শাহেদ মিজান, সেন্টমার্টিন থেকে ফিরে:
দেশের একমাত্র প্রবাল দ্বীপ সেন্টমার্টিন। স্বচ্ছ নীল জলরাশি, কেয়াবন, পাথুরে সৈকত, প্রবাল, শৈবালসহ বিস্ময়কর সব জীব-বৈচিত্রের এক অসাধারণ সমারোহ রয়েছে এই দ্বীপে। এসব সমারোহ দ্বীপটিকে দিয়েছে অসাধারণ সৌন্দর্য্য; যার মায়াজালে বিভোর হয়ে সেখানে ছুটে যায় দেশি-বিদেশি পর্যটকরা। কিন্তু নানা হুমকির দিকে এগিয়ে যাচ্ছে দ্বীপটি। এর মধ্যে বর্তমানে সবচেয়ে ঝুঁকি হয়ে দাঁড়িয়েছে দ্বীপের পরিবেশগত দিকটি। এই ঝুঁকিটি দিনে দিনে প্রকট আকার ধারণ করছে। তবুও ঝুঁকি রোধে কার্যত কোনো কার্যক্রমই নেই পরিবেশ অধিদপ্তরের। এতে দ্বীপবাসী এবং পরিবেশবাদীরা হতাশ হয়ে পড়েছেন।
দ্বীপবাসী এবং পরিবেশবাদীরা দাবি করছেন, পর্যটনের চাপের কারণে সেন্টমার্টিন প্রবল ঝুঁকির মুখে পড়েছে- যা দেশের অন্য কোনো দ্বীপ বা পর্যটন কেন্দ্র থেকে সবচেয়ে বেশি। তবে আশ্চর্য্য হলেও সত্য, এই দ্বীপ নিয়ে পরিবেশ অধিদপ্তরের বেশি অবহেলা। বতর্মানে এই দ্বীপে পরিবেশ অধিদপ্তরের যে কার্যকম রয়েছে এটিকে তাদের ‘পুতুল খেলা’ বলে অবহিত করা হচ্ছে।
সেন্টমার্টিন ইউনিয়ন পরিষদের সাবেক প্যানেল চেয়ারম্যান আবদুল হক এই প্রতিবেদককে বলেন, ‘সেন্টমার্টিনের পরিবেশগত হুমকি দিন দিন চরম হয়ে উঠলেও পরিবেশের অধিদপ্তরের ঘুম ভাঙছে না। বরং তারা আরো ঝিমিয়ে পড়ছে। কয়েকটি সাইনবোর্ড আর কালেভাদ্রে কয়েকটি সভা-সেমিনারেই তাদের কার্যক্রম সীমাবদ্ধ। সেন্টমার্টিন নিয়ে দেশের শীর্ষ পর্যায়ে পরিবেশবাদী এবং সচেতন মহল পর্যন্ত উদ্বিগ্ন। কিন্তু এখনো এই দ্বীপ নিয়ে পুতুল খেলছে পরিবেশ অধিদপ্তর।’
সরেজমিন ঘুরে জানা গেছে, পরিবেশ মন্ত্রণালয়ের নিষেধাজ্ঞাার পরও সৈকতে নির্বিগ্নে চলছে বাইকেল ও মোটর সাইকেল। এর ফলে কাঁকড়া, শামুক-ঝিনুকসহ সৈকতে বিচরণত বিভিন্ন প্রাণী মারা পড়ছে। কিন্তু সৈকতের কয়েকটি পয়েন্টে কয়েকটি ‘নিষেধাজ্ঞার সাইনবোডর্’ টানিয়েই দায় সেরেছে পরিবেশ অধিদপ্তর। প্রশাসনিক কোনো কার্যক্রম না থাকায় অনায়সে পর্যটকেরা সৈকতে বাইকেল ও মোটর সাইকেল চালাচ্ছে।
অন্যদিকে সৈকতে নাইলন ও প্লাস্টিকজাত চিপস প্যাকেট, আচারের প্যাকেট, পলিথিন, ক্যান, চায়ের কাপ, বোতল, পানির বোতল, পানির গ্লাস, প্লেট, ডাবের পানি খাওয়ার স্ট্র, খাবার প্যাকেট, ভাঙা চশমা বা কাঠি, মাছ ধরার জালের টুকরো, নাইলন দড়ির টুকরোসহ বিভিন্ন অপচনশীন ব্যবহার্য জিনিসপত্র দ্বীপটিটে অনিয়ন্ত্রিতভাবে ব্যবহার হচ্ছে। এসব অপচনশীল জিনিসপত্র সঠিকভাবে পরিস্কার-পরিচ্ছন্ন হচ্ছে না। এতে এগুলো বর্জ্যে পরিণত হয়ে দ্বীপটির পরিবেশকে মারাত্মকভাবে দূষিত করছে।
