ডেস্ক নিউজ:

কূটনীতিতে একটি কথা প্রচলিত আছে−‘একজন ব্যক্তি তার প্রতিবেশী পরিবর্তন করতে পারেন কিন্তু একটি দেশ তা কখনোই পারে না।’ এ কারণে পৃথিবীর সব দেশের মতো বাংলাদেশের কূটনীতিতেও প্রতিবেশী দেশ অগ্রাধিকার পেয়ে থাকে। ঐতিহাসিক পরিপ্রেক্ষিত ও বর্তমান বাস্তবতা উভয় কারণে প্রতিবেশীরা সবসময় কূটনীতিতে একটি বড় জায়গা নিয়ে থাকে। বাংলাদেশও এর ব্যতিক্রম নয়। তবে প্রতিবেশীদের সঙ্গে অনেক বিষয়ে মিল থাকলেও কিছু মতদ্বৈততা থাকায় এর পুরো সুফল ঘরে তুলতে পারছে না বাংলাদেশ।

ভৌগোলিক অবস্থানগত কারণে দক্ষিণ এশিয়ার ভারত ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার মিয়ানমার বাংলাদেশের সবচেয়ে নিকট প্রতিবেশী। এছাড়া ঐতিহাসিক দিক বিবেচনা করলে পাকিস্তানের অবস্থান ও পদক্ষেপকে গভীরভাবে পর্যবেক্ষণে রাখে বাংলাদেশ। এ দু’টি দেশের সঙ্গে অনেক বিষয়ে বাংলাদেশের যেমন মতের মিল রয়েছে তেমনি অমিলও আছে। সন্ত্রাসবাদ দমন, জলবায়ু পরিবর্তন, আঞ্চলিক বাণিজ্য সম্প্রসারণসহ অন্য আরও বিষয়ে এই অঞ্চলের প্রায় সব দেশই বাংলাদেশের অবস্থানের সঙ্গে একমত।

আবার মিয়ানমারের সঙ্গে রোহিঙ্গা ইস্যু বা ভারতের সঙ্গে পানি বণ্টন, সীমান্ত হত্যা ও এনআরসি (নাগরিকত্ব নির্ধারণে খসড়া তালিকা) ইস্যু বা পাকিস্তানের সঙ্গে অভ্যন্তরীণ বিষয়ে নাক গলানোর মতো স্পর্শকাতর বিষয়ে বাংলাদেশের রয়েছে চরম আপত্তি।

এ বিষয়ে ভারতে বাংলাদেশের সাবেক রাষ্ট্রদূত লিয়াকত আলী চৌধুরী বলেন, ‘প্রতিবেশী দেশের বিষয়ে বাংলাদেশের নীতি হচ্ছে, সবার সঙ্গে ভালো সম্পর্ক রেখে এগিয়ে যাওয়া। কিন্তু কিছু অস্বস্তিকর উপাদানের কারণে এর সম্পূর্ণ সুবিধা অর্জন করা সম্ভব হয় না।’ সমস্যা সমাধানে বাংলাদেশের আগ্রহ সবসময় আছে জানিয়ে তিনি বলেন, ‘অনেক সময় সমাধান কী সেটি জানার পরও নিয়ন্ত্রণের বাইরে কিছু উপাদানের জন্য সেটি করা দুরূহ হয়ে পড়ে।’ তিনি বলেন, ‘এজন্য প্রয়োজন সবার সঙ্গে ক্রমাগত আলোচনা। কিন্তু অনেক ক্ষেত্রে এটি সহজ বিষয় নয়। কারণ এর কোনও সর্বজনীন সমাধান নেই।’ উদাহরণ হিসেবে তিনি বলেন, ‘বাংলাদেশের বর্তমান রাজনৈতিক নেতৃত্ব একটি সাহসী পদক্ষেপ নিয়েছে। দীর্ঘদিনের একটি ছাঁচ থেকে বেরিয়ে এসে ভারতের সঙ্গে সম্পর্ক উন্নত করেছে। এর সুফল সবাই পাচ্ছে।’

তবে তিনি বলেন, ‘এই সম্পর্ক থেকে সুফল অব্যাহত রাখার জন্য এখন সময় এসেছে সম্পর্ককে আরও সংহত করার এবং এটি সবাইকে মিলে করতে হবে।’ আরেকটি উদাহরণ টেনে তিনি বলেন, ‘ভিয়েতনাম দীর্ঘদিন যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে যুদ্ধ করেছে এবং সেই সময় বেইজিং ও মস্কো সহায়তা দিয়েছিল হ্যানয়কে। কিন্তু বর্তমানে ওয়াশিংটনের সঙ্গে মধুর সম্পর্ক রয়েছে দেশটির।’

