বিবিসি বাংলা:

আবারো আলোচনায় এসেছে লিবিয়া, যেখানে শান্তি আনার জন্য যুদ্ধরত পক্ষগুলোর সাথে আলোচনার চেষ্টা করছে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়।

লিবিয়ায় এ মুহূর্তে দুটি পরস্পরবিরোধী প্রশাসন সক্রিয় আছে: একটির নেতৃত্ব দিচ্ছেন জাতিসংঘ স্বীকৃত প্রধানমন্ত্রী ফায়েজ আল সেরাজ এবং অন্যটি জেনারেল খলিফা হাফতারের বিদ্রোহী বাহিনী।

এ সপ্তাহেই রাশিয়া ও তুরস্কের চাপের মুখে দু’পক্ষই সাময়িক যুদ্ধবিরতিতে রাজী হয়েছে।

কিন্তু তারপরেই আশঙ্কা অনুযায়ী কয়েকদিনের মধ্যেই জেনারেল হাফতার যুদ্ধবিরতি চুক্তি সম্পাদনের প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করেন যা দেশটিকে আবারো অনিশ্চয়তার মুখে ঠেলে দেয়।

কিন্তু লিবিয়ার অবস্থা এতোটা জটিল হলো কিভাবে?

ভঙ্গুর প্রতিশ্রুতি

যুদ্ধবিরতির প্রস্তাব দেয়া হয়েছিলো নয় মাসের তুমুল লড়াইয়ের মধ্যে একটি বিরতি আনার জন্য।

শুধু গত ছয় মাসেই প্রায় দু হাজার মানুষের মৃত্যু হয়েছে এবং বাস্তুহারা হয়েছে প্রায় দেড় লাখ মানুষ।

বার্লিনে ১৯শে জানুয়ারি অনুষ্ঠিত হওয়ার কথা লিবিয়া শান্তি সম্মেলন কিন্তু এটি নিশ্চিত নয় যে সাম্প্রতিক ঘটনাপ্রবাহ এটি হতে দেবে কিনা।

কিন্তু কেন একটি যুদ্ধবিরতি এতো কঠিন ?

এটি জানার জন্য যেতে হবে দ্বন্দ্বের উৎস মূলে।

২০১১ সাল থেকে গৃহযুদ্ধ চলছে লিবিয়ায়২০১১ সাল থেকে গৃহযুদ্ধ চলছে লিবিয়ায়

সংঘাতের সূচনা

সিরিয়ার মতো লিবিয়াতেও এর সূচনা হয়েছ ২০১১ সালে আরব বসন্তের মধ্য দিয়ে।

ন্যাটো সমর্থিত বাহিনী লিবিয়ার দীর্ঘসময়ের নেতা মুয়াম্মার গাদ্দাফিকে উৎখাত করে।

এরপর থেকেই দেশটিতে গৃহযুদ্ধ চলছে।

কয়েক বছরের সংঘাতের পর জাতিসংঘের সহায়তায় সরকার গঠন করেন প্রধানমন্ত্রী সেরাজ।

রাজধানী ত্রিপোলি ভিত্তিক তার জাতীয় ঐক্যের সরকারের লক্ষ্য ছিলো দেশকে এক করা।

কিন্তু সবাই এতে সম্মত হয়নি এবং জেনারেল হাফতার নিজেই ক্ষমতা চান।

তিনি লিবিয়ান ন্যাশনাল আর্মি বা এলএনএ গঠন করেন তবরুক ও বেনগাজি শহরকে ভিত্তি করে।

তার দাবি একমাত্র তিনিই নিরাপত্তা পুন:প্রতিষ্ঠা ও ইসলামপন্থী সন্ত্রাসকে দুর করতে পারেন।

তার বাহিনী গত বছরের এপ্রিল থেকে ত্রিপোলি অভিমুখে এগুতে থাকে এবং এ মাসে গুরুত্বপূর্ণ শহর সিরত দখল করতে সক্ষম হয়।