পরিবেশবাদী সংগঠন পরিবেশ আইন সমিতি (বেলা) সূত্রে জানা গেছে, ১৯৯৯ সালে প্রতিবেশগত সংকটাপন্ন এলাকা ঘোষণা করে পরিবেশ ও বন মন্ত্রণালয়। সংকটাপন্ন এলাকা (ইসিএ) হওয়া স্বত্বেও পর্যটকদের অবাধ যাতায়াত, দ্বীপের ভারসাম্যের সঙ্গে সামঞ্জস্যতা না রেখে একের পর এক স্থাপনা নির্মাণ, দ্বীপের রক্ষাকবচ হিসেবে পরিচিত কেয়াবন উজাড়, পাথর উত্তোলন করে নির্মাণ কাজে ব্যবহারসহ পরিবেশ বিধ্বংসী নানা কর্মকাণ্ডের কারণে গত দেড়যুগে দ্বীপের ভাঙন প্রকট আকার ধারণ করেছে। সব ধরনের অবকাঠামো নির্মাণ, মাটির পরিবর্তন, জীববৈচিত্র ধ্বংস, বন্যপ্রাণী শিকার, শামুক, ঝিনুক, প্রবাল, শৈবাল, পাথর আহরণ ও সরবরাহ নিষিদ্ধ ঘোষণা করা হলেও মানা হচ্ছেনা কোনটিই। ইতিমধ্যে সেন্টমার্টিন দ্বীপে আইন লঙ্ঘন করে তৈরি হয়েছে শতাধিক হোটেল-মোটেল। বর্তমানে পরিবেশ সংকটের বিষয়টি অত্যন্ত স্পর্শকাতর হয়ে উঠলেও তা ঝিমিয়ে আছে পরিবেশ অধিদপ্তর। এখনো নির্বিগ্নে তৈরি হচ্ছে কয়েকটি কয়েকতলা বিশিষ্ট হোটেল ভবন।
পরিবেশবাদী সংগঠনগুলো বলছে, প্রতিবেশগত সংকটাপন্ন এলাকা (ইসিএ-তে ৯টি পয়েন্টের নিষিদ্ধ কার্যক্রম রোধ কল্পে) আইন কঠোরভাবে প্রয়োগ করা, দ্বীপে প্লাস্টিকের ব্যবহার বন্ধ করা, পর্যটক ও পর্যটন সংশ্লিষ্ট যাবতীয় কর্মকাণ্ড নিয়ন্ত্রণ করা, পর্যটকদের আচরণ নিয়ন্ত্রণ ও নির্ধারণ করা, ছেঁড়াদ্বীপে পর্যটক নিষিদ্ধ করা, দ্বীপে স্থায়ী বর্জ্য ব্যবস্থাপনা নিশ্চিত করা, দ্বীপে নিরাপদ খাবার পানির উৎস নিশ্চিত করা, পরিবেশ ছাড়পত্র ব্যতিত হোটেল ও রিসোর্ট তৈরি বন্ধ করা, স্থানীয় মানুষের জীবন-জীবিকা, জীববৈচিত্র ও দ্বীপ রক্ষায় নীতিমালা তৈরি করাসহ নানান প্রস্তাবনা দিচ্ছে। এসব প্রস্তাবনার অধিকাংশের দায়িত্ব পরিবেশ অধিদপ্তরের কিন্তু সেদিকে এই দপ্তরটি কোনো উদ্যোগ নেই। এতে ক্রমান্বয়ে দ্বীপটির জন্য বড় দুঃসংবাদ বয়ে আসছে বলে অভিমত।
পরিবেশ বিষয়ক স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন ‘এনভায়রনমেন্ট পিপল’র প্রধান নির্বাহী রাশেদুল মজিদ বলেন, ‘প্রভাবশালীরা দ্বীপের পরিবেশ ধ্বংস করে অবৈধভাবে পাকা স্থাপনা নির্মাণ করছে। ইতোমধ্যে দ্বীপে শতাধিক পাকা স্থাপনা নির্মাণ হয়ে হয়ে গেছে। কিছু কিছু হোটেল-মোটেলে পর্যটকেরা যাতে বিছানায় শুয়ে শুয়ে সমুদ্র দেখতে পারে, এ জন্য দ্বীপের রক্ষা কবচ খ্যাত কেয়াবন কেটে ফেলা হচ্ছে। এছাড়াও আরো নানাভাবে পরিবেশকে ধ্বংস করা হচ্ছে- যা দ্বীপটিকে বাঁচিয়ে রাখা নিয়ে বড় হুমকি হয়ে দাঁড়িয়েছে।’