অতীতকে মনে রেখে এবং ভবিষ্যৎ সুযোগ বিবেচনা করে কূটনীতিক পদক্ষেপের ওপর জোর দিয়ে তিনি বলেন, ‘আমরা অতীতকে মূল্য দেই। একই সঙ্গে নতুন সুযোগকে কাজে লাগাতে হবে।’

সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অর্থ উপদেষ্টা এবি মির্জ্জা আজিজুল ইসলাম বলেন, ‘প্রতিবেশী দেশের সঙ্গে আমাদের কয়েকটি বিষয়ে বেশি মতবিরোধ আছে, আবার কয়েকটি বিষয়ে কম মতবিরোধ আছে।’ ভারতের বিষয়ে তিনি বলেন, ‘সীমান্তে হত্যাকাণ্ড নিয়ে সরকারকে খুব একটা সোচ্চার দেখি না। এনআরসি সংক্রান্ত বিষয়টি ভারতের সঙ্গে মীমাংসা করা দরকার। এনআরসি নিয়ে পররাষ্ট্রমন্ত্রী বলেছেন, এটি ভারতের অভ্যন্তরীণ বিষয়, কিন্তু এটি অভ্যন্তরীণ বিষয় বলে ছেড়ে দিলে হবে না। কারণ এখানে ঝুঁকি রয়েছে।’

তিস্তা চুক্তি নিয়ে কিছু হচ্ছে না উল্লেখ করে মির্জ্জা আজিজুল বলেন, ‘ভারতের সংসদে বাংলাদেশ নিয়ে যে মন্তব্য হয়েছে সেটি ঠিক নয়। বাংলাদেশের সংখ্যালঘুরা কোনও অভিযোগ করছে না কিন্তু ভারতীয়রা করছে।’

রোহিঙ্গা ইস্যুতে তিনি বলেন, ‘ভারত, চীন, জাপানের অর্থনৈতিক স্বার্থ রয়েছে মিয়ানমারে। তারা এজন্য মিয়ানমারকে কোনও চাপ দিতে পারছে না। আসিয়ানভুক্ত দেশগুলোও কোনও পদক্ষেপ নিচ্ছে না। এখানে আমাদের কূটনীতিক প্রচেষ্টা আরও বাড়ানো দরকার।’

পাকিস্তানের বিষয়ে তিনি বলেন, ‘১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধে যারা পাকিস্তানকে সমর্থন করেছিল তাদের যখন মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করা হয় তখন দেশটি বিবৃতি দিয়েছিল। এটি আমরা আশা করি না এবং চাই না। এটি ছাড়া পাকিস্তানের সঙ্গে আর কোনও বড় ধরনের ইস্যু নেই।’

এ বিষয়ে সরকারের অবস্থান জানতে চাইলে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের একজন কর্মকর্তা বলেন, ‘আমরা যখন বিষয়ভিত্তিক পররাষ্ট্র নীতি তৈরি করি তখন সবদিক বিবেচনা করে ঠিক করা হয়। প্রতিবেশী দেশগুলোর ক্ষেত্রে আমাদের অনেক কণ্টকময় বিষয় রয়েছে এবং এ বিষয়ে আমাদের মন্ত্রী ও সচিব একাধিকবার বিভিন্ন ফোরামে বলেছেন।’

রোহিঙ্গা ইস্যু নিয়ে তিনি বলেন, ২০১৭ এর আগস্টের অনেক আগে থেকেই রোহিঙ্গা সমস্যা নিয়ে আমরা কাজ করছি এবং আমাদের পররাষ্ট্র নীতির একটি ভিত্তি আমরা অনেক আগেই পরিবর্তন করেছি শুধুমাত্র মিয়ানমারকে বিবেচনায় নিয়ে।

ভারতের এনআরসি ইস্যু নিয়েও আমাদের চিন্তাভাবনা অনেক আগেই শুরু হয়েছে এবং দুই সরকারের সর্বোচ্চ পর্যায়ে এটি নিয়ে আলোচনা হয়েছে বলে জানান আরেকজন কর্মকর্তা।

পাকিস্তান ইস্যুতে তিনি বলেন, ‘আমাদের অবস্থান সবসময়ে দৃঢ় এবং আমরা সেটি তাদের জানাতে কখনই দ্বিধাবোধ করিনি। পাকিস্তানের সর্বশেষ রাষ্ট্রদূত প্রায় দুই বছর আগে চলে যাওয়ার পরে তারা নতুন যে রাষ্ট্রদূতের নাম প্রস্তাব করেছিল আমরা সেটি গ্রহণ করিনি। পরবর্তীতে তারা গত বছরের শেষভাগে নতুন আরেকজনের নাম প্রস্তাব করলে আমরা সেটি গ্রহণ করি।’