জাগোনিউজ : রাজধানীর খিলগাঁওয়ের বাসিন্দা আবদুল খালেক। বয়স ৭০ বছরের ওপরে। জমি বেচা অর্থ রেখেছেন বেসরকারি একটি ব্যাংকে। তিন বছর মেয়াদি আমানতে প্রতি মাসে মুনাফাবাবদ তোলেন ১৬ হাজার টাকা। এতেই চলে সংসার। কিন্তু এখন দুশ্চিন্তায় সময় পার করছেন তিনি।

আবদুল খালেকের ভাষ্য, তিন বছরের আমানতের মেয়াদ পূর্ণ হচ্ছে মার্চে। এরপর ব্যাংকে আমানত রাখলে মুনাফাবাবদ পাবেন ১০ হাজার টাকা। কিন্তু এ টাকায় সংসার চালানো দায়। তাই কোথায় টাকা রাখলে বেশি মুনাফা পাওয়া যাবে, সেই সন্ধানে আছেন তিনি। আমানতে সুদহার কমায় আবদুল খালেকের মতো অনেকেই এখন বেশি মুনাফার বিনিয়োগের জায়গা খুঁজছেন।

সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, ঋণের সুদহার সিঙ্গেল ডিজিট নামিয়ে আনতে প্রস্তুতি নিচ্ছে ব্যাংকগুলো। এর অংশ হিসাবে আমানতের সুদহার ৬ শতাংশে নামিয়ে আনছে অনেক ব্যাংক। এতে দুশ্চিন্তায় আছেন আমানতকারীরা। অন্যদিকে ব্যাংকগুলোতে আমানতের সুদহার কমলে অনুৎপাদন খাতে বিনিয়োগ বেশি যেতে পারে— এমন শঙ্কা প্রকাশ করেছেন অর্থনীতিবিদরা। অর্থপাচারের শঙ্কাও প্রকাশ করছেন তারা।

সরকারের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী, ঋণের সুদহার সিঙ্গেল ডিজিট বাস্তবায়নে গত ১ ফেব্রুয়ারি থেকে ব্যাংকগুলো আমানত সংগ্রহ করছে ৬ শতাংশ সুদে।

মেয়াদি স্কিম ছাড়া সব ধরনের আমানতের ক্ষেত্রে এ সুদহার প্রযোজ্য হচ্ছে। তবে যেসব আমানতের মেয়াদ শেষ হবে, সেগুলোর মেয়াদ বাড়ানোর ক্ষেত্রেও এটি কার্যকর হবে। এমনটাই সিদ্ধান্ত নিয়েছে ব্যাংক নির্বাহীদের সংগঠন অ্যাসোসিয়েশন অব ব্যাংকার্স বাংলাদেশ (এবিবি)।

এদিকে রাজধানীর কয়েকটি ব্যাংকের শাখায় গিয়ে দেখা গেছে, বেশির ভাগ ব্যাংক আমানতের সুদহার ৬ শতাংশ করছে। তবে কিছু ব্যাংক বেশি সুদেও আমানত নিচ্ছে।

রাজধানীর মতিঝিলের এক্সিম ব্যাংক শাখায় আমানতের মুনাফার খোঁজ নিতে যান জয়নুল আবেদিন নামের এক ব্যক্তি। তিনি জাগো নিউজকে জানান, বেসরকারি একটি প্রতিষ্ঠানে বেতন দিয়ে সংসার খরচের পাশাপাশি একটি সমিতিতে অল্প অল্প করে অর্থ জমিয়েছেন। দুই লাখ টাকা আমানত রাখবেন বলে এক্সিম ব্যাংকে খোঁজ নিতে এসেছেন। ৬ শতাংশের বেশি মুনাফায় তারা আমানত নেবে না। তাই টাকা রাখা নিয়ে সিদ্ধান্তহীনতায় রয়েছেন তিনি।

এ বিষয়ে ওই শাখার সংশ্লিষ্ট এক কর্মকর্তা বলেন, ১ ফেব্রুয়ারি থেকে আমানতের মুনাফা ৬ শতাংশ— প্রধান শাখা থেকে এমনই নির্দেশনা এসেছে। পরবর্তী ঘোষণা না আসা পর্যন্ত ৬ শতাংশের বেশি আমানত মুনাফা দেয়া যাবে না।

এবিবির চেয়ারম্যান ও ইস্টার্ন ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক আলী রেজা ইফতেখার বলেন, সরকারের নির্দেশনা অনুযায়ী, আগামী এপ্রিল থেকে ঋণের সুদহার সিঙ্গেল ডিজিটে নামিয়ে আনা হবে। তাই আগে থেকে প্রস্তুতি হিসাবে ধীরে ধীরে আমানতের সুদহার কমানো হচ্ছে। কারণ আমানতের সুদ না কমলে সিঙ্গেল ডিজিটে ঋণের সুদহার নামিয়ে আনা সম্ভব নয়।

এ বিষয়ে জানতে চাইলে অর্থনীতিবিদ ড. এ বি মির্জ্জা আজিজুল ইসলাম জাগো নিউজকে বলেন, আমানতের সুদহার ৬ শতাংশ হলে মানুষ ব্যাংকে টাকা কম রাখবে। কারণ এখন মূল্যস্ফীতি ৫ দশমিক ৭৫ শতাংশ। যদি ৬ শতাংশ সুদে আমানত রাখে, তাহলে পাবে ৬ টাকা। এর সঙ্গে বিভিন্ন চার্জ রয়েছে। তার মানে ব্যাংকে আমানত রাখলে তেমন মুনাফা পাবে না। তখন মানুষ ব্যাংকে আমানত রাখা কমিয়ে দেবে।

