মাহদী হাসান রিয়াদ

নিস্তব্ধ একটি রাত। ঘড়ির কাঁটায় তখন বারোটা ছুঁইছুঁই। হিশামের মা- বিভোর ঘুমে মগ্ন। নাকডেকে ঘুমচ্ছে। বোধহয় বছর খানেক ঘুমের সাথে কোনো সম্পর্ক ছিলো না ওনার৷ পাশে হেলান দিয়ে ল্যাপটপে টাইপিং করছিলাম আমি৷ মারাত্মক একটি রোগ আছে আমার, হিশামের মা- অবশ্য এই রোগ সম্পর্কে বেশ অবগত। তা- হলো মাথাব্যথার রোগ। বেশিক্ষণ এই যন্ত্রটির দিকে তাকিয়ে থাকলে অমনি মাথাব্যথার আবির্ভাব ঘটে। সেদিনও তাই হলো। চোখের পাতা দু’টি এক করতে পারছিলাম না। বোধহয় ঘুমেরা ছুটি নিয়ে দেশের বাড়ি গিয়েছে বেড়াতে। তা-ও আবার ঈদের ছুটি। বেশ লম্বা ছুটি। উফ্, এতো মহা সমস্যা! কিযে করি? এসময় একটু ভালোবাসা করলে মন্দ কী? হুম, তাই হোক। একটু ভালোবাসায় করি৷

হিশামের মায়ের মাথায় হাতটা রাখলাম। আলতো ভাবে তার সিল্কি চুল গুলো ছুঁয়ে অনেক কিছুই ভাবতে লাগলাম। নিজের ভেতর তখন রাজা-বাদশার ভাব। কিন্তু রাণী ছাড়া যে জমছে না৷ তাকে ছাড়া এ রাজ্য যেনো অপূর্ণ। আমার কাল্পনিক গল্পও তেমন একটা উপভোগ করা যাচ্ছিলো না!

হিশামের মায়ের কঞ্চি বাঁশের মতো নাকের ডগায় চিমটি দিয়ে বসলাম এবার। নড়েচড়ে আবারো ঘুম৷ কমলার কোয়ার মতো হিশামের মায়ের ঠোঁট দু’টো হাতছানি দিয়ে ডাকছিল আমায়। বাকি আট-দশটি ঠোঁটের চেয়ে ওর ঠোঁট দু’টো আলাদা। রয়েছে মুগ্ধ হওয়ার মতো এক ধরণের বিশেষত্ব। যা আমাকে প্রতিনিয়ত আকৃষ্ট করে। আমিও আকৃষ্ট হই। আকৃষ্ট হতে বাধ্য করে ওই ঠোঁট। তার ঠোঁটের চারপাশের বর্ডারে রয়েছে হালকা কালো রেখা। যে রেখা বারংবার উদ্ভুদ্ধ করে একটু ছুঁয়ে দিতে। ঠোঁটে ঠোঁট লাগাতে। আজও ব্যতিক্রম হলো না। আগের পদ্ধতিতে ছুঁয়ে দিলাম। ঠোঁটে ঠোঁট লাগিয়ে ভালোবাসার স্বাদ গ্রহণ করলাম। উফ্, এ স্বাদ যেনো অমৃত।

এবার টানাটানা হরিণী আঁখি দুটো খুললো। ক্লান্তভরা বিরক্তিকর চাহনি। বিষণ্ণার চাহনি। তার কোণা চোখে তীক্ষ্ণ চাহনি যেনো গিলে গিলে খাচ্ছিলো আমায়! হতাশ হলাম। কিন্তু বেহায়া মন কী এসব চাহনি মানে? কখনোই না। কোনো অবস্থাতেই মানে না। বার্গারের মতো তার কপোল দুটো ধরে টানাটানি শুরু করে দিলাম, ফের চোখ খুললো। ঘুমের চোখ স্বাভাবিক লাল’ই থাকে। ওর চোখ যে স্রেফ ঘুমের নয়, রাগেরও বটে। চোখের পর্দা ওঠাতেই যেনো চোখ থেকে অগ্নিশিখা এসে আমার গায়ে লাগলো। ভয় হচ্ছিল, যদি বোম হয়ে ওই চোখ দুটো বিস্ফুরিত হয়! চোখে পানি ছেটাতে হবে। ভালোবাসার পানি। মায়ার পানি। অসহায়ের বেশে বুকভরা আতঙ্ক আর ভয় নিয়ে কাঁপা কণ্ঠে বললাম— এইযে, প্রচণ্ড মাথাব্যথা করছে আমার! কী করবো এখন?
এ কথা বলার পর হাজার বছরের রাগ আর ক্ষোভকে একত্রিত করে বললো— ‘আপনি কী করবেন তা- আমি কী জানি? আমাকে বলছেন কেনো? এতো রাতে ঘুম ভাঙানোর কী প্রয়োজন ছিলো? আমিও তো মানুষ, সারাদিন বাড়ির সবকাজ-কর্ম করে ক্লান্ত, এখন একটু ঘুমতে আসলাম, তাতেও শান্তিতে ঘুমতে পারছি না। ধ্যাত্তারি, ভাল্লাগে না। ইচ্ছে করে মরে যাই।’