সেন্টমার্টিন ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান নূর আহমদ বলেন, ‘সেন্টমার্টিনে পরিবেশ অধিদপ্তরের কোনো স্থায়ী কোনো লোকবল নিয়োগ দেয়া হয়নি। নেই স্থায়ী কার্যালয় বা অন্য কোনো অবকাঠামোও। টেকনাফ বা কক্সবাজার থেকে গিয়ে কালেভাদ্রে সাইনবোর্ড সর্বস্ব এবং লোক দেখানো কিছু অস্থায়ী কার্যক্রম চালিয়ে দায় সারা হচ্ছে। যে স্বল্প পরিসরের কাজ করা হয় তাতেও স্থানীয়দেও সাথে সমন্বয় নেই। এতে ওইসব কার্যক্রমেরও কোনো ফলাফল পাওয়া যাচ্ছে না।’
এ ব্যাাপারে জানতে চাইলে কক্সবাজার পরিবেশ অধিদফতরের উপ-পরিচালক শেখ মোহাম্মদ নাজমুল হুদা বলেন, ‘সেন্টামার্টিনের আমাদের কার্যক্রম রয়েছে; তবে তা সীমিত। সীমিত আকারে আপাতত সচেতনতামূলক কার্যক্রমগুলো চালাচ্ছি। যেহেতু আমাদের সীমাবদ্ধতা রয়েছে তাই সেখানে বেড়াতে যাওয়া পর্যটকদের নিজেদেরও একটু দায়বদ্ধ হওয়ার আহ্বান জানাই। কেননা সেন্টমার্টিনে যাওয়া পর্যটকেরা সবাই কিন্তু শিক্ষিত ও সচেতন। আমাদের নির্দেশনাগুলো মানলেই সেখানকার পরিবেশ অনেক সুরক্ষিত থাকবে।’
তিনি আরো বলেন, ‘ সেন্টমার্টিনের রক্ষণাবেক্ষণের দায়িত্ব শুধু আমাদের নয়। স্থানীয় ইউনিয়ন পরিষদসহ উপজেলা প্রশাসনেরও। তাদেরকেও এগিয়ে আসতে হবে। তারপরও আমাদের কার্যক্রম আরো বাড়ানোর চেষ্টা করে যাচ্ছি।’
উল্লেখ্য, কক্সবাজার পরিবেশ অধিদফতর ও মৎস্য অধিদফতরের দেওয়া তথ্য অনুযায়ী, এই দ্বীপে রয়েছে ১৫৩ প্রজাতির সামুদ্রিক শৈবাল, ১৫৭ প্রজাতির জলজ উদ্ভিদ, ৬৬ প্রজাতির প্রবাল, ১৫৭-১৮৭ প্রজাতির শামুক-ঝিনুক, ২৪০ প্রজাতির মাছ, চার প্রজাতির উভচর ও ২৯ প্রজাতির সরীসৃপ প্রাণী ও ১২০ প্রজাতির পাখি। দ্বীপটির স্বচ্ছ পানিতে নামলে পাথরের স্তূপের ওপর নানা প্রজাতির প্রবাল, শৈবাল, শামুক-ঝিনুক ও অসংখ্য প্রজাতির মাছ দেখা যায়। সামুদ্রিক কচ্ছপ সবুজ সাগর কাছিম এবং জলপাইরঙা সাগর কাছিম প্রজাতির ডিম পাড়ার স্থান হিসেবে জায়গাটি প্রসিদ্ধ। ভাটার সময় দ্বীপের চারদিকে দেখা যায় বিভিন্ন প্রজাতির প্রবাল।
আমরা সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।