Saimoun Morshed Riad

আমি মাঝে মাঝে কোন বিষয়বস্তু ছাড়াই লিখতে শুরু করি। এই যে এই মুহূর্ত পর্যন্ত আমি জানিনা, আমি আসলে কি নিয়ে লিখতে যাচ্ছি। তবে কিছু একটা লিখছি। কিছু একটা লিখবো।
আমি মানুষের জন্য লিখালিখি করে আনন্দ পাই। মানুষকে তার জীবনের সাথে নিজের ঘনিষ্ঠতাকে বুঝাতে চাই। জীবনের প্রতি বোধ জন্মানোর চেষ্টা করি। এসবের বাইরেও আমি মাঝে মাঝে নিজের জন্য লিখি। কাউকে কিছু বলবার উদ্দেশ্যে নয়। কোন কারন নেই। স্রেফ নিজের সাথে নিজের একটা আলোচনা করবার জন্য লিখি। এটা অনেকটা নিজের সাথে নিজের কথা বলবার মতনই একটা ব্যপার।

আমি জীবনের একটা পর্যায়ে এসে খেয়াল করেছি, আমার আসলে নিজের কোন বন্ধু নেই। হয়নি কখনো; অথবা সুযোগ হয়নি কারো সাথে আমার নিজস্ব ডেফিনেশনের মতন করে বন্ধুত্ব গড়ে তোলবার। এটা নিয়ে আমার আফসোস নেই। এটা নিয়ে আমার ভেতর কোন হাহাকার নাই। কোন অনুশোচনা নাই। বন্ধু বানানো নিয়ে আমার ভেতর কখনোই তেমন কোন আগ্রহ ছিলনা। যেসব গল্প, ঘটনা, দুঃখবোধ ও আনন্দের উদ্দিপনা মানুষ বন্ধুদের কাছে শেয়ার করে, সেসব গল্প, ঘটনা ও হতাশার কথা আমি নিজেকে শুনিয়েছি। বলে বলে হালকা হয়েছি। কেঁদেছি। হেসেছি। নিজেকে নিজেই সাহস দিয়েছি। ক্লান্তিতে নিজের কাঁধে নিজেই হাত রেখে ভরসা যুগিয়েছি। দুঃখ ও গ্লানিতে নিজের জন্য মন খারাপ করেছি। বিষন্ন হয়েছি। একটা সময় এসে টের পেয়েছি, আমি নিজেই আমার সবচেয়ে কাছের বন্ধু। যাকে ভরসা করে একটা অতি গোপন দুঃখ বলে দেওয়া যায়।
তাই মাঝে মাঝে এই ভার্চুয়াল প্লাটফর্মকে আমি নিজস্ব মানচিত্রের ছায়া সংসদ বানিয়ে নিজের পক্ষে এবং বিপক্ষে কথা বলি।

কিছু মানুষ হয়, যারা কথা বলবার মতন মানুষ না পেয়ে নিজের ভেতর নিজেই একটি যত্নহীনতায় আক্রান্ত চারা গাছের মতন নুয়ে যেতে যেতে একসময় মরে যায়, শুকিয়ে যায়, মাটির সাথে মিশে যায়। আমি সেসব গাছ হইনি কখনো। হতে চাইনি। আমি সেই বিশাল অরণ্যে মাথা উচু করে দাঁড়িয়ে থাকা গাছ হতে চেয়েছিলাম, যার কখনো যত্নের প্রয়োজন হয়না। সে নিজে নিজেই প্রকৃতির ঝড় ঝাপ্টা সয়ে সয়ে ডালপালা ভেঙেচূরে বড় হতে হতে অরণ্যের সবচেয়ে সুঠাম দেহের অধিকারী গাছ হয়ে যায়।
বারান্দায় যত্নে বেড়ে উঠা বৃক্ষটির চেয়ে বেশি শক্তিশালী হয়ে উঠে গহীন অরণ্যে যত্নহীনতায় বেড়ে উঠা গাছটি। যে নিজে বেঁচে বেঁচে নিজের ভেতর আরো কিছু আগাছাকেও বাঁচিয়ে রাখে। এই তো আমার বেঁচে থাকবার ধরন। এটাই আমার টিকে থাকবার রহস্য।

