ফাইল ছবি

মুহাম্মদ আবু সিদ্দিক ওসমানী :

কক্সবাজারের কেজি স্কুল গুলো অভিভাবক ও ছাত্র ছাত্রীদের জিম্মি করে তাদের কাছ থেকে ৩ কোটি টাকা হাতিয়ে নিচ্ছে। অপ্রয়োজনীয় ও অননুমোদিত বই বাণিজ্য করে এ অর্থ প্রাথমিক শিক্ষার নামে নিরবে পকেটস্থ করছে জেলার ২ শতাধিক কেজি স্কুল কর্তৃপক্ষ। ভূঁইপোড় বই প্রকাশনী, কক্সবাজারের চিহ্নিত কিছু লাইব্রেরি, বই প্রকাশনীর মার্কেটিং অফিসারের সাথে কেজি স্কুল গুলো যোগসাজশ করে জোর করে অভিবাবক ও ছাত্র ছাত্রীদের আর্থিক, মানসিক ও দৈহিক এই বিশাল বোঝা ছাপিয়ে দিচ্ছে।

কক্সবাজার জেলায় কেজি স্কুল ও ভিন্ন নামে কেজি স্কুলের মতো পরিচালিত ২ শতাধিক স্কুল রয়েছে। কক্সবাজার জেলায় প্রাথমিক শিক্ষা ও কিন্ডারগার্ডেন (কেজি) স্কুল নিয়ে জরীপ ও গবেষণাধর্মী একটি প্রতিষ্ঠানের সম্প্রতি পরিচালিত এক বিজ্ঞান ভিত্তিক গবেষনায় বলা হয়েছে, কক্সবাজারে প্রাথমিক শিক্ষা পর্যায়ের কেজি স্কুলধর্মী শিক্ষা প্রতিষ্ঠান রয়েছে মেট ২৪৪ টি। এরমধ্যে ২ শতের অধিক কেজি স্কুল বই বাণিজ্যে প্রত্যক্ষভাবে জড়িত।

এসব কেজি স্কুলের মধ্যে ৩ শতের ভিতর ছাত্র ছাত্রী আছে ৪৯ টিতে, ৫ শতের ভিতর ছাত্র ছাত্রী আছে ৫৯ টিতে, ৮ শতের ভিতর ছাত্র ছাত্রী আছে ৩৫ টি তে, এক হাজারের ভিতর ছাত্র ছাত্রী আছে ২৭ টিতে, ১২ শতের ভিতর ছাত্র ছাত্রী আছে ১৮ টিতে, দেড় হাজারের মধ্যে ছাত্র ছাত্রী আছে ১৫ টিতে এবং দেড় হাজারের উপরে ছাত্র ছাত্রী আছে ১৩ টি কেজি স্কুলে। অবশিষ্ট ১৬ টি কেজি স্কুল সংস্থাটির জরীপকালে তাদের বিদ্যালয়ের অধ্যয়নরত ছাত্র ছাত্রীর প্রকৃত সংখ্যা জানাতে অপারগতা প্রকাশ করে।

মাঠ পর্যায়ে সংস্থাটির জরীপ অনুযায়ী প্রতিটি কেজি স্কুলে গড়ে ন্যুনতম ৩শ’ জনের বেশী ছাত্র ছাত্রী নিয়মিত পড়াশোনা করে। তাদের দেওয়া তথ্য মতে, কেজি স্কুল গুলোতে পঞ্চম শ্রেণি পর্যন্ত মোট ৮ টি ক্লাস রয়েছে। ক্লাস গুলোর নাম হচ্ছে: (১) প্লে, (২) নার্সারী, (৩) কেজি, (৪) স্টান্ডার্ড-১, (৫) স্টান্ডার্ড-২, (৬) স্টান্ডার্ড-৩, (৭) স্টান্ডার্ড-৪ এবং (৮) স্টান্ডার্ড-৫। প্রতিটি ক্লাসের ছাত্র ছাত্রীদেরকে ন্যুনপক্ষে ৮ থেকে ১২ টি পর্যন্ত ন্যাশনাল কারিকুলাম বহির্ভুত বই কন্ট্রাককৃত নিদিষ্ট লাইব্রেরি থেকে অভিবাবক ও ছাত্র ছাত্রীদের বাজারদরের তুলনায় ৪/৫ গুন বেশি দামে কিনতে হয়।

