। ভ‚-গর্ভে বা মাটির নীচে পাওয়া ফসিলসহ প্রত্মতাত্তি¡ক নিদর্শনগুলোর বয়স পরীক্ষা বা কার্বন ডেটিং-এ ইউরেনিয়াম ব্যবহৃত হয়।
ইউরেনিয়াম কমপক্ষে ৪৫০ কোটি বছর আগে পৃথিবীর ভ‚-ত্বকে সৃষ্টি হয়েছে বলে ধারণা বিজ্ঞানীদের। যার অর্ধেকের বেশি জীবন কেটে যায় আইসোটোপ ছাড়াই। আইসোটোপ হল কোন পরমাণুতে থাকা নির্দিষ্ট পরিমাণ রাসায়নিক উপাদান। একটি পরমাণুতে প্রোটনের সংখ্যা একই থাকলেও নিউট্রন সংখ্যা আলাদা হওয়ার কারণে তাদের চরিত্র ভিন্ন হওয়ায় পরিচিতিও আলাদা।
প্রকৃতি থেকে ২৩৮ বা ২৩৫ আইসোটোপ হিসাবেই ইউরেনিয়াম পাওয়া যায়। উভয়ই তেজস্ক্রিয় এবং নির্দিষ্ট সময়সীমার সাথে অন্যান্য উপাদানগুলিতে ক্ষয় হয়ে যায়। তবে এসব ইউরেনিয়ামে যখন কোন মুক্ত নিউট্রন নিক্ষেপ করা হয়, তখনই কেবল পরেরটি জোর করে বিভক্ত হতে পারে। এটিই পারমাণবিক বোমার ভিত্তি।
পরমাণু বোমার ২টি ধাপ রয়েছে, একটি ফিকশন, অপরটি ফিউশন। ফিকশন হল একটি চেইন বিভাজন। যখন একটি মুক্ত নিউট্রন কোন ইউরেনিয়াম ধাতবে আঘাত করে, তখন সেটি ২ বা ততোধিক ছোট নিউট্রন তৈরি করে। এভাবে চেইন প্রতিক্রিয়া হয়। সৃষ্টি হয় হিলিয়াম গ্যাসের। তখন সেটি তাপ ও আলো উৎপাদন করে। আর এভাবে সূর্য আলো ও তাপ দিচ্ছে আমাদের। আর ফিউশন হল ফিউজ হয়ে যাওয়া। ২ বা ততোধিক ক্ষুদ্র নিউট্রন যখন ফিউজ হয়ে একটি বৃহৎ পরমাণু গঠন করে, সেই অবস্থাকে ফিউশন বলে। আর এসময় তৈরি হয় ভয়ানক শব্দ ও শকওয়েভ। যার ধাক্কায় লন্ডভন্ড হয়ে যায় সব কিছু।
পারমানবিক ফিউশন বা পরমাণু বোমা বিস্ফোরণের ফলে প্রথমে আলোক বলের তৈরি হয়। সেই আলোক বলটি সূর্যের আলোকেও অন্ধ করে দেয়। নাকাসাকিতে লিটল বয় এর আলোক বলের প্রভাবে তাপমাত্রা ওঠেছিল প্রায় ৬ হাজার ডিগ্রী।
এখন সহজেই বুঝতে পারছেন যে, পাথর এবং মানুষের মাঝে থাকা ইউরেনিয়ামের পরস্পরের সাথে একদিন ফিকশন- ফিউশন হতে পারে। এখন ইউরেনিয়ামকে আমরা যদি পাপের বøু-প্রিন্ট ধরি, তাহলে একটি ফায়সালায় আসতে পারি।
এখন প্রশ্ন হল, নিরীহ পাথরকে কেন আল্লাহ শাস্তি দেবেন? হ্যাঁ, সে কথাটিও আল্লাহ পবিত্র কোরআনে উল্লেখ করেছেন। আল্লাহকে বাদ দিয়ে নিজেদের তৈরি করা পাথরকে যারা খোদা মানে, তাদের সাথে সেই খোদাকেও জাহান্নামে নিক্ষেপ করা হবে। যাতে পাপীরা বুঝতে পারে যে, তারা যাদেরকে রক্ষাকারী ভেবে ইবাদত করেছিল তারা আসলে কিছুই নয়।