আমার নিজের কোন বন্ধু হয়নি বলে, আমি কখনো নিঃসঙ্গ হয়ে যাইনি। একা হয়েছি বহুবার, নিঃসঙ্গ নয়। মানুষ আসলে কখনো নিঃসঙ্গ হতে পারেনা। মানুষকে তার নিজের সাথে সঙ্গ দিতে হয় প্রতিনিয়ত। এটা সবচেয়ে বেশি টের পাওয়া যায় অবসরে। অবসরে মানুষ অবচেতন ভাবেই তার নিজের সাথে খেলা করে। কথা বলে। নিজেকে আনন্দ দেয়। নিজেকে দুঃখী করে তোলে। বাইরের মানুষ আমাদের যত’টা দুঃখ দেওয়ার ক্ষমতা রাখে, তারচেয়ে অনেক বেশি দুঃখ আমরা আমাদের নিজেদের দেই। এই দুঃখ দেওয়ার ভেতরও একটা আনন্দ আছে। নিজেকে কিছু একটা দিতে পারার আনন্দ। আমরা দুঃখী হয়ে, নিজেকে বোধয় সেই দেওয়ার আনন্দটাই উপলব্ধি করাতে চাই।

আমি বিশেষ বিশেষ দিনগুলোতে একা হয়ে যাই। যেসব আনন্দের দিনগুলোতে সবাই হইহুল্লোর করে, আমি সেসব দিনে ঘরকুণো হয়ে বসে থাকি। আমার যেহেতু তেমন কোন বন্ধু হয়নি কখনো, তাই কারো সাথে সময় খরচ করবার মতন সুযোগও আমার নেই। বন্ধু নেই মানে, একেবারেই কেউ নেই; তেমনটাও না। বেশিরভাগ মানুষ যাদের বন্ধু হিসেবে চেনে, তেমন বন্ধু আমার জীবনে অন্য মানুষদের তুলনায় বেশি আছে। আমি কেন জানি সেসব মানুষে স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করিনা। এটা খুব সম্ভবত আমার নিজেরই চিন্তার সীমাবদ্ধতা অথবা আমি কোন এক অজানা কারনে বিশেষ বিশেষ দিনগুলোতে নিজেকে একা রাখতে ভালোবাসি।

আমি খুব সম্ভবত অদ্ভুত কোন কারনে মাঝে মাঝে একা পথে হাটি, একদম একা। একটা খুচরো পয়সাও যাতে না থাকে পকেটে। আমার মাঝে মাঝে ভীষন ভাবে জীবন দেখতে ইচ্ছে হয়। এমন ভাবে পথে পথে ঘুরতে থাকি, যেন কেবল একটি মৌলিক মানুষ পৃথিবী দেখতে বের হয়েছে। যার কোন অর্থ সম্পদ নাই। কর্পোরেট স্বীকৃতি নাই। কোন পারিবারিক টান নাই। কোন রূপবতীর জন্য মায়া নাই। আমার ঘর নাই। সংসার নাই। নিজেরে ছাড়া, নিজের সাথে আর একটা কিছুও নাই। যেন কেবল আস্ত একটা মানুষ হেটে যাচ্ছে খোলা পায়ে মাটি ছুয়ে ছুয়ে।

আমার আসলে জীবনে কখনো বন্ধু হয়নি। অথচ, কি ভীষন ভাবে সবচেয়ে কাছের বন্ধুর মতন বিশ্বস্ততা নিয়ে নিজেকে সেই বন্ধুর জায়গাটি দিয়েছি। আমি ছাড়া আমারে আর কে ঠকাতে পারে? কে ভাংতে পারে? কে দিতে পারে দুঃখ। যন্ত্রনা। আনন্দ ও ব্যথা।

আমি ছাড়া আমারে দুঃখ দেওয়ার আর কোন মানুষ নাই।
যারা এসেছিলো, এসেছে কিংবা আসবে; তারা সুখী হওয়ার জন্য আসে। দুঃখ দেওয়ার জন্য নয়। আমরাই তাদের চলে যাওয়াতে দুঃখ বানিয়ে বানিয়ে নিজেকে দুঃখী করে রাখি।

যাইহোক, কোন বিষয়বস্তু মাথায় না নিয়ে লিখতে লিখতে ক্লান্ত লাগছে। এখন আর কিছু বলবার ইচ্ছা নাই। লিখবার আগ্রহ নাই।
মানুষের প্রতি মানুষের আগ্রহ নষ্ট হয়ে গেলে যেমন মানুষ আর জীবনে থাকেনা; নিজেকে প্রকাশ করবার আগ্রহ নষ্ট হলে, মানুষ আর কথা বলতে চায়না।

আমার আগ্রহ শেষ; লেখার গতির মৃত্যু তাই এখানেই অনিবার্য।