– বারে, আমার মাথাব্যথা ওঠলে সবসময় কী করো শুনি? কে আমার মাথা টিপে দেয়? মলম লাগিয়ে দেয় কে? রাত জেগে চৌকিদারের মতো আমাকে পাহাড়া দেওয়া মানুষটি কে ছিলো? কে ছিলো সে?

-উফ্, আমি আর নিতে পারছি না এসব। অসহ্য লাগছে। যান তো, অন্য কোথাও যান। অন্য কাউকে খোঁজে নিন। আমার দ্বারা আর সম্ভব না। বলে দিলুম, কানের পাশে এসে ঘেনঘেন করবেন না। অবস্থা কিন্তু খারাপ হবে।

– ঠিকাছে, গেলাম তাহলে৷ ফিরানোর ব্যর্থচেষ্টা করবা না৷
-হুম, যান তো, যান। আমাকে একটু শান্তি দেন।

শয্যাধার থেকে নেমে সোফায় গিয়ে ঘুমতে লাগলাম। আগেই বলেছিলাম— ‘আমার ঘুমেরা দেশের বাড়ি গিয়েছে ছুটিতে। বলেছে লম্বা ছুটি কাটাবে, ঈদের ছুটি যে।’ অতএব বোকার মতো সোফায় শুয়ে ঘুম তালাশ করাটা নেহাত মূর্খতা ছাড়া আর কিছুই হতে পারে না।

ঘড়ির কাঁটায় তখন একটা বারো মিনিট বাজে। এপাশ-ওপাশ অনেকক্ষণ হামাগুড়ি দিলাম, কিন্তু রাত ফুরচ্ছে না। বোধহয় আজকের রাতটা বাকি রাতগুলোর চেয়ে অনেকটা দৈর্ঘ্য। খুব সহজে ফুরাবার নয়। আবারো ঘড়ির কাঁটায় নজর দিলাম। এবার বাজে মাত্র একটা উনপঞ্চাশ। বারবার ওর কথাগুলো মনে পড়ছিল। একেকটা বাক্য যেনো মিসাইলের রূপ নিয়ে আমার আহত বুকে আঘাত হানতে লাগলো! সেই আঘাতে আমি মরছি না ঠিকই, তবে জ্বলেপুড়ে ছাই হচ্ছিলাম রীতিমতো। বুকটা যেনো সাগরে পরিণত হলো। দুখের সাগর, ক্ষোভের সাগর, হতাশার সাগর, যন্ত্রণার সাগর, বিষণ্ণতার সাগর। ফের ক্ষণেক্ষণে বৃষ্টি হয়েও আত্মপ্রকাশ করতে লাগলো ।

এ বৃষ্টি সে বৃষ্টি নয়, যে বৃষ্টি আকাশ থেকে ঝরে। এ বৃষ্টি ভিন্ন এক বৃষ্টি, যে বৃষ্টি যন্ত্রণা আর বিষণ্ণতার দোহাই দিয়ে দুচোখ বেয়ে-বেয়ে পড়ে।

আচমকা কান্নার সুর কানে লাগলো! কীরে? আমিও তো আওয়াজ করে কাঁদছি না। তাহলে কাঁদছেটা কে? চোখ খুলে তাকাতেই বৈদ্যুতিক খুঁটির মতো দাঁড়িয়ে আছে হিশামের মা-। অপলক তাকিয়ে ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদছে। আমিও বাপু এতো সহজে বশ হচ্ছি না। কম্বল মুড়িয়ে ঘুমের ভান ধরলাম৷ এই সুযোগে খুব ভালো ভাবেই আদায় করে নিতে হবে ভালোবাসা, আমার ন্যায্য পাওনা।