কিন্তু পরিস্থিতিকে জটিল করে বিভিন্ন শহর ভিত্তি মিলিশিয়ারা একের অন্যের সাথে লড়াই করছে এবং এর মধ্যে ইসলামিক স্টেটের একটি অংশও আছে।

লিবিয়ায় দুটি প্রশাসন কাজ করছে
লিবিয়ায় দুটি প্রশাসন কাজ করছে

প্রক্সি ওয়ার

এখানেও সিরিয়ার সাথে লিবিয়ার মিল আছে।

লিবিয়ার বিদ্রোহীরা শুধু মাত্র নিজ দেশের নন।

লিবিয়ার বিবদমান দু’পক্ষই আঞ্চলিক ও আন্তর্জাতিক সহযোগীদের সমর্থন পাচ্ছে।

আরব আমিরাত ও সৌদি আরব বলছে, তারা ওই অঞ্চলে ইসলামপন্থীদের থামাতে চায় এবং জেনারেল হাফতার এ দুটি দেশকে তার পক্ষে নিতে সক্ষম হয়েছেন।

আবার জর্ডান ও আরব আমিরাত অস্ত্র ও বিমান সহায়তা দিচ্ছে এলএনএকে এবং জাতিসংঘের একটি রিপোর্টে আরব আমিরাতের সামরিক সমর্থনকে বেসামরিক নাগরিকদের হত্যার জন্য দায়ী করা হয়েছে।

লিবিয়ার পূর্ব দিকের প্রতিবেশী মিসরও আছে জেনারেল হাফতারের দিকেই এবং দিচ্ছে নানা সহায়তা।

এবং ওই অঞ্চলে প্রভাব বাড়ানোর চেষ্টারত রাশিয়াও শেষ পর্যন্ত নিজেকে জড়িয়েছে।

তারা জেনারেল হাফতারের বাহিনীর সাথে মিশে লড়াই করছে বলে জানা যাচ্ছে।

যদিও মস্কো সরাসরি জড়িত হওয়ার অভিযোগ অস্বীকার করেছে।

জেনারেল হাফতারজেনারেল হাফতার

বিপর্যস্ত সহায়সম্পদ

অন্যদিকে আছে তুরস্ক।

সম্প্রতি তারা প্রধানমন্ত্রী সেরাজের সমর্থনে সৈন্য পাঠিয়েছে।

রাশিয়ার মতো আঙ্কারাও চায় প্রভাব বজায় রাখতে এবং নিজেকে তারা ওই অঞ্চলে শক্তিশালী অবস্থানে দেখতে চায়।

যদিও তুরস্ক সরকার বলছে তারা ত্রিপোলিতে সৈন্য পাঠিয়েছে প্রশিক্ষণ ও পরামর্শ দেয়ার জন্য।

যদিও একটি সূত্র বিবিসিকে নিশ্চিত করেছে যে তুরস্কের সেনাদের মধ্যে আঙ্কারা ভিত্তিক সিরিয়ান বিদ্রোহী যোদ্ধারাও আছে।

বিবিসির প্রতিরক্ষা সংবাদদাতা জোনাথন মার্কাস বলছেন, তুরস্কের লক্ষ্য হতে পারে সাগরের নীচে মূল্যবান সম্পদকে কেন্দ্র করে।

জোনাথন মার্কাসের বিশ্লেষণ:

নভেম্বরে আঙ্কারা ত্রিপোলি কর্তৃপক্ষের সাথে সমুদ্র সীমা চুক্তি স্বাক্ষর করে। যার মধ্যে পূর্ব ভূমধ্যসাগরে তুরস্কের দাবি করা এক্সক্লুসিভ ইকনোমিক জোনের বিষয়টিও আছে যা লিবিয়া নিজের দাবি করেছিলো।

তুরস্কের উদ্যোগ, অঞ্চলের অন্য খেলোয়াড়দের একটি বার্তা দিয়েছে যা ইউরোপে গ্যাস পাইপলাইন সুবিধাকে জটিল করেছে।