জরীপ সংস্থাটির দেওয়া তথ্য অনুযায়ী, কক্সবাজার জেলা শহরের ঘোনার পাড়ার বিবেকানন্দ বিদ্যা নিকেতন ও গোলদীঘির উত্তর পাড়স্থ হলিচাইল্ড স্কুল কোন বই বাণিজ্য করার অভিযোগ পাওয়া যায়নি। এ ২ টি কেজি স্কুলের সিলেবাসের বই কোন নির্ধারিত লাইব্রেরি হতে ক্রয় করতে হয়না। তাদের বই গুলো যে কোন লাইব্রেরি থেকে ক্রয় করা হলে, যে কোম্পানির বই হোক না কেন, কোন কথা ছাড়াই লাইব্রেরিওয়ালারা অভিভাবকদের বই এর গায়ে লেখা মূল্যের উপর ৪৫% ( শতকরা পয়তাল্লিশ ভাগ) কমিশন (ডিসকাউন্ট) দিয়ে থাকে। জরীপের প্রতিবেদন অনুযায়ী, কেজি স্কুলের নিজস্ব প্রদত্ত সিলেবাসের প্রতিটি বইয়ের ছাপা, বাজারজাতকরণ সমুদয় খরচ বই এর গায়ে লেখা মূল্যের ২৫% ভাগের বেশী পড়েনি। ২৫% খরচ সংক্রান্ত জরীপ সংস্থাটির যুক্তি হলো বিবেকানন্দ বিদ্যা নিকেতন ও হলিচাইল্ড স্কুলের বইতে যদি লাইব্রেরিওয়ালারা চোখবুঝে ৪৫% ডিসকাউন্ট দেয়। এর মধ্যে লাইব্রেরির মালিকদেরা লাভ করে ১০% থেকে ১৫% ভাগ, প্রকাশক লাভ করে ৮% থেকে ১২% ভাগ। মার্কেটিং অফিসার, বহন, গুদামজাত, রক্ষণাবেক্ষণ ইত্যাদিতে খরচ হয়ে যায় কমপক্ষে ১০% ভাগ। ঢাকা ও চট্টগ্রামের বিভিন্ন প্রকাশনী ও লাইব্রেরি থেকেও সংস্থাটি অভিন্ন হিসাব সংগ্রহ করেছে গবেষনা স্বার্থে। কেজি সমুহ নির্ধারিত লাইব্রেরি গুলো ও সংশ্লিষ্ট প্রকাশনীর সাথে শিক্ষা বছর শুরু হওয়ার আগেই কন্ট্রাক্ট করে ফেলায় এবং কন্ট্রাকের অর্থ কেজি স্কুল গুলোকে অগ্রিম প্রদান করায়, লাইব্রেরি গুলো কেজি স্কুলের নিজস্ব প্রদত্ত সিলেবাসের অপ্রয়োজনীয় ও অননুমোদিত বই গুলোতে বিক্রিতে এক পয়সাও কমিশন দেয়না। তাহলে, বই বাণিজ্যতে জড়িত অসাধু কেজি স্কুল গুলো তাদের নিজস্ব প্রদত্ত সিলেবাসের অপ্রয়োজনীয় ও অননুমোদিত বই গুলোতে বই এর গায়ে লেখা মূল্য অভিভাবক ও ছাত্র ছাত্রীদের কাছে জোর পূর্বক আদায় করে বিক্রিত বই এর উপর কমপক্ষে ৭৫% অথবা তারও বেশী লাভের অর্থ অভিভাবক ও ছাত্র ছাত্রীদের কাছ থেকে সুকৌশলে হাতিয়ে নিচ্ছে।
সংস্থাটির হিসাব মতে, জেলার কেজি স্কুল গুলোতে কমপক্ষে ৭০ হাজার শিক্ষার্থী পড়াশোনা করছে। তার মধ্যে বই বাণিজ্যের গ্যাড়াকল থেকে মুক্ত শিক্ষার্থীর সংখ্যা ১০ হাজারেরও কম। তারপরও ন্যাক্কারজনক বই বাণিজ্যে সরাসরি জড়িত কেজি স্কুল গুলো শিক্ষার্থীর সংখ্যা ৬০ হাজারেরও বেশি। আর এই ৬০ হাজার শিক্ষার্থীর প্রত্যেকে কমপক্ষে গড়ে অতিরিক্ত ৫ শত টাকা বেশী দাম দিয়ে কেজি স্কুল গুলো তাদের নিজস্ব প্রদত্ত সিলেবাসের অপ্রয়োজনীয় ও অননুমোদিত বই ক্রয় করতে বাধ্য হচ্ছে। সে হিসাবে প্রতি শিক্ষার্থীর জন্য অতিরিক্ত ৫শত টাকা হিসাবে মোট ৬০ হাজার শিক্ষার্থী কাছ থেকে লাইব্রেরি, প্রকাশক ও কেজি স্কুল গুলো কমপক্ষে ৩ কোটি টাকা হাতিয়ে নিচ্ছে।