-এই শুনুন, একদম নেকামো করবেন না। জানি; আপনি ঘুমাননি। মুখ থেকে কম্বল সরান।

-এতকিছু শোনার ইচ্ছে নেই, একটু আগে সব ইচ্ছেগুলো মরে গিয়েছে। একজন নারী গলাটিপে হত্যা করেছে আমার ইচ্ছেদের। কারোর কথা শোনার আগ্রহ নেই আমার। কিংবা প্রয়োজনবোধ করছি না।

এ কথা বলার সাথেসাথেই হিশামের মা- ক্রন্দনের মাত্রা আরো বাড়িয়ে দিলো। আহ, কিযে শান্তি। এ যেনো মহা শান্তি। কারোর চোখজল দেখেও যে এতোটা তৃপ্তি পাওয়া যায়, সেদিন রাতেই প্রথম জেনেছিলাম, বুঝেছিলাম।

হিশামের মা- এবার কাছে চলে এলো। খুব কাছে, মাথার পাশে। ঠিক আমার স্টাইলে সে-ও তার কোমল হাতের স্পর্শে আমার চোখ খুলার চেষ্টা করলো। চোখের নিচে তখনো ভেজা! একটু আগেই তো অশ্রুজলে সিক্ত হয়েছে আমার দু’চোখ, এতো তাড়াতাড়ি কী শুকায়?

হিশামের মা- বুঝতে পেরেছে, এ ভেজা কিসের ভেজা। সে অস্থির হয়ে ওঠলো। হাউমাউ করতে লাগলো। আর আমি মনে মনে হাসছি, খুব হাসছি, অনবরত হেসেই যাচ্ছি। এ হাসি সুখের হাসি, দুঃখ ভুলে গিয়ে সুখ পাওয়ার হাসি৷ যন্ত্রণা অবসানের হাসি।

এবার হিশামের মা- নিজেকে আর সামলাতে পারলো না। অমনি জড়িয়ে ধরে বিলাপ ধরে কান্নাকাটি করতে লাগলো। যেনো খুব আপন কাউকে হারিয়ে কাতর সে। ওর এমন পাগলামি দেখে আর ভালোবাসার স্বাদ নিতে পারছিলাম না। মিষ্টি-মধুর ভালোবাসা আস্তে আস্তে তিক্ত হতে লাগলো। তিত করলার স্বাদ চলে আসার আগেই ধরা দিতে হবে। মুখোশ খুলতেই হচ্ছে।
ছদ্মবেশে আর এক সেকেন্ড থাকাটা আমার পক্ষে অসাধ্য প্রায়।

-এই পাগল, কান্না থামাও, আমি ঠিক আছি৷
এভাবে কাঁদতে হচ্ছে কেনো? আমাদের মধ্যে তো কিছুই হয়নি৷ আমরাতো দুষ্টমি করেছি এসব৷ মাঝেমধ্যে এমন দুষ্টমি না করলে যে ভালোবাসার স্বাদ অনুভব করা যায় না। যায় না ভালোবাসাকে ওজন করা। ভালোবাসা মাপার একমাত্র যন্ত্র হচ্ছে রাগ-অভিমান। এই অল্পস্বল্প রাগ-অভিমান না করলে ভালোবাসা পূর্ণতা পায় কীভাবে? হিশামের মা-, আমাদের ভালোবাসা পূর্ণ এখন৷

বেচারি অবশেষে কান্না থামালো। মিটিমিটি হাসছে। হিশামের মাকে দেখতে তখন হুবহু সূর্যমুখী ফুলের মতো লাগছিল।

ঘড়ির কাঁটায় তখন রাত তিনটা বাজে!
– হিশামের মা-, চলো অজু করে আসি। শোকরিয়া আদায় করি মালিকের দরবারে। দো’আ কবুল হওয়ার উপযুক্ত সময় এখন৷

– জ্বি, চলুন। তাই করি৷ দু’ফোঁটা লোনাজল মালিকের কুদরতি কদমে ফেলি।

প্রতিটি পরিবারের রাগ-অভিমান এমন হলে মন্দ কী? রাগ-অভিমানের মাধ্যমে যদি অনাবিল সুখ-শান্তি ফিরিয়ে আনা যায়, তাহলে রাগ করুন, অভিমান করুন৷ ক্ষতি কিসের?
তবে, অতটা অভিমান করবেন না, যতটা অভিমান করলে সে দূরে চলে যায়, আপনার ভালোবাসাকে ভুলে যেতে বাধ্য হয়, পরিশেষে ভিন্ন শহরের ভিন্ন এক মানবের সাথে যেনো সে বসতবাড়ি বেঁধে না ফেলে!