মুহাম্মদ আবু সিদ্দিক ওসমানী :

কক্সবাজার জেলা পুলিশের ব্যবস্থাপনায় আগামী সোমবার ৩ ফেব্রুয়ারী টেকনাফ সরকারি ডিগ্রি কলেজ মাঠে ইয়াবাকারবারীদের আত্মসমর্পণ অনুষ্ঠানের প্যান্ডেল, স্টেজ, লাইটিং, নিরাপত্তা বেষ্টনী তৈরীর কাজ পুরোদমে এগিয়ে চলছে। প্রায় একশ’ শ্রমিক দিবারাত্রি ২ শিফটে কাজ চালিয়ে যাচ্ছে। ডেকোরেশনের মালামাল টেকনাফ ছাড়াও উখিয়া এবং কক্সবাজার থেকেও নেওয়া হচ্ছে। টেকনাফ মডেল থানা পুলিশ সরাসরি এ কাজ তদারকি করছে। ভিভিআইপি, আমন্ত্রিত অতিথি সহ ৫/৬ শ’ মানুষ অনায়সে সেখানে বসার মতো করে প্যান্ডেলটি নির্মাণ করা হচ্ছে। আগত অতিথিদের নিরাপত্তা, অভ্যর্থনা, প্রটোকল, ইয়াবাকারবারীদের জমায়েত, তাদের ইয়াবা, অস্ত্র, গোলাবারুদ জমা করা, যাতায়াত সুবিধা, পার্কিং, প্যান্ডেল, মঞ্চ তৈরি, নিরাপত্তা বেষ্টনী, আইনশৃংখলা রক্ষাকারী বাহিনীর অবস্থান ইত্যাদি সার্বিক বিষয় মাথায় রেখে রেকি ও ম্যাপ মতো সবকিছু পরিকল্পিতভাবে তৈরি করা হচ্ছে। জেলা পুলিশের উর্ধ্বতন কর্মকতারা আত্মসমর্পণ অনুষ্ঠানস্থল ইতিমধ্যে পরিদর্শন করেছেন। সোমবারের আত্মসমর্পণ অনুষ্ঠান সার্বিক তত্বাবধানে থাকা উখিয়া সার্কেলের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার নিহাদ আদনান তাইয়ান সিবিএন-কে এসব তথ্য জানিয়েছেন।

একইসাথে মধ্যস্থতাকারীর নিয়ন্ত্রণে চলে আসা ২৩ জন ইয়াবাকারবারী ও মাস্টার হুন্ডি-বিকাশ ব্যবাসায়ী ইয়াবা ও অস্ত্র সহ সোমবার আত্মসমর্পণের পর কারাগারে যাওয়ার জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছেন। প্রায় ১০ মাস ধরে আত্মসমর্পণের জন্য কক্সবাজার পুলিশ লাইনের আশেপাশের এলাকায় মধ্যস্থতাকারীর হেফাজতে থাকা ১৮ জন ইয়াবাকারবারীদের সাথে দেখা করছেন আত্মীয় স্বজন, বন্ধু-বান্ধবেরা। বিদায় নিচ্ছেন কারাগারে যাওয়ার আগে। শীত মওসুমের কথা চিন্তা করে পরিধেয় কাপড় চোপড়, ওষুধ পত্র গুছিয়ে নিচ্ছেন তারা। আত্মসমর্পণ করতে মধ্যস্থতাকারীদের নিয়ন্ত্রণে চলে আসার সংখ্যা আপাতত ২৩ জন হলেও সোমবার সকাল পর্যন্ত আত্মসমর্পণের সুযোগ থাকায় এ সংখ্যা আরো বাড়তে পারে। আত্মসমর্পণ অনুষ্ঠানের শৃংখলার প্রয়োজনে সোমবার সকালের পরে আর কোন আত্মসমর্পণকারী মধ্যস্থতারীর নিয়ন্ত্রণে আনা হবেনা বলে সিবিএন-কে বিশ্বস্ত সুত্র জানিয়েছেন।