আমানতের সুদহার কমলে অনুৎপাদন খাতে বিনিয়োগ বেশি হবে বলে আশঙ্কা প্রকাশ করেন মির্জ্জা আজিজুল। তিনি আরও বলেন, মানুষ কম মুনাফায় ব্যাংকে টাকা না রেখে জমিতে বিনিয়োগ করবে। গাড়ি- বাড়ি-ফ্ল্যাট কিনবে। এতে অনুৎপাদনশীল খাতে বিনিয়োগ বেড়ে যাবে। আরও বেশি শঙ্কার কথা হলো, দেশে যখন মানুষ টাকা কাজে লাগাতে পারবে না, তখন বিভিন্ন অবৈধ পন্থায় বিদেশে টাকা পাঠিয়ে দেবে। এতে করে অর্থপাচার বেড়ে যাবে।

তাই মূল্যস্ফীতি বিবেচনায় আমানতের সুদ যৌক্তিক পর্যায়ে রাখার পরামর্শ এ অর্থনীতিবিদের।

ওয়াশিংটনভিত্তিক গবেষণা প্রতিষ্ঠান গ্লোবাল ফাইন্যান্সিয়াল ইন্টেগ্রিটির (জিএফআই) সর্বশেষ প্রকাশিত তথ্য বলছে, ২০১৫ সালে বাংলাদেশ থেকে প্রায় ৫০ হাজার কোটি টাকা পাচার হয়েছে। গত বছর প্রকাশিত জিএফআইয়ের প্রতিবেদনে ১৪৮টি উদীয়মান ও উন্নয়নশীল দেশের অর্থপাচারের তথ্য উল্লেখ করা হয়। সবচেয়ে বেশি অর্থপাচার হয় চীন থেকে। এ তালিকায় বাংলাদেশের অবস্থান ১৯তম।

বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য বলছে, বর্তমানে বেশিরভাগ বেসরকারি বাণিজ্যিক ব্যাংক বৃহৎ ও মাঝারি শিল্পে ১০ শতাংশের বেশি সুদে ঋণ বিতরণ করছে। অনেক ব্যাংক ১৬ থেকে ১৭ শতাংশ সুদেও ঋণ দিচ্ছে। ক্ষুদ্র শিল্পে সর্বোচ্চ ১৮ ভাগ হারে ঋণ বিতরণ করছে কোনো কোনো ব্যাংক৷

সম্প্রতি প্রকাশিত গবেষণা সংস্থা বিআইডিএসের এক প্রতিবেদন অনুযায়ী, ব্যাংকগুলো গড়ে এখন ৯ থেকে ১১ শতাংশ সুদে আমানত নিচ্ছে, আর ১৩ থেকে ১৫ শতাংশ হারে ঋণ বিতরণ করছে।

এমন পরিস্থিতিতে ৯ শতাংশ সুদে ঋণ বিতরণের জন্য ৬ শতাংশ সুদে আমানত নিশ্চিত করতে হবে। এ হারে আমানত সংগ্রহ করাই বড় চ্যালেঞ্জ বলে মনে করেন এবিবির সাবেক সভাপতি ও মিউচুয়াল ট্রাস্ট ব্যাংকের (এমটিবি) ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) ও প্রধান নির্বাহী (সিইও) সৈয়দ মাহবুবুর রহমান।

তিনি বলেন, ঋণের সুদহার কমালে বেসরকারি ঋণ প্রবাহ বাড়বে। তবে এক্ষেত্রে প্রয়োজন ৬ শতাংশ হারে আমানত সংগ্রহ নিশ্চিত করা। কিন্তু এটি বাস্তবায়ন করাই এখন ব্যাংকগুলোর জন্য বড় চ্যালেঞ্জ। কারণ বর্তমান পরিস্থিতিতে ৬ শতাংশ সুদে আমানত পাওয়া খুব কঠিন। তাই কম সুদে আমানত সংগ্রহ করতে না পারলে চাহিদা অনুযায়ী ঋণ দেয়া সম্ভব হবে না।

এদিকে দীর্ঘদিন ধরে ব্যাংকের আমানতের সঙ্গে সমন্বয় করে সঞ্চয়পত্রে সুদহার কমানোর দাবি করছেন ব্যাংক পরিচালক ও নির্বাহীরা। তাদের এ দাবির পরিপ্রেক্ষিতে সরকার সঞ্চয়পত্রে বিনিয়োগে নানা শর্ত জুড়ে দিয়েছে।

সর্বশেষ ১৬ ফেব্রুয়ারি অর্থ মন্ত্রণালয় থেকে পাঠানো এক প্রেস বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, তিন বছর মেয়াদি ডাকঘর সঞ্চয় স্কিমের সুদের হার হবে ৬ শতাংশ, যা এত দিন ১১ দশমিক ২৮ শতাংশ ছিল। মেয়াদ পূর্তির আগে ভাঙানোর ক্ষেত্রে এক বছরের জন্য সুদ মিলবে ৫ শতাংশ, আগে যা ছিল ১০ দশমিক ২০ শতাংশ। দুই বছরের ক্ষেত্রে তা সাড়ে ৫ শতাংশ, আগে যা ছিল ১০ দশমিক ৭০ শতাংশ।