এভাবে ন্যাশনাল কারিকুলাম বর্হিভুত বিভিন্ন কোম্পানির বই ৪/৫ গুন বেশী দামে অভিবাবক ও ছাত্র ছাত্রীদের ক্রয় করতে বাধ্য করাচ্ছে, কেজি স্কুল গুলো। ছেলে মেয়েদের ভবিষ্যৎ চিন্তা করে কেজি স্কুল গুলোর এ ধরনের নৈরাজ্য ও রমরমা বই ব্যবসার বিষয়ে অভিবাবকেরা অনেকটা অসহায় হয়ে এ বিষয়ে মুখ খুলতে পারছেননা। কারণ অভিবাবকদের কলিজার টুকরা তাদের সন্তানেরা সেখানে পড়ছে। তাই ন্যাশনাল কারিকুলাম বর্হিভুত বিভিন্ন কোম্পানির অতিরিক্ত বই কেনার বিষয়ে মুখ খুললেই কেজি স্কুল কর্তৃপক্ষ তাদের সন্তানদের বারটা বাজিয়ে ছাড়বে।

কক্সবাজার শহরের দক্ষিণ রুমালিয়ার ছরার বাসিন্দা ও জেলা সমবায় অফিসার (অব.) বখতিয়ার কামাল সিবিএন-কে জানিয়েছেন, তাঁর কনিষ্ঠ কন্যা বেনজীর জাহান রোজ স্থানীয় একটি কেজি স্কুলে পড়ে। সে নার্সারী শ্রেণি থেকে এবছর সদ্য কেজি শ্রেণীতে উত্তীর্ণ হয়েছে। উক্ত স্কুলটি থেকে তাঁর কন্যার জন্য ৯ টি বই কক্সবাজার শহরের প্রধান সড়কের রক্ষিত মার্কেটস্থ রহমানিয়া লাইব্রেরি থেকে ক্রয় করতে কেজি স্কুলটি থেকে তাঁকে একটা লম্বা লিস্ট ধরিয়ে দেওয়া হয়। এই লিস্টে ৯ টি বই এর নাম লেখা রয়েছে। তিনি উচ্চমূল্যে কোন কমিশন ছাড়া রহমানিয়া লাইব্রেরি থেকে বই গুলো ক্রয় করে আনার পর আরো ৫ টি খাতা সেখানে যোগ করে দেওয়া হয়। অর্থাৎ প্রাক প্রাথমিক আগে কেজি শ্রেণীর বই এবং খাতার সংখ্যা হলো ১৪ টি। বখতিয়ার কামালের কন্যা বেনজির জাহান রোজ ১৪ টি বই আর খাতা স্কুল ব্যাগে ঢুকিয়ে পিঠে নেওয়ার ওজনের ভয়ে এখন আর স্কুলে আসতে আতংকগ্রস্থ হয়ে পড়ে বলে জানান। এরূপ কমপক্ষে ৬০ হাজার শিক্ষার্থীদের মানসিক, দৈহিক ও আর্থিকভাবে জুলুম ও হয়রানী করছে কক্সবাজারের কেজি স্কুল ও অধিকাংশ লাইব্রেরি।
এবিষয়ে কক্সবাজারের জেলা প্রাথমিক শিক্ষা অফিসার মোঃ শফিউল আলম সিবিএন-কে বলেন, সম্পূর্ণ সরকারি নির্দেশনা অমান্য করে কক্সবাজারের কেজিস্কুল গুলো ন্যাশনাল কারিকুলাম বর্হিভুত অননুমোদিত বই ছাত্র ছাত্রীদের কিনাচ্ছে এবং ক্লাসে পড়াচ্ছে। তিনি বলেন, কেজিস্কুল গুলো ন্যাশনাল কারিকুলাম বর্হিভুত অননুমোদিত বই ছাত্র ছাত্রীদের কিনিয়ে তারা রমরমা ব্যবসা বাণিজ্য করছেন, অন্যদিকে, অভিভাবকদের তারা আর্থিক, শিক্ষার্থীদের মানসিক ও দৈহিক ক্ষতি করেছেন। শিক্ষার্থীদের উপর অপ্রয়োজনীয় বই এর বোঝা চাপাচ্ছেন। তারা সরকারি বিধিও চরমভাবে লঙ্গন করছেন। এরকম নৈরাজ্য বন্ধ হওয়া উচিত বলে তিনি মন্তব্য করেন। তাঁর মতে, অননুমোদিত বই কোমলমতি শিশুদের পড়ানো কোন অবস্থাতেই সঠিক হচ্ছেনা। তিনি বলেন, কতিপয় শিক্ষা ব্যবসায়ী ও অসাধু লাইব্রেরি মালিকদের অর্থের লোভের কারণে জেলার হাজার হাজার কেমলমতি শিশুরা বলি হচ্ছে।