সিবিএন ডেস্ক:

>> বৃহস্পতিবার জরুরি বৈঠক ডেকেছে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়
>> যেকোনো মূল্যে করোনাভাইরাসের প্রবেশ ঠেকাতে চায় সরকার
>> করোনার প্রভাব দীর্ঘমেয়াদি হলে বাণিজ্য বাধাগ্রস্তের আশঙ্কা

চীন থেকে ছড়িয়ে পড়া প্রাণঘাতী করোনাভাইরাস আতঙ্কে সারা বিশ্ব। তাই বিশ্বের বেশকিছু দেশ ইতোমধ্যে চীনের সঙ্গে নানা ধরনের সংযোগ বিছিন্ন করেছে। বর্তমানে দেশটির সঙ্গে সবচেয়ে বেশি আমদানি-রফতানি বাণিজ্য হওয়ায় আতঙ্কিত বাংলাদেশও। এ বিষয়ে করণীয় ঠিক করতে বৃহস্পতিবার (৬ ফেব্রুয়ারি) প্রথমবারের মতো জরুরি বৈঠকে বসছে সরকার। বাণিজ্য মন্ত্রণালয় সূত্রে এসব তথ্য জানা গেছে।

চীনে করোনাভাইরাসের প্রাদুর্ভাব এতটাই বেড়েছে যে, অধিকাংশ কারখানা ও অফিস বন্ধ ঘোষণা করেছে দেশটির সরকার। এ ভাইরাস যাতে নিজেদের দেশে না আসে সেজন্য ইতোমধ্যে ভারতসহ বেশ কয়েকটি দেশ চীনে ইস্যু ভিসা বাতিলের পাশাপাশি নিয়মিত ফ্লইট বাতিল করেছে। বাংলাদেশও এ বিষয়ে কড়াকড়ি আরোপ করেছে। তবে এখনও ভিসা বাতিল বা ফ্লাইটে নিষেধাজ্ঞা দেয়নি।

এদিকে বর্তমানে চীনের সঙ্গে বাংলাদেশের সবচেয়ে বেশি আমদানি-রফতানি বাণিজ্য হচ্ছে। আমদানি-রফতানির ফাঁকে বাংলাদেশে করোনাভাইরাস প্রবেশ করে কি-না, সে বিষয়টি নিয়ে আতঙ্কিত সবাই। করোনাভাইরাস যাতে কোনোভাবেই বাংলাদেশে প্রবেশ করতে না পারে এ জন্য করণীয় ঠিক করতে প্রথমবারের বৃহস্পতিবার (৬ ফেব্রুয়ারি) বেলা সাড়ে ১১টায় বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের সভাকক্ষে বাণিজ্য সচিব ড. মো. জাফর উদ্দীনের সভাপতিত্বে জরুরি এক আন্তমন্ত্রণালয় সভার আয়োজন করা হয়েছে।

সভায় স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের প্রতিনিধি, রোগতত্ত্ব, রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা প্রতিষ্ঠানের প্রতিনিধি, পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের প্রতিনিধি, বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রতিনিধি, এনবিআরের প্রতিনিধি, ব্যবসায়ীদের শীর্ষ সংগঠন এফবিসিসিআইয়ের প্রতিনিধিসহ অন্যান্য ব্যবসায়ী নেতা ও সরকারের অন্যান্য স্টেকহোল্ডারের প্রতিনিধিরা উপস্থিত থাকবেন।

এ বিষয়ে জানতে চাইলে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব (আমদানি ও অভ্যন্তরীণ বাণিজ্য) মো. শাখাওয়াত হোসেন জাগো নিউজকে বলেন, ‘চীন থেকে আমাদের দেশে অনেক ধরনের পণ্য আমদানি হয়। এক্ষেত্রে করোনাভাইরাস-সংক্রান্ত কী ধরনের ঝুঁকি আছে সেটা পর্যালোচনার জন্য সরকারি ও বেসরকারি বিভিন্ন স্টেকহোল্ডারদের সঙ্গে আমরা বৃহস্পতিবার বৈঠক করবো। কারণ এই ঝুঁকি নির্ধারণ করে আমাদের সে অনুযায়ী ব্যবস্থা নিতে হবে।’

