ইউসুফ আরমান

জীবনের সংগ্রাম মুখর পথ যে কষ্টগুলো দেয় ,তা-ই তৈরি করে দেয় সাফল্যের ভিত্তি। কখনও তিনি ভাবেননি একাই কষ্ট পাবে আর অন্যরা সুখে থাকবে। কষ্ট সবারই আছে। তবে কেউ কেউ এতে হাল ছেড়ে দেন না বলেই তিনি তাঁদেরকে সুখী হিসেবে ভাবতে পারে। ঐ জায়গাটা হতে পারে সুইটিরও। হাল না ছেড়ে লক্ষ্য অর্জনের পথে এগিয়ে যায়। উঠে দাঁড়ান, নতুন উদ্যমে পথচলা শুরু। তবে এগুলোকে সাথে নিয়েও যারা সফল হয় তাঁরা অনমনীয় মনোভাবের অধিকারী। এগিয়ে যাওয়ার স্পৃহা এসব কষ্টগুলোকে মাড়িয়ে যায়। বিশ্বাস রেখে এগিয়ে যাওয়াই গড়ে দেয় জয়ের সৌভাগ্য। হাল ছেড়ে দেয়া সহজ হলেও এটাই দুঃখের কারণ হিসেবে রূপান্তরিত হয়। জীবন কঠিন, তার মানে এই নয় যে এর সাথে লড়াই করার সাহস আমার ভেতরে নাই।

কক্সবাজার সরকারি কলেজের হিসাব বিজ্ঞান বিভাগের ৪র্থ বর্ষের শিক্ষার্থী মাহবুবা আকতার সুইটির জীবনের গল্প। দুই ভাই ও তিন বোনের মধ্যে তিনি চতুর্থ। বাবা জাফর আলম স্থানীয় একটি ফিলিং স্টেশনে কাজ করেন আর মা সখিনা বেগম গৃহিণী। যখন রোহিঙ্গা অনুপ্রবেশ করে তখন সুইটি ইংরেজী ভাষার দক্ষতা অর্জন এবং ওরাল কক্স ল্যাংগুয়েজ ক্লাবে ভাষা প্রশিক্ষণ করাতো। পরবর্তীতে ২০১৭ সালের সেপ্টেম্বরে কক্সবাজার লজিটিকস নামের একটি সংস্থার মাধ্যমে মার্কিন একটি সংস্থার জন্য দোভাষীর কাজ শুরু করেন সুইটি। একপর্যায়ে যোগাযোগ হয় ইউনিসেফের সঙ্গে। সংস্থাটির জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তারা কক্সবাজার এলেই ডাক পড়ত তাঁর। প্রথমে পাঠানো হয় মার্কিন সংস্থা এমটিআইতে। এ সময় সেপ্টেম্বর থেকে এপ্রিল পর্যন্ত প্রতিষ্ঠানটির সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। ছুটির দিনগুলোতে আবার যুক্ত হতে শুরু করেন ইউনিসেফের সঙ্গে। শান্তিতে নোবেল পুরস্কার বিজয়ী তিন নারী ম্যারিয়েড ম্যাগুয়ার, শিরিন এবাদি ও তাওয়াক্কল কারমান, যুক্তরাজ্যের পররাষ্ট্রমন্ত্রী বরিস জনসন ও ভারতীয় তারকা প্রিয়াঙ্কা চোপড়াসহ বেশ কয়েকজন উচ্চপর্যায়ের প্রতিনিধিদের সঙ্গেও কাজ করেছেন সুইটি।

আমার পরিবার অভাবের সংসার ছিল, আর্থিক সংকটের কারণে কলেজ জীবনে সুইটির কষ্টের সীমা ছিল না। প্রাইভেট পড়িয়ে যে টাকা পেতেন, তা দিয়ে নিজের পড়ালেখার খরচ চালাতেন। ওই সময় অল্প টাকা জমিয়ে তা দিয়ে তিনি উদ্যোক্তা হওয়ার স্বপ্ন দেখতেন। দৃঢ় ইচ্ছাশক্তি, কঠোর পরিশ্রম ও মেধার কারণে আজ তিনি দেশের সফল উদ্যোক্তা।

