ইমাম খাইর, সিবিএন:
ঘরকাটা ইঁদুরেরা বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করেছে বলে মন্তব্য করেছেন জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল-জাসদের সভাপতি ও সাবেক তথ্যমন্ত্রী বীর মুক্তিযোদ্ধা হাসানুল হক ইনু।
তিনি বলেছেন, ঘরকাটা ইঁদুরেরা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার রাজনীতিতে ঢুকে পড়েছে। রাজনীতি ও প্রশাসনে দুর্নীতিবাজদের সিন্ডিকেট দেশের উন্নয়ন বাধাগ্রস্ত করছে। সুশাসনের জন্য এসব দুর্নীতিবাজদের গতিরোধ করতে হবে, নতুবা সব অর্জন মলিন হয়ে যাবে।
রবিবার (২৬ জানুয়ারী) বিকালে পাবলিক লাইব্রেরীর শহীদ দৌলত ময়দানে কক্সবাজার জেলা জাসদের ত্রি-বার্ষিক সম্মেলনে প্রধান অতিথির বক্তব্যে হাসানুল হক ইনু এসব কথা বলেন। এর আগে অনুষ্ঠানে আগত অতিথিদের নিয়ে জাতীয়-দলীয় পতাকা ও বেলুন উড়িয়ে সম্মেলনের উদ্বোধন করেন হাসানুল হক ইনু।
সাবেক তথ্যমন্ত্রী বলেন, বাংলাদেশে কয়েক ধারার রাজনীতি হয়। আওয়ামী লীগ মুক্তিযুদ্ধ ও মুক্তিযুদ্ধের চেতনা নিয়ে কথা বলে। কিন্তু রাষ্ট্রের চার নীতি সমাজতন্ত্র নিয়ে তারা কথা বলে না। বড় দল হলেও তারা সমাজতন্ত্র নিয়ে মাথা ঘামায় না আওয়ামী লীগ। কিন্ত জাসদ মুক্তিযুদ্ধ, গণতন্ত্র, ঐক্যের এবং সমাজতন্ত্র নিয়ে কথা বলে।
মুক্তিযুদ্ধের চেতনা প্রতিষ্ঠার জন্য আওয়ামী লীগ এককভাবে স্বয়ংসম্পূর্ণ নয় মন্তব্য করে হাসানুল হক ইনু বলেন, যুদ্ধাপরাধীদের বিচার সম্পন্ন করাসহ জঙ্গিবাদ ও আগুন সন্ত্রাস দূর করে শান্তিপূর্ণ বাংলাদেশ গড়তে জাসদ দরকার।
দেশকে শক্ত পাঠাতনের উপরে ধরে রাখতে চাইলে বেশ কয়েকটি ফর্মূলা দেন জাসদের সভাপতি।
১. দুর্নীতি-ক্ষমতার অপব্যবহার-লুটপাটের দুষ্টচক্র ধ্বংস করে সুশাসন ও আইনের শাসন নিশ্চিত করতে হবে। দুর্নীতিবাজ-ক্ষমতার অপব্যবহারকারী-লুটেরা’রা ধরা ছোঁয়ার-বাইরে না- এটা প্রমাণ করতেই হবে।
২. দেশে রাজনৈতিক শান্তি ও স্থিতিশীলতা বজায় রাখার জন্য মুক্তিযুদ্ধসহ অতীতের সকল ঐতিহাসিক গণ-আন্দোলনে মীমাংসিত বিষয় অমীমাংসিত করার সকল অপচেষ্টা বন্ধ করতে হবে। মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ও ইতিহাস নিয়ে বিতর্কের অবসান করতে হবে। পাকিস্তানপন্থার রাজনীতি তথা সাম্প্রদায়িক-মৌলবাদী-জঙ্গিবাদী-সন্ত্রাসবাদী রাজনীতি ও তাদের পৃষ্ঠপোষক জামায়াত-বিএনপিকে রাজনীতির মাঠ থেকে চিরতরে বিদায় করতে হবে। গণতন্ত্র ও মানবাধিকারের দোহাই দিয়ে দেশবিরোধী এই শক্তিগুলোর প্রতি নমনীয়তা ও ছাড় দেয়ার কোনো সুযোগ নেই। এ কথা রাজনৈতিক বিদ্বেষ না, রাজনৈতিক বাস্তবতা। ইতিহাস ও তথ্যপ্রমাণ করে জামায়াত-বিএনপি সুযোগ পেলেই গণতন্ত্রের পিঠে ছোবল হানে। বিএনপি-জামায়াত সাম্প্রদায়িক-জঙ্গিবাদ-মৌলবাদ উৎপাদন পুনরুৎপাদনের কারখানা।