আত্মসমর্পণে আগ্রহী অনেক ইয়াবাকারবারী ও হুন্ডি-বিকাশ কারবারি আগে থেকে আত্মসমর্পণ অনুষ্ঠানের তারিখ নির্ধারনের অপেক্ষায় ছিলো। এখন তারিখ নির্ধারণ হওয়ায় অপেক্ষায় থাকা এরকম আগ্রহীরা মধ্যস্থতাকারীদের নিয়ন্ত্রণে আসার জন্য তাদের সাথে যোগাযোগ করছে বলে বিশ্বস্থ সুত্র সিবিএন-কে জানিয়েছেন। তবে ২০১৯ সালে ১৬ ফেব্রুয়ারী আত্মসমর্পণকৃত ১০২ জন ইয়াবাকারবারী আত্মসমর্পণের শর্ত মতে সরকারের কাছ কোন অনুকম্পা না পাওয়ায় অনেকে প্রস্তুতি থাকা সত্বেও আত্মসমর্পণ করতে এখন অনীহা প্রকাশ করছে। তবে, মধ্যস্থতাকারীর হেফাজতে আসা ২৩ জন আত্মসমর্পণকারীর প্রোফাইল ইতিমধ্যে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের জন নিরাপত্তা বিভাগ, পুলিশ সদর দপ্তর, চট্টগ্রাম ডিআইজি’র কার্যালয় সহ উর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের কাছে প্রেরণ করা হয়েছে বলে বিশ্বস্থ সুত্র সিবিএন-কে নিশ্চিত করেছেন।

কক্সবাজার জেলা পুলিশ আয়োজিত এই অনুষ্ঠানে কক্সবাজারের পুলিশ সুপার এ.বি.এম মাসুদ হোসেন বিপিএম সভাপতিত্ব করবেন। পুলিশের চট্টগ্রাম রেঞ্জের ডিআইজি খন্দকার গোলাম ফারুক বিপিএম (বার) পিপিএম আত্মসমর্পণ অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত থাকবেন। পুলিশের চট্টগ্রাম রেঞ্জের অতিরিক্ত ডিআইজি (অপারেশন এন্ড ক্রাইমস) মোঃ জাকির হোসেন খান পিপিএম, কক্সবাজারের জেলা প্রশাসক মোঃ কামাল হোসেন, কক্সবাজার জেলা আওয়ামীলীগের সভাপতি এডভোকেট সিরাজুল মোস্তফা, সাধারণ সম্পাদক মেয়র মুজিবুর রহমান, টেকনাফের ইউএনও সাইফুল ইসলাম, কমিউনিটি পুলিশিং এর কক্সবাজার জেলা সভাপতি, সিনিয়র সাংবাদিক এডভোকেট তোফায়েল আহমদ অতিথি হিসাবে উপস্থিত থাকবেন। বিষয়টি কক্সবাজার জেলা পুলিশের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (প্রশাসন) মোহাম্মদ ইকবাল হোসাইন সিবিএন-কে নিশ্চিত করেছেন।

অনুষ্ঠানে যোগদিতে পুলিশের চট্টগ্রাম রেঞ্জের ডিআইজি খন্দকার গোলাম ফারুক বিপিএম (বার) পিপিএম রোববার ৩ ফেব্রুয়ারী সকালে কক্সবাজার পৌঁছাবেন বলে সুত্রটি সিবিএন-কে জানিয়েছেন। সুত্রমতে, ইয়াবাকারবারিরা ইয়াবা, অবৈধ অস্ত্র, গোলাবারুদ সহ আনুষ্ঠানিকভাবে আত্মসমর্পণ করতে রাজি হয়েছেন।