এখন আমরা বুঝতে পারছি যে, কোন পাথরে ইউরেনিয়াম পাওয়্ াযাবে। এখন আসি পৃথিবীতে মানুষের বয়স কত? পৃথিবীতে আসলে মানুষের বয়স কত- তা নিয়ে এখনও ঐক্যমতে পৌঁছাতে পারেননি বিজ্ঞানীরা। কেউ বলে ৫০ হাজার বছর, কেউ বলে এক লক্ষ বছর। তবে মানুষের ইতিহাস এখনও উদ্ধার করা গেছে প্রায় ১০ হাজার বছরের। কিন্তু পৃথিবীর বয়সতো প্রায় ৫শ কোটি বছর। আর এই দীর্ঘ সময়ে নানা ঘটনার মধ্য দিয়েই গেছে পৃথিবী। বিজ্ঞানীদের মতে, মাত্র ২ কোটি বছর আগে টার্শিয়ারি যুগে সৃষ্টি হয়েছিল বাংলাদেশের অধিকাংশ পাহাড় পর্বত। আর ওই সময়েই পৃথিবীর উপর দিয়ে বয়ে যাওয়া প্রাকৃতিক দূর্যোিগের ফলে আজকের ব্যবহারযোগ্য তেল-গ্যাসের সূত্রপাত হয়।
বিজ্ঞানীদের মতে, ১৪ থেকে ২০ কোটি বছর আগে জুরাসিক যুগে ভয়ংকর প্রাকৃতিক দূর্যোগে হারিয়ে গেছে ডাইনোসর। তবে বিজ্ঞানীরা এখনও ১০ হাজার বছরের পুরনো কোন মনুষ্য জাতির ফসিল বা জীবাস্ম আবিস্কার করতে পারেননি। তবে পবিত্র কোরআনের একাধিক স্থানে নানা জাতিকে সীমালঙ্ঘনের কারণে ধ্বংসের কথা উল্লেখ করা হয়েছে। যারা কীনা পৃিিথবীতে তন্ন করে যেতে পারত। অর্থাৎ আল্লাহ ওসব জাতির সামর্থ্যের ব্যাপারে তন্ন তন্ন যাওয়ার যে তথ্য দিয়েছেন, তাতে বোঝা যায় তিনি অতীতে জ্ঞান-বিজ্ঞানে কত শক্তিশালী জাতিই না পািিঠয়েছিলেন।
পবিত্র কোরআনে অত্যচারীদের পরিণতি সম্পর্কে সতর্ক করতে গিয়েও অতীতে বহু জাতির ধ্বংস হওয়ার তথ্য দিয়েছেন। আল্লাহ বলেছেন, তোমরাতো বাস করছ তাদেরই আবাস্থলে, যাদেরকে সীমালঙ্ঘনের কারণেই ধ্বংস করে দেয়া হয়েছে।
এখন আসি আমাদের আলেম সমাজ এসব গবেষণা থেকে কেন পিছিয়ে? কারণ তারা বিজ্ঞান পড়ে না (সবাই নয়)। অথচ আমাদের নবী হযরত (স.) বলেছেন, প্রত্যেক মুসলিম নরনারীর উপর জ্ঞান অর্জন করা ফরজ। শুধু তাই নয়, জ্ঞান অর্জনের জন্য তিনি চীন দেশের মতো কোন কঠিন ভ‚-খন্ডেও যেতে নির্দেশ দিয়েছেন। অথচ আমাদের আলেম সমাজ হাদিসে বর্ণিত ‘জ্ঞান’কে ধর্মীয় জ্ঞান বলে ব্যাখ্যা করেন। তাহলে প্রশ্ন আসতে পারে, আমাদের নবী কি মুসলমানদেরকে শুধুই কোরআন হাদিস পড়ার জন্য বা ধর্মীয় জ্ঞানের জন্য চীন দেশে যেতে বলেছেন? নিশ্চয় নয়। বরং তিনি ইঙ্গিত করেছেন, মুসলমানদের বসবাসের জন্য চীনের মত একটি নিকৃষ্ট দেশে হলেও জ্ঞান অর্জনের জন্য যাও। আল্লাহর সৃষ্টি সম্পর্কে এক ঘন্টার গবেষণাকে সারারাতের নফল ইবাদতের চেয়ে উত্তম বলেও আখ্যায়িত করেছেন আমাদের নবী। অথচ খাঁটি উম্মত দাবীদার অধিকাংশ আলেমই বিজ্ঞান চর্চা থেকে দূরে। ফলে কোরআনুল হাকিমকে তারা কতটুকু অনুধাবণ করতে পারেন?

 

কক্সবাজার\ ২১ ফেব্রুয়ারি, ২০২০\