৩. সংবিধান পর্যালোচনা করে সংবিধান থেকে অসঙ্গতি ও গোজামিল দূর করতে হবে। শাসন-প্রশাসনে গুণগত পরিবর্তন আনতে, রাজনীতিতে ভারসাম্য তৈরি করতে, ক্ষমতার বিকেন্দ্রীকরণ করতে, আরও গণতন্ত্র, অংশগ্রহণমূলক গণতন্ত্র, জনগণের ক্ষমতায়ন করতে জাতীয় সংসদে উচ্চকক্ষ গঠন করে দ্বি-কক্ষ বিশিষ্ট সংসদীয় ব্যবস্থা চালু, সংখ্যানুপাতিক নির্বাচন চালু, জেলা-উপজেলা-ইউনিয়ন পরিষদকে স্বাধীন সংস্থা হিসেবে গড়ে তুলে কার্যকর স্থানীয় শাসন চালু করতে হবে।
৪. বাংলাদেশসহ বিশ্বব্যাপী মুক্তবাজার অর্থনীতি শ্রমিক-কৃষক-নারী-যুবক-ছাত্রদের স্বীকৃত অধিকার অস্বীকার করেছে। মুক্তবাজার অর্থনীতি, বৈষম্য-দারিদ্র্য বৃদ্ধি ছাড়া আর কিছুই দিতে পারছে না। পরিবেশ ও প্রকৃতি ধ্বংস করেছে। শীতলযুদ্ধের অবসানের পর শান্তি প্রতিষ্ঠার কথা বলা হলেও মুক্তবাজার অর্থনীতির স্বর্গরাজ্য পশ্চিমা দুনিয়ার দেশগুলো নিজেদের দেশেই তীব্র অর্থনৈতিক সংকটে নিমজ্জিত হয়ে যুদ্ধ উন্মাদনা তৈরি করে, যুদ্ধ রফতানি করে, যুদ্ধব্যবসা করে বাঁচার চেষ্টা করছে। বাংলাদেশের মানুষের ভাগ্য মুক্তবাজার অর্থনীতির ওপর ছেড়ে দেয়া যায় না। নিত্যপণ্যের বাজার ব্যবস্থাপনায় পরিকল্পনাহীনতার সুযোগ নিয়ে বাজার সিন্ডিকেট যেন আর কারসাজির সুযোগ না পায়, কৃষকদের ফসলের ন্যায্য মূল্য না পাওয়ায় আর যেন কাঁদতে না হয়, শ্রমিকদের ন্যূনতম জাতীয় মজুরি না পাওয়ায় আর যেন হাহাকার করতে না হয়- তার জন্য মুক্তবাজার অর্থনীতির ভ্রান্ত ও ব্যর্থ ধারণা থেকে বেরিয়ে এসে সংবিধান নির্দেশিত সমাজতন্ত্র লক্ষ্যাভিমুখী অর্থনৈতিক পরিকল্পনা গ্রহণ করতে হবে।
৫. দেশে বিদ্যমান শিক্ষাব্যবস্থায় নৈরাজ্য-বিশৃঙ্খলা-মানের নিম্নগামীতা রুখতেই হবে। শিক্ষাপ্রশাসনকে দুর্নীতি ও দলবাজিমুক্ত করতে হবে। দেশপ্রেমিক নাগরিক ও দক্ষজনশক্তি গড়ে তোলার লক্ষ্যে শিক্ষাব্যবস্থাকে ঢেলে সাজাতে হবে। একজন শিক্ষিত যুবকও যেন বেকার না থাকে সেই লক্ষ্যে দেশে-বিদেশে কর্মসংস্থানের ক্ষেত্র সম্প্রসারণ করতে হবে। লুটপাট-অপচয় বন্ধ করে সেই টাকার বেকারদের বেকারভাতা দিতে হবে।
৬. ডিজিটাইজেশন বা তথ্যপ্রযুক্তির সর্বব্যাপক উত্থান গোটা দুনিয়ার যে নতুন বাস্তবতা তৈরি করেছে সেই ডিজিটাল ও সাইবার জগতের সঙ্গে খাপ খাইয়ে, তা আয়ত্তে এনে এগিয়ে চলার জন্য জাতীয় ডিজিটাল ও সাইবার ব্যবস্থাপনা গড়ে তুলতে হবে।
৭. বিশ্ব জলবায়ু পরিবর্তনে সবচেয়ে বেশি ঝুঁকিপূর্ণ দেশগুলোর অন্যতম বাংলাদেশ। জলবায়ু পরিবর্তন ঝুঁকি মোকাবিলায় জাতীয় সক্ষমতা অর্জনে সমন্বিতনীতি ও পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে।
৮. বাংলাদেশ জনসংখ্যা বিস্ফোরণের ঝুঁকির দিকে এগুচ্ছে। মাথাপিছু জমি, চাষযোগ্য জমি, বন, নদী, খাল-বিল, জলাশয় ভরাট ও দখল হয়ে আশঙ্কাজনকভাবে কমে যাচ্ছে। জনসংখ্যা বিস্ফোরণে ঝুঁকি ও চাপ মোকাবিলায় জনসংখ্যা ব্যবস্থাপনায় সমন্বিতনীতি ও পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে।