তিনি আরও বলেন, ‘পণ্যের চেয়ে দেশের মানুষ বড়। যদি আমরা দেখি এ বিষয়টিতে দীর্ঘ বা স্বল্প মেয়াদি ব্যবস্থা গ্রহণ করা প্রয়োজন, তাহলে আমরা সে অনুযায়ী ব্যবস্থা নেব। চীন থেকে কোনো ভোগ্যপণ্য বা এসব পণ্য আনতে গিয়ে যদি করোনাভাইরাস আসার ঝুঁকি থাকে, তাহলে সেসব ক্ষেত্রে আমরা সাময়িক রেস্ট্রিকশন (বিধিনিষেধ) আরোপ করতে পারি।’

শাখাওয়াত হোসেন বলেন, ‘এ ভাইরাস শুধু মানুষের মাধ্যমেই ছড়াই। তবে পণ্য আমদানি-রফতানিতে মানুষের প্রয়োজন হয়, এ বিষয়গুলোই আলোচনা করবো। পণ্যের পাশাপশি কিছু জীবজন্তুও আমদানি হয়। সেগুলোর সঙ্গে করোনাভাইরাস ছড়ায় কি-না সেটা আলোচনায় উঠে আসবে।’

এদিকে চীনে দ্রুত ছড়িয়ে পড়া করোনাভাইরাসের বিরূপ প্রভাব দীর্ঘমেয়াদি হলে বাংলাদেশের আমদানি-রফতানি বাণিজ্যে ঝুঁকি তৈরি হতে পারে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে। বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের তথ্য মতে, এ মুহূর্তে চীনের সঙ্গে বাংলাদেশের সবচেয়ে বেশি আমদানি-রফতানি বাণিজ্য হচ্ছে। এছাড়া গত ১০ বছরে একক দেশ হিসেবে চীন সবচেয়ে বেশি বিনিয়োগ করেছে বাংলাদেশে।

এছাড়া পদ্মা সেতু, কর্ণফুলী টানেল ও পায়রা বন্দরসহ বড় বড় অবকাঠামো খাতে কাজ করছেন চীনা নাগরিকরা। সব মিলিয়ে এদেশে চীনের প্রায় ১০ হাজার নাগরিক বিভিন্ন ব্যবসা ও পেশায় নিয়োজিত। চীনের করোনাভাইরাসের প্রভাব দীর্ঘমেয়াদি হলে কীভাবে বাংলাদেশের ব্যবসা-বাণিজ্যকে সুরক্ষা দেয়া যাবে সে বিষয়ে করণীয় নির্ধারণ করতে এ বৈঠক অনুষ্ঠিত হচ্ছে।

জানা গেছে, বাংলাদেশের বিভিন্ন প্রকল্পে নিয়োজিত চীনের নাগরিকদের আপাতত নিজ দেশে না যাওয়ার পরামর্শ দেয়া হচ্ছে। পদ্মা সেতু, কর্ণফুলী টানেল ও পায়রাবন্দরসহ বড় বড় প্রকল্পে নিয়োজিত চীনা নাগরিকরা যারা নববর্ষ উদযাপনে দেশে গেছেন, তাদের আপাতত না আসার জন্য অনুরোধ করা হয়েছে। যারা একান্ত প্রয়োজনে চীন থেকে আসছেন তাদের স্বাস্থ্য অধিদফতরের আওতায় রোগতত্ত্ব, রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা প্রতিষ্ঠানে (আইইডিসিআর) পরীক্ষা-নিরীক্ষা করা হচ্ছে। ১৪ দিন বিশেষ পর্যবেক্ষণে রেখে তাদের কাজে যাওয়ার অনুমতি দেয়া হচ্ছে।

দেশের অর্থনীতিতে এখনই এই ভাইরাসের কোনো ক্ষতিকারক প্রভাব পড়বে না বলে মনে করেন বাণিজ্যমন্ত্রী টিপু মুনশি। এ বিষয়ে বাংলাদেশ শুরু থেকে সতর্ক অবস্থানে রয়েছে বলে জানিয়েছেন তিনি।

সম্প্রতি সাংবাদিকদের এক প্রশ্নের জবাবে বাণিজ্যমন্ত্রী বলেন, চীনের সঙ্গে বাণিজ্যের ক্ষেত্রে এখন পর্যন্ত কোনো নেতিবাচক প্রভাব ফেলেনি করোনাভাইরাস। তবে পুরো পরিস্থিতি সরকারের পর্যবেক্ষণে রয়েছে। পরিস্থিতির ওপর নির্ভর করে পরবর্তী সিদ্ধান্ত নেয়া হবে।

সূত্র জানায়, করোনাভাইরাসের প্রভাব দীর্ঘমেয়াদি হলে বাংলাদেশের আমদানি-রফতানি বাণিজ্য বাধাগ্রস্ত হতে পারে। দৈনন্দিন প্রয়োজন মেটানোর প্রয়োজনীয় উপকরণসহ সব ধরনের শিল্পের কাঁচামাল ও যন্ত্রপাতি আমদানি হয় চীন থেকে। এই বাণিজ্যের পরিমাণ প্রায় ১৮ বিলিয়ন ডলার। অন্যদিকে পোশাক, চামড়াসহ বেশকিছু পণ্য রফতানি হয় চীনে। এ কারণে করোনাভাইসের প্রভাব দীর্ঘমেয়াদি হলে বাংলাদেশের অর্থনীতিতে নেতিবাচক প্রভাবের আশঙ্কা করা হচ্ছে।

এদিকে করোনাভাইরাস প্রতিরোধ ও বিস্তার ঠেকাতে বিদেশি দাতাদের পাঠানো স্বাস্থ্য সামগ্রীর ওপর আমদানি শুল্ক বাতিল করেছে চীন। আগামী ৩১ মার্চ পর্যন্ত দাতাদের পাঠানো এসব সামগ্রী আমদানি শুল্কমুক্ত থাকবে বলে গত ১ ফেব্রুয়ারি দেশটির সাধারণ শুল্ক প্রশাসন (জিএসি) ঘোষণা দিয়েছে।

জানা গেছে, বাংলাদেশ থেকে রফতানিজাত বিভিন্ন পণ্যের কাঁচামালের প্রায় ৭০ শতাংশ আসে চীন থেকে। কিন্তু বর্তমানে এসব কাঁচামাল আমদানি কার্যক্রম বাধার মুখে রয়েছে। আবার বড় বড় অবকাঠামোতে উন্নয়ন কাজের ঠিকাদার প্রকৌশলীসহ যন্ত্রপাতিও আনা হয় চীন থেকে। এসব প্রকল্পের কাজও বন্ধ হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে।

এ পরিস্থিতিতে আমদানির ক্ষেত্রে চীনের বিকল্প বাজার খুঁজতে শুরু করেছেন অনেক ব্যবসায়ী। এছাড়া অর্থনীতিবিদরা মনে করেন, করোনাভাইরাসের কারণে চীনের পর সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে বাংলাদেশ। কারণ বাংলাদেশের ব্যবসা-বাণিজ্য, তথা অর্থনীতির একটা বড় অংশ চীনের সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িত।

বাণিজ্য মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে, দ্বিপক্ষীয় বাণিজ্যে চীন সব সময় বড় অংশীদার। করোনাভাইরাসের বিষয়ে শুরু থেকে সতর্ক অবস্থানে রয়েছে বাংলাদেশ। সংশ্লিষ্ট প্রতিটি মন্ত্রণালয় ও বিভাগ এ বিষয়ে ইতোমধ্যে কাজ শুরু করেছে। করোনা ভাইরাসের কোন প্রভাব যাতে ব্যবসা-বাণিজ্যে আঘাত না হানে সেজন্য করণীয় ও কর্মকৌশল গ্রহণ করা হচ্ছে। এ বিষয়ে যা যা করণীয় সব কিছু করবে সরকার।

উল্লেখ্য, প্রাণঘাতী করোনাভাইরাসে চীনে একদিনে আরও ৬৫ জনের মৃত্যু হয়েছে। ফলে চীনের মূল ভূখণ্ড ও এর বাইরে মৃতের সংখ্যা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৪৯২ জন। মঙ্গলবার (৪ ফেব্রুয়ারি) চীনে নতুন করে এই ভাইরাসে আক্রান্ত হয়েছে আরও ৩ হাজার ৮৮৭ জন। অর্থাৎ এখন পর্যন্ত চীনে প্রতিষেধকবিহীন এ ভাইরাসে ২৪ হাজার ৩২৪ জন আক্রান্ত হয়েছে।