বিশ্লেষকরা মনে করছেন এটা ইসরায়েল, মিসর, গ্রীস ও সাইপ্রাসের উদ্যোগের পাল্টা পদক্ষেপ। এ দেশগুলো পূর্ব ভূমধ্যসাগর গ্যাস ফোরাম গঠন করেছে।

লিবিয়াকে নিয়ে তুরস্কের পরিকল্পনা ওই অঞ্চলে একটি বড় সংকট তৈরি করতে পারে, এমনকি একই সাথে মস্কো, ওয়াশিংটন ও ন্যাটো সহযোগীদের সাথে সম্পর্ককেও সমস্যায় ফেলতে পারে।

যা অঞ্চলটিতে উত্তেজনা আরও বাড়াতে পারে।

তুরস্ক অবশ্য আশা করছে লিবিয়ায় তাদের সামরিক উপস্থিতি সামান্যই থাকবে।

লিবিয়ায় সৈন্য পাঠাতে ভোট দিয়েছিলো তুরস্কের পার্লামেন্টলিবিয়ায় সৈন্য পাঠাতে ভোট দিয়েছিলো তুরস্কের পার্লামেন্ট

আঞ্চলিক স্বার্থ

আরব আমিরাত সহ উপসাগরীয় দেশগুলোর সাথে কাতারের দ্বন্দ্ব এখনো আছে।

তাই তারাও জাতিসংঘ সমর্থিত সরকারের দিকেও আছে তাদের সহযোগী তুরস্কের সাথে।

আছে ফ্রান্সের উপস্থিতিও।

অর্থনৈতিক ও নিরাপত্তা দুই ইস্যুতেই ২০১৫ সাল থেকে দেশটি লিবিয়ায় সক্রিয় আছে।

সরকারিভাবে প্যারিস জাতিসংঘ সমর্থিত সরকারের দিকে থাকার কথা বললেও সামরিক দিক থেকে জেনারেল হাফতারের দিকে যাওয়ার কথা ভাবছে দেশটি।

যদিও ফ্রান্সের কর্মকর্তারা কখনোই জেনারেল হাফতারকে সহায়তার কথা স্বীকার করেননি।

ইটালি আবার ফ্রান্সের সমালোচনা করছে হাফতার প্রশাসনের ঘনিষ্ঠ হবার দায়ে।

প্রধানমন্ত্রী সেরাজের সরকারের দিকেই সমর্থন আছে রোমের।

লিবিয়ার প্রধানমন্ত্রী ফায়েজ আল সেরাজ ও জেনারেল খালিফা হাফতারলিবিয়ার প্রধানমন্ত্রী ফায়েজ আল সেরাজ ও জেনারেল খালিফা হাফতার

২০১১ সাল থেকে লিবিয়া থেকে ভূমধ্যসাগর দিয়ে অভিবাসীদের আগমন ঠেকাতে আপ্রাণ চেষ্টা করছে ইটালি।

আর যুক্তরাষ্ট্র তো আছেই।

তারা দেশটির দক্ষিণ পশ্চিমে আইএস জঙ্গিদের বিরুদ্ধে কাজ করছে।

কেন এতো গুরুত্বপূর্ণ?

লিবিয়া সংঘাতে বাইরের অনেক খেলোয়াড় থাকার বিষয়টি অনেকটাই প্রমাণিত।

উত্তর আফ্রিকার এই দেশটিতে বিশাল তেল সম্পদের পাশাপাশি প্রাকৃতিক গ্যাস আছে।

আবার লিবিয়া আফ্রিকান অভিবাসীদের ইউরোপ যাওয়ার গেইটওয়ে হিসেবে কাজ করে।

সৈন্যসহ ট্যাংকসৈন্যসহ ট্যাংক

অন্যদিকে আইএসের উত্থান ও অন্য জঙ্গি গ্রুপগুলো শুধু প্রতিবেশী দেশগুলোর জন্যই দু:স্বপ্ন নয়।

লিবিয়ায় যদি সংঘাত অব্যাহত থাকে সংকট আরও বড় ভাবে দেশটির সীমান্ত ছাড়িয়ে যেতে পারে।