৯. বিশ্বায়ন, আঞ্চলিকায়ন, বাণিজ্যায়ন ও যোগাযোগায়নে দ্রুত পরিবর্তনশীল পরিস্থিতির সঙ্গে খাপ খাইয়ে দেশের স্বার্থ সমুন্নত রাখতে বহুমাত্রিক কৌশলের ভিত্তিতে জোরালো কূটনৈতিক নীতি প্রণয়ন করতে হবে।
বিশেষ অতিথির বক্তব্যে জাসদ কেন্দ্রীয় কমিটির যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক নাইমুল আহসান জুয়েল বলেন- জাসদ শতভাগ মুক্তিযোদ্ধার দল। অন্যান্য দলের মতো নয়। দেশের এমন কোনো জেলা নেই যার মাটি খুড়লে জাসদের রক্ত বের হবে না। জাসদের এমন কোনো কর্মী নেই যে কারানির্যাতন করেনি। জাসদ সব সময় নির্যাতিত। কেননা জাসদ জনমানুষের কথা বলে।
বিশেষ অতিথির বক্তব্যে জাসদ কেন্দ্রীয় কমিটির যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুর রহমান চুন্নু বলেন- দেশে আজ দুর্নীতিবাজদের সিন্ডিকেট গড়ে উঠেছে। এর ফলে উন্নয়নের সুফল ঠিকমতো পাওয়া যাচ্ছে না। কৃষকরা ফসল দ্বিগুণ উৎপাদন করেও ন্যায্য মূল্য পাচ্ছেন না। নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের দাম হু-হু করে বাড়ছে। আমাদের মহান সংবিধানে আজও সাম্প্রদায়িকতা ও সেনাশাসনের ছাপ রয়েছে। শিক্ষাঙ্গনে বিশৃঙ্খলা চলছে। ডিজিটাল সমাজে নিরাপত্তাহীনতা চলছে। আশংখাজনক হারে দেশে নারী ও শিশু নির্যাত বৃদ্ধি পেয়েছে।
তিনি আরও বলেন- বর্তমান সরকার অনেক উন্নয়ন করেছে। কিন্ত তবুও নারীরা নিরাপদ নেই, তরুণরা চাকরি পায় না, শ্রমিকরা ন্যায্য মজুরি পায় না। এক অনিশ্চিতায় আমাদের জীবন। এই অনিশ্চতা থেকে মুক্তিপেতে আমাদের সকলকে জাসদের সুশাসনের দাবী চলমান আন্দোলন বেগবান রাখতে হবে।
জাসদ কক্সবাজার জেলার ত্রি-বার্ষিক সম্মেলনে আরো বক্তব্য রাখেন- জেলা জাসদ সাধারণ সম্পাদক এডভোকেট আবুল কালাম আজাদ এর সঞ্চালনায় সম্মেলনে আরো বক্তব্য রাখেন- শহর জাসদ সভাপতি মোঃ হোসাইন মাসু, সম্মেলন প্রস্তুতি কমিটির আহবায়ক এডভোকেট রফিক উদ্দিন চৌধুরী, জাসদ নেতা মোঃ জাকারিয়া, মাইমুনুর রশিদ, মোজাফ্ফর আহমদ, শহর জাসদ সাধারণ সম্পাদক নুর আহমদ, সহ-সভাপতি সাংবাদিক মোঃ আমান, দপ্তর সম্পাদক মিজানুর রহমান বাহাদুর, প্রচার ও প্রকাশনা সম্পাদক পরিতোষ বড়ুয়া, শিক্ষা বিষয়ক সম্পাদক খোরশেদ আলম অদুদ, জাসদ নেতা আবদুর রশিদ, চকরিয়া উপজেলা জাসদের সভাপতি আবু তাহের জিন, সাধারণ সম্পাদক নাজিম উদ্দিন, রামু উপজেলা জাসদের সভাপতি মোঃ ইউনুচ, সাধারণ সম্পাদক অমিত বড়ুয়া, উখিয়া উপজেলা জাসদের কার্যকরী সভাপতি এডভোকেট অনিল কান্তি বড়ুয়া, মহেশখালী উপজেলা জাসদের আহবায়ক আশরাফুল করিম সিকদার নোমান, মিসবাহ উদ্দিন ইরান, জাসদ নেতা প্রবাল পাল, বিল্পব বড়ুয়া, জাতীয় যুবজোট সভাপতি অজিত কুমার দাশ হিমু, সাধারণ সম্পাদক নুরুল আলম সিকদার, সহ-সভাপতি জাকের হোসেন, শ্রমিক জোট সভাপতি আবদুল জব্বার, কার্যকরী সভাপতি প্রদীপ দাশ, সাধারণ সম্পাদক আসাদুল হক আসাদ, বাংলাদেশ ছাত্রলীগ (জাসদ) কক্সবাজার জেলা সভাপতি আবদুর রহমান।