কক্সবাজার পৌরসভাস্থ সিকদার পাড়ায় আমার অর্থায়নে একটি ক্ষুদ্র কারখানা চালু করা হয়। সেখানে হাতের কারুকাজ, নকশী গাঁথা ও সেলাইসহ ইত্যাদি হাতের কাজ গ্রামের মেয়েদের শিখানো জন্য সবার দ্বারস্থ হয়। বহু আকুতি মিনতি করে কয়েকজন যোগাড় করে কার্যক্রমের সূচনা। তখন সবাই সহজভাবে নিত না। আমার বাড়ির লোকজনও না। আমার প্রতিবেশিরাও না, আত্মীয়-স্বজনরাও না। সারাদিন বাইরে কাজ করি, সারাদিন বাইরে ঘুরে বেড়াই। তাদের ধারণা ছিল বাউন্ডুলে টাইপের হয়ে গেছি। তারপর যখন গ্রামের মেয়েদের কাজ শেখাতে যেতাম, তাদের স্বামীরাও মেনে নিত না। আমার সামনেই অনেক সময় ওদেরকে মারধর করতো। আমার সামনেই মুখের ওপর বলতো, আর আসবেন না। কতদিন নিজেরই মনে হয়েছে, এসব আর করবো না। এখন তো সবাই গর্ব করে। সামনে অনেক ভালো কথা বলে। আমার সাফল্য নিয়ে আলোচনা করে। কিন্তু একটা সময় একরকম একঘরেই ছিলাম। আমি এসব কথা শুনতাম না। কারও কথা শুনতাম না বলে নিজেই কারও কাছে যেতাম না, কারও সাথে মিশতাম না। কিন্তু এখন আমার বন্ধুরা সবাই ফিরে এসেছে, আত্মীয়-স্বজনরা ফিরে এসেছে। এখন আমি অনেক ভালো একটা পজিশনে।
প্রথম দিকে বিরক্ত হলেও সুইটি সাফল্য ঘুচিয়ে দিয়েছে। এখন গ্রামের সবাই তাঁকে নিয়ে গর্ব করেন। এ ব্যাপারে সুইটির মা সখিনা বেগম বলেন, একসময় চরম হতাশ ছিলাম, কিন্তু মেয়ের সাফল্যে তাঁর বাবার স্বপ্ন পূরণ হয়েছে। এটা হয়তো ছেলেদের পক্ষে সম্ভব হতো কি না সন্দেহ। এখন আর সেই আক্ষেপ নেই। একদিন আমার মেয়েকে সারা দেশবাসী চিনবে বলে আমার বিশ্বাস।’

সুইটি জয়ের দ্বারপ্রান্ত দাঁড়িয়ে আছেনঃ সবচেয়ে দুঃখের বিষয় হল আমরা বেশিরভাগ মানুষই এমন সময় গিয়ে হাল ছেড়ে দেই যখন সাফল্য করাঘাত করছে দরজায়। এটি এক রকম সংকট। আত্মবিশ্বাসী হন। প্রতিটি ঘটনার পেছনে রয়েছে সুনির্দিষ্ট কারণ। আমরা জানি না বলে কোনও আশার আলো দেখতে পাই না। থেমে যাওয়া মানেই একটি সম্ভাবনার অপমৃত্যু। সাফল্য দরজায় করাঘাত করলেও তাকে বরণ করে আনতে হয়। যদি ভাবেন যে সে আপনাতেই আসবে তো সেটা হবে ভুল। গরজ আপনার, সফলতার নয়। কোনও কিছু অর্জনই সহজ নয়। সংগ্রাম আর সহিষ্ণুতা পারে একে অর্জন করতে। ভীতুরাই হাল ছেড়ে দেয়, বিজয়ীরা সমস্ত চোখ রাঙানি কে উপেক্ষা করে সাফল্যের রাজটীকা পরে কপালে। পৃথিবী তাই সাহসীদের, ভীরুদের নয়।

হাল ছাড়লে কি জীবন সহজ হবে? হবে না। নিজেকে প্রশ্ন করুন। শতকরা ৯৯ ভাগ সময়ই আপনি ভাল বোধ করেন না। আপনি সবচেয়ে ভাল বোধ করেন তখনই যখন পাল্লা দিয়ে এগিয়ে চলতে পারেন। হাল না ছেড়ে লক্ষ্য অর্জন করলেই তা আবার নতুন কোনও লক্ষ্য অর্জনে সাহায্য করবে। কারণ, সফলতা কখনও ব্যর্থতা বয়ে আনতে পারে না সফলতা ছাড়া। এমন কথা গুলো বলছিলেন জীবনের ব্যর্থতার বাস্তবতার উপলদ্ধি করে মাহবুবা আকতার সুইটি।

জীবন মানেই সংগ্রাম, সংগ্রাম মানেই সাফল্য। এটা মনে রাখলে হাল ছাড়া অসম্ভব হবে। লেখাপড়া শিখে একটা, দুটো, বড়জোর একসঙ্গে তিনটি চাকরি করতে পারেন, কিন্তু একজন উদ্যোক্তা একসঙ্গে হাজার হাজার চাকরি সৃষ্টি করতে পারেন। এর অর্থ এই নয় যে, সবাই উদ্যোক্তা হবেন। সত্য হলো সবার মাধ্যমে সেটা সম্ভবও নয়। বরং যত সফল উদ্যোক্তা হবে দেশ ও জাতির জন্য ততই মঙ্গল।

লেখক পরিচিতি : কলামিষ্ট, সাহিত্যিক , 01815804388/ 01615804388 . yousufarmancox@gmail.com