আত্মসমর্পণকারীদের স্বাভাবিক জীবনে ফিরে আসতে রাষ্ট্রীয় উদ্যোগে তাদেরকে প্রনোদনা দেওয়া হতে পারে বলে একটি সুত্রটি সিবিএন-কে জানিয়েছেন। তাদের বিরুদ্ধে আত্মসমর্পণের পর মাদক ও অস্ত্র আইনে পৃথক ২ টি মামলা দায়ের করে তাদেরকে আদালতের মাধ্যমে কারাগারে পাঠানো হবে। তবে এ মামলা থেকে আত্মসমর্পণকারীরা সহজে মুক্তি পেতে মামলা পরিচালনায় রাষ্ট্রপক্ষ তাদেরকে সহযোগিতা করবে।

সুত্র মতে, দ্বিতীয় দফায় আত্মসমর্পণ করতে যাওয়া ইয়াবাকারবারীর সংখ্যা ৩০ জনের বেশি হবেনা। তবে আত্মসমর্পণকারীর সংখ্যা এখন সুনির্দিষ্ট করে বলা যাচ্ছেনা বলে সুত্রটি সিবিএন-কে জানিয়েছেন।

এর আগে ২০১৯ সালের ১৬ ফেব্রুয়ারি টেকনাফের শীর্ষ ১০২ ইয়াবাকারবারী স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল এমপি ও পুলিশের মহাপরিদর্শক ড. মোহাম্মদ জাবেদ পাটোয়ারী বিপিএম (বার) এর কাছে আত্মসমর্পণ করেছিলো। তাদের মধ্যে কক্সবাজার-৪ আসনের সাবেক সংসদ সদস্য আবদুর রহমান বদির চার ভাইও ছিল। এটি হবে টেকনাফে ইয়াবাকারবারীদের ২য় দফায় আত্মসমর্পণ। সেবারের মাদক কারবারী আত্মসমর্পণ করা ছিলো এ দেশের জন্য একটা ইতিহাস ও রেকর্ড। এই ১০২ ইয়াবাকরবারীর মধ্যে একজন কারাগারে মারা যায়। বাকি ১০১ জনের বিরুদ্ধে আদালতে অভিযুক্তপত্র (চার্জশীট) দাখিল করে টেকনাফ মডেল থানা পুলিশ।

সুত্র মতে, ইয়াবাকারবারিদের আত্মসমর্পণের সুযোগ দেওয়া হলেও মাদক বিরোধী নিয়মিত অভিযানে কোনও শিথিলতা আসবে না। বরং আরো তীব্রতর করা হবে। আত্মসমর্পণের আওতায় না এসে ইয়াবাকারবারিরা কৌশলে সক্রিয় হওয়ার চেষ্টা করলে তাদের পরিণতি হবে আরো ভয়াবহ।

প্রসঙ্গত, ২০১৮ সালের মে থেকে ২০১৯ সালের ৩১ ডিসেম্বর পর্যন্ত বিশেষ অভিযানে ইয়াবাকারবারি, ডাকাত ও সন্ত্রাসীদের সঙ্গে কথিত বন্দুকযুদ্ধের ঘটনায় ৫৬ জন রোহিঙ্গাসহ ২০৯ জন ইয়াবাকারবারি ও ডাকাত-সন্ত্রাসী নিহত হয় কক্সবাজার জেলায়। পাশাপাশি গত বছর ১ কোটি ৬৯ লাখ ২৬ হাজার ৫৭০ পিস ইয়াবাসহ ২ হাজার ৩৩৮ জনকে আটক এবং বিপুল পরিমাণ অস্ত্র উদ্ধার করেছে আইনশৃংখলা রক্ষাকারী বাহিনী। ফলে ২০১৯ সালের মতো ২০২০ সালেও জাতীয় পুলিশ সপ্তাহে কক্সবাজারের পুলিশ সুপার এ.বি.এম মাসুদ হোসেন বিপিএম (বার) দ্বিতীয় বারের মতো বিপিএম (সেবা) পদক পেয়েছেন। সর্বোচ্চ অস্ত্র ও মাদক দ্রব্য উদ্ধারকারী জেলা হিসাবেও পেয়েছেন ২ টি আইজিপি পদক ও সম্মাননা।