বিবিসি বাংলা:
ইরানের কুদস ফোর্সের প্রধান জেনারেল কাসেম সোলেইমানি হত্যাকাণ্ডকে স্বাগত জানিয়েছে ইসলামিক স্টেট গ্রুপ (আইএস)।
একটি বিবৃতিতে তারা বলছে, জেনারেল সোলেইমানির মৃত্যু ঐশ্বরিক হস্তক্ষেপে হয়েছে যা জিহাদিদের সুবিধা এনে দেবে। তবে তারা সেই বিবৃতির কোথাও যুক্তরাষ্ট্রের উল্লেখ করেনি, যে দেশটি গত ০৩ জানুয়ারি বাগদাদে সোলেইমানির ওপর ড্রোন হামলা করে।
জেনারেল সোলেইমানিকে হত্যায় প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের নির্দেশের বেশ কিছু প্রভাব রয়েছে, যার একটি হচ্ছে জিহাদিদের বিরুদ্ধে অসমাপ্ত যুদ্ধের বিষয়টি।
হামলার প্রায় পরপর যুক্তরাষ্ট্র নেতৃত্বাধীন জোট বাহিনী ইরাকে আইএসের বিরুদ্ধে তাদের অভিযান স্থগিত করেছে।
যুক্তরাষ্ট্র এবং তার সহযোগীরা ঘোষণা করেছে যে, তাদের এখন প্রধান কাজ হচ্ছে নিজেদের রক্ষা করা।
সামরিক দিক দিয়ে দেখলে, তাদের সামনে বিকল্প কোন পথও নেই।
ইরান এবং ইরাকে তাদের সমর্থনপুষ্ট যে মিলিশিয়া বাহিনীগুলো রয়েছে, তারা সোলেইমানির গাড়ি বহরে হামলায় নিহতদের মৃত্যুর প্রতিশোধ নেয়ার শপথ ঘোষণা করেছে।
এর ফলে ইরাকে যুক্তরাষ্ট্রের বাহিনী এবং অন্য যে পশ্চিমা জোটের সদস্যরা তাদের সঙ্গে সেখানে কাজ করে, তাদেরকে সরাসরি বিপদের মুখে ফেলেছে।
এটা আইএসের জন্য খুবই ভালো হয়েছে যারা এখন তাদের খেলাফত হারানোর আঘাত থেকে ফিরে নিজেদের অবস্থান পুনরুদ্ধারের চেষ্টা করতে পারবে।
এটা চরমপন্থিদের জন্যও সুখবর যে, আমেরিকান সৈন্যদের অতিসত্বর দেশ ছেড়ে দিতে আহবান জানিয়েছে ইরাকের পার্লামেন্ট।
অনেকে কয়েক বছর ধরে বার বার জেগে উঠেছে আইএস। এটির প্রথম জন্ম হয় আরেকটি জঙ্গী গ্রুপ, আল-কায়েদা ইন ইরাক থেকে।
ইরাক ও সিরিয়া জুড়ে আইএসের রাজত্বের অবসান ঘটাতে ২০১৬ এবং ২০১৭ সালে বড় ধরণের একটি সামরিক অভিযানের দরকার হয়।
অনেক জিহাদি যোদ্ধার মৃত্যু হয় অথবা কারাগারে ঠাঁই হয়। কিন্তু সংগঠনটিকে ধ্বংস করা যায় নি।
এটা এখনো ইরাক ও সিরিয়ায় তাদের পুরনো কিছু ঘাঁটিতে সক্রিয় রয়েছে। তারা গুপ্ত হামলা চালাচ্ছে, চাঁদাবাজি করছে এবং হত্যাকাণ্ড চালাচ্ছে।
ইরাকে রয়েছে একটি কার্যকরী অভিজাত সেনাবাহিনী এবং পুলিশ বাহিনী, যাদের প্রশিক্ষণ দিয়েছে প্রধানত আমেরিকান ও ইউরোপীয় জোট সদস্যরা। এই বাহিনীগুলো আইএসের বিরুদ্ধে লড়াই করছে।
সোলেইমানি গুপ্তহত্যার পর, অভিযানের পাশাপাশি এই প্রশিক্ষণ কার্যক্রমও স্থগিত করেছে যুক্তরাষ্ট্র। পরে একই কাজ করেছে ডেনমার্ক ও জার্মানি।
সামরিক প্রশিক্ষকদের সরিয়ে জর্ডান এবং কুয়েতে নিয়ে যাচ্ছে জার্মানি।
আইএসের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে যুদ্ধক্ষেত্রে বেশিরভাগ ঝুঁকি নিয়েছে ইরাকি বাহিনী। কিন্তু প্রশিক্ষণের মতো গুরুত্বপূর্ণ সামরিক সরঞ্জামের জন্য তারা যুক্তরাষ্ট্রের বাহিনীর ওপর নির্ভর করতো, যারা এখন তাদের ঘাঁটিতে আসন গেড়ে রয়েছে।
এছাড়া আরো কিছু আনন্দের বিষয় রয়েছে আইএস জঙ্গিদের জন্য।
কারণ জেনারেল সোলেইমানিকে হত্যার মাধ্যমে তাদের দুই শত্রু, যুক্তরাষ্ট্র ও ইরান, একে ওপরকে হত্যার সুযোগ তৈরি করেছে।
২০১৪ সালে জিহাদিরা আক্রমণাত্মক হয়ে ওঠে, ইরাকের দ্বিতীয় বড় শহর মসুলসহ অনেক এলাকা দখল করে নেয়।
তখন ইরাকের প্রধান শিয়া ধর্মীয় নেতা, গ্র্যান্ড আয়াতোল্লাহ আলি আল-সিস্তানি সুন্নি চরমপন্থিদের বিরুদ্ধে অস্ত্র হাতে নেয়ার আহবান জানান।
শিয়া যুবকরা তখন হাজারে হাজারে স্বেচ্ছাসেবী হয়ে ওঠে-তাদেরকে একটি সশস্ত্র বাহিনীতে পরিণত করার ক্ষেত্রে সোলেইমানি এবং তার কুদস বাহিনী গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। এই মিলিশিয়া বাহিনী ছিল নির্মম, কখনো আইএসের নিষ্ঠুর শত্রু।
এখন, ইরান সমর্থিত গ্রুপগুলো পপুলার মোবিলাইজেশন নামের একটি সংগঠনের আওতায় ইরাকি সেনাবাহিনীর