মুহাম্মদ আবু সিদ্দিক ওসমানী :

উখিয়া থানার ওসিদের বিদায় ও বরণ অনুষ্টানে প্রধান অতিথির বক্তব্যে কক্সবাজারের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (প্রশাসন) মোঃ ইকবাল হোসাইন বলেছেন, কক্সবাজার জেলায় চাকুরী জীবনের দেড় বছর কিন্তু ইতিমধ্যে পার করেছি, শতকরা ৯০ ভাগ লোকজনকে আমরা চিনে ফেলেছি। কে কি রকম, ঐ যে মুখোশধারী মানসিকতার লোকজন, তারাও চিহ্নিত। কিন্তু তারা বেশ চিন্তিত হয়ে পড়েছেন। কারা দিনে চলেন, কারা রাতে চলেন, যারা মুখে একটা বলেন, কারা ফেইসবুকে আর একটা স্ট্যাটাস দেন। কারা নিজে লালন করেন, আসলে কি পালন করেন। কারা নিজের সন্তানের ক্ষেত্রে কি করেন, কারা প্রতিদ্বন্দ্বীর ক্ষেত্রে কি করেন। সকল তথ্য কিন্ত ইতিমধ্যে আমাদের হাতে চলে এসেছে। তাই মুখে এক কথা বলবেন, করবেন আরেকটা, এগুলো সময় থাকতে বাদ দেন। সঠিক তথ্য পেলে আমরা দুই ঘন্টার কাজ দুই মিনিটে সম্পন্ন করতে পারি ইনশাআল্লাহ।

শনিবার ১৫ ফেব্রুয়ারী রাত ৯ টার দিকে উখিয়া থানা চত্বরে উখিয়া থানার ওসি (তদন্ত) নুরুল ইসলাম মজুমদারের সভাপতিত্বে অনুষ্টিত সভায় প্রধান অতিথির বক্তব্যে কক্সবাজারের এডিশনাল এসপি (এডমিন) মোঃ ইকবাল হোসাইন আরো বলেন, অপরাধীকে অপরাধী হিসেবে দেখবেন, তাদের শত্রু হিসেবে কখনো না দেখবেন না।
অনুষ্ঠানে অতিথি হিসেবে অন্যান্যদের মধ্যে উপস্থিত ছিলেন, অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (উখিয়া সার্কেল) নিহাদ আদনান তাইয়ান, উখিয়া উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান অধ্যক্ষ হামিদুল হক চৌধুরী, সহকারী পুলিশ সুপার আমরানুল হক মারুফ, উখিয়া উপজেলা আওয়ামীলীগের সাবেক সভাপতি কবি আদিল উদ্দিন চৌধুরী, রামু থানার বর্তমান ওসি ও উখিয়া থানার সাবেক মোঃ আবুল খায়ের, উখিয়া থানার বিদায়ী ওসি মোঃ আবুল মনসুর। অন্যদের মধ্যে বক্তব্য রাখেন উখিয়া উপজেলা আওয়ামীলীগের সাধারন সম্পাদক রাজাপালং ইউনিয়নের চেয়ারম্যান জাহাঙ্গীর কবির চৌধুরী, উপজেলা ভাইস চেয়ারম্যান জাহাঙ্গীর আলম, উপজেলা মহিলা ভাইস চেয়ারম্যান কামরুন্নেছা বেবী, রত্নাপালং ইউনিয়নের চেয়ারম্যান খাইরুল আলম চৌধুরী, জালিয়াপালং ইউনিয়নের চেয়ারম্যান নুরুল আমিন চৌধুরী, হলদিয়া পালং ইউনিয়নের চেয়ারম্যান অধ্যক্ষ শাহ আলম, উখিয়া প্রেসক্লাব সভাপতি সরওয়ার আলম শাহীন, জেলা ছাত্রলীগের সাবেক সভাপতি আলী আহামদ, পালংখালী ইউনিয়ন আওয়ামীলীগের সভাপতি এম.এ মঞ্জুর, উপজেলা যুবলীগ সভাপতি মুজিবুল হক আজাদ ও উপজেলা ছাত্রলীগ সভাপতি মকবুল হোসেন মিথুন প্রমুখ।
পুরো অনুষ্টানটি সঞ্চালনা করেন উখিয়া থানার এস আই সিম্পু বড়ুয়া।

অনুষ্টানে উখিয়া থানার নবাগত ও চট্টগ্রাম রেঞ্জের প্রথম নারী ওসি মর্জিনা আকতার মর্জু বলেছেন, অনেক কথা হয়েছে, আমি কথায় নয়, কাজে বিশ্বাসী। একটু সময় দেন, আমার কাজের মাধ্যমে সব প্রমাণ পেয়ে যাবেন ইনশাআল্লাহ। আপনার উর্ধ্বতন ভাল হলে সবকিছুতে পরিবর্তন আসতে বাধ্য। বর্তমানে কক্সবাজারে এমন যোগ্য কর্মকর্তারা রয়েছেন, কর্মের মাধ্যমে পরিচিত ও যারা সারা দেশে আলোচিত। যেখানে এমন চৌকস, মেধাবী, সৎ, সাহসী ও যোগ্য কর্মকর্তারা রয়েছেন, সেখানে উখিয়াবাসী অবশ্যই তার সুফল পাবে। আমি চেষ্টা কবর সকলের সহযোগিতায় সুন্দর ও প্রায় অপরাধমুক্ত উখিয়া গড়তে। এ জন্য নবাগত ওসি মর্জিনা সকলের দোয়া, আশীর্বাদ ও আন্তরিক সহযোগিতা কামনা করেন।

প্রসঙ্গত, গত ১৩ ফেব্রুয়ারী কক্সবাজারের উখিয়া থানার ওসি পদে মর্জিনা আক্তার মর্জুকে পদায়নের আদেশ হয়। ১৪ ফেব্রুয়ারী তিনি উখিয়া থানার ওসি পদে যোগদান করেন। সর্বশেষ কক্সবাজার জেলা পুলিশের ডিবি’তে কর্মরত ছিলেন এ নারী পুলিশ কর্মকর্তা।

ওসি পদে মর্জিনা আক্তার মর্জু’র সংক্ষিপ্ত জীবনী :

চট্টগ্রামের কর্ণফুলী থানার শিকলবাহা গ্রামে ১৯৭৮ সালের ৩ নভেম্বর জন্ম নেয়া মর্জিনা আক্তার মর্জু আট ভাইবোনের মধ্যে পঞ্চম। বাবা মোহাম্মদ রফিক মারা গেছেন। মা জয়নব বেগম বেঁচে আছেন। ২০০৮ সালে ব্যাংকার আরিফুল আজমের সঙ্গে মর্জিনা সংসারজীবনে প্রবেশ করেন। একটি বেসরকারি ব্যাংকে ঊর্ধ্বতন পদে কর্মরত আছেন আরিফুল আজম। তাঁদের এক মেয়ে ও এক ছেলে সন্তান রয়েছে। একজন নুজহাত মার্জিয়া আজমি (১০), আরেকজন আজলান মালিক আবির (৭)।

চট্টগ্রাম নগরের সদরঘাট থানায় দুই বছর ওসি হিসেবে সফলভাবে দায়িত্ব পালন করে যাওয়া মর্জিনা এখন থেকে উখিয়া থানা পুলিশের নেতৃত্ব দেবেন, অফিসার ইনচার্জ (ওসি) হিসেবে। অবশ্য নেতৃত্বদানের সহজাত গুণ তাঁর মধ্যে ছিল শিক্ষাজীবন থেকেই! ১৯৯৮ সাল থেকে ২০০১ সাল পর্যন্ত টানা তিন বছর চট্টগ্রাম সরকারী মহিলা কলেজ ছাত্রী সংসদের নির্বাচিত ভাইস প্রেসিডেন্ট (ভিপি) ছিলেন মর্জিনা। মেধা, দক্ষতা ও সদিচ্ছা থাকলে নারীরাও যে নেতৃত্বদানে সক্ষম তা শিক্ষাজীবনে প্রমাণ দিয়ে এসেছেন পুলিশ কর্মকর্তা মর্জিনা আক্তার। শিক্ষাজীবনে ১৯৯৩ সালে এসএসসি পাস করেন প্রথম শ্রেণীতে। এরপর পড়াশোনার পাশাপাশি স্কাউট আন্দোলনের সাথে যুক্ত হন। গার্ল ইন স্কাউটিং বিভাগের প্রথম ব্যাচের একজন ছিলেন মর্জিনা। ছিলেন লিডার ট্রেনার। অর্জন করেন উডব্যাজ। ১৯৯৫ সালে এইচএসসি’র ফলাফলে পান দ্বিতীয় বিভাগ। ১৯৯৮ সালে চট্টগ্রাম সরকারী মহিলা কলেজ থেকে বাংলা সাহিত্যে দ্বিতীয় শ্রেণীতে ১০ম স্থান অর্জন করে বিএ (অনার্স) ডিগ্রি লাভ করেন। ১৯৯৯ সালে চট্টগ্রামের সর্বোচ্চ নাম্বার নিয়ে এমএ ডিগ্রি লাভ করেন। ২০০৩ সালে চট্টগ্রাম সরকারী বিএড কলেজ থেকে ব্যাচেলর অব এডুকেশন (বিএড) ডিগ্রি লাভ করেন। এরপর ২০০৩ সালে সারদা পুলিশ একাডেমীতে এক বছরের মৌলিক প্রশিক্ষণ শেষে ২০০৪ সালে মর্জিনা আক্তার মর্জু বাংলাদেশ পুলিশে উপপরিদর্শক (এসআই) হিসেবে যোগ দেন। শিক্ষানবীশ এসআই হিসেবে কক্সবাজার সদর ও রামু থানা কাজ করেন। চাকরি স্থায়ী হওয়ার পর মর্জিনাকে পদায়ন করা হয়, কক্সবাজার জেলা পুলিশের গোয়েন্দা শাখায়। সেখানে দুই বছর কাজ করার সময় পুরো কক্সবাজারের প্রতিটি বাড়িতে গিয়ে গৃহপরিচারিকার তথ্য সম্বলিত ডাটাবেজ তৈরী করেন তিনি। তৎকালীন পুলিশ সুপার বনজ কুমার মজুমদারের দিক-নির্দেশনায় পুরো কক্সবাজারজুড়ে মাদকবিরোধী অসংখ্য অভিযান চালান। ২০০৫ সালের ১৭ আগস্ট কক্সবাজারে বোমা হামলা চালায় জঙ্গিরা। এ ঘটনায় ভয়ংকর জঙ্গিদের বিরুদ্ধে আনা অভিযোগগুলো প্রমাণের জন্য দিনরাত কাজ করেন, জঙ্গিদের জিজ্ঞাসাবাদ করেন। সুনির্দিষ্ট তথ্য-প্রমাণের ভিত্তিতে ২০০৭ সালে মামলাটির তদন্ত শেষে চার্জশিট দিয়েছিলেন তৎকালীন জেলা ডিবি পুলিশের এসআই মর্জিনা আক্তার মর্জু। শুধু তাই নয়, জঙ্গিদের মুখোমুখি দাঁড়িয়ে আদালতে সাক্ষীও দেন তিনি। ২০০৭ সালে চট্টগ্রাম মহানগর পুলিশের ডবলমুরিং থানায় পদায়ন করা হয় মর্জিনাকে। এরপর ২০০৮ সালে কমিউনিটি পুলিশিং সম্পর্কে জানতে মর্জিনাসহ চার পুলিশ কর্মকর্তাকে নেপাল পাঠানো হয়। সেখান থেকে ফিরে নগরীর দামপাড়ায় পুলিশ ট্রেনিং স্কুলে প্রশিক্ষক হিসেবে পদায়ন করা হয় তাকে। এরপর ২০০৯ সালে মর্জিনাকে কোতোয়ালী থানায় বদলি করেন তৎকালীন চট্টগ্রাম মহানগর পুলিশের উত্তর জোনের উপকমিশনার বনজ কুমার মজুমদার। কোতোয়ালীতে দুই বছর কাজের পর ২০১১ সালে সেকেন্ড অফিসার হিসেবে পাঁচলাইশে বদলী করা হয় মর্জিনাকে। উত্তর জোনে চাকরির ৩ বছর পূর্ণ পওয়ায় তাকে বদলি করা হয় বন্দর জোনের ডবলমুরিং থানায়। সেখানে কয়েক মাস কাজ শেষে ২০১২ সালে পাড়ি জমান জাতিসংঘ শান্তিরক্ষা মিশন সুদানে। মিশনে যাওয়ার ১৫ দিনের মাথায় পরিদর্শক হিসেবে পদোন্নতি পান মর্জিনা। ২০১২ সালের অক্টোবর থেকে ২০১৪ সালের জানুয়ারি পর্যন্ত জাতিসংঘ শান্তিরক্ষা মিশনে সুদানের দারফুরে ছিলেন। দায়িত্ব পালন করেন হিউম্যান রাইটস অফিসার, মুভকন অফিসার ও সর্বশেষ জেন্ডার অফিসার হিসেবে। ২০১৪ সালে শান্তিরক্ষা মিশন থেকে ফেরার পর তাকে ১১ এপিবিএনে পদায়ন করায়, সেখান থেকে রিক্যুইজিশন দিয়ে তাকে সিএমপিতে নিয়ে আসেন তৎকালীন সিএমপি কমিশনার মোহাঃ শফিকুল ইসলাম। এরপর ২০১৪ সালের ৩০ এপ্রিল সদরঘাট থানায় নতুন করে সৃষ্ট পরিদর্শক (তদন্ত) পদে পদায়ন করা হয় মর্জিনা আক্তার মর্জুকে। কাজের স্বীকৃতি হিসেবে ২০১৬ সালের ২৮ এপ্রিল একই থানায় তাঁকে অফিসার ইনচার্জ (ওসি) হিসেবে পদায়ন করা হয়। প্রায় দুই বছর ওসি হিসেবে দায়িত্ব পালনের পর ২০১৮ সালের ২৬ জানুয়ারি মর্জিনাকে সিএমপির বিশেষ শাখায় বদলি করা হয়। বছর দেড়েক দায়িত্বপালনের পর চট্টগ্রাম রেঞ্জ হয়ে কক্সবাজার জেলায় বদলি হন পুলিশ পরিদর্শক মর্জিনা। পরে উখিয়ার ওসি পদে তার পদায়ন হয়। শুধু কক্সবাজার জেলা নয়, পুলিশের চট্টগ্রাম রেঞ্জে এই প্রথম ওসি হিসেবে একজন নারী দায়িত্ব পেয়েছেন। ১৭ বছরের পুলিশ জীবনে অনেক প্রাপ্তি মর্জিনার। ২০১৩ সালে সুদানের দারফুরে শান্তিরক্ষা মিশনে দায়িত্ব পালনে সাফল্যের স্বীকৃতিস্বরুপ ‘শান্তি পদকে’ ভূষিত হন মর্জিনা। মাঠ পর্যায়ে সুনামের সাথে কাজ করা ও পুলিশি তদন্তে দক্ষতার স্বাক্ষর রাখা ও সাহসিকতার জন্য তাকে ‘উইমেন পুলিশ অ্যাওয়ার্ড’ দেওয়া হয়েছে। ২০১৬ সালের ৩১ মার্চ বাংলাদেশ পুলিশে প্রথমবারের মত এই অ্যাওয়ার্ড দেওয়া হয়। ২০১৬ সালের ১৭ মে দেশে কর্মরত একমাত্র নারী ওসি মর্জিনাকে স্মারক কয়েন ও ফুল দিয়ে সংবর্ধিত করতে চট্টগ্রামের সদরঘাট থানায় গিয়েছিলেন উইলিয়াম স্কট কর্টিজি। তিনি যুক্তরাষ্ট্রের ডিপার্টমেন্ট অফ জাস্টিস এর ইন্টারন্যাশনাল ক্রিমিনাল ইনভেস্টিগেটিভ ট্রেনিং অ্যাসিসটেন্ট প্রোগ্রামের সিনিয়র ল এনফোর্সমেন্ট এডভাইজার। থানার প্রধান হিসেবে একজন নারীকে পদায়ন করায় সেসময় সিএমপি কমিশনার ইকবাল বাহার ও বাংলাদেশ পুলিশের প্রশংসাও করেছিলেন উইলিয়াম। ২০১৬ সালের ৯ থেকে ১৩ অক্টোবর স্পেনের বার্সেলোনা শহরে অনুষ্ঠিত হয় ইন্টারন্যাশনাল অ্যাসোসিয়েশন অব উইমেন পুলিশের (আইএডব্লিউপি) ৫৪তম বার্ষিক সম্মেলন। এতে বাংলাদেশ থেকে অংশ নেওয়ার আমন্ত্রণ পান ডিআইজি মিলি বিশ্বাস, সদর দপ্তরের দুইজন এআইজি, ডিএমপির একজন এডিসি ও সিএমপির তৎকালীন পরিদর্শক মর্জিনা। মাঠপর্যায়ে কর্মরত নারী পুলিশ সদস্যদের মধ্যে থেকে একমাত্র প্রতিনিধি হিসেবে এই সম্মেলনে অংশ নেওয়ার সুযোগ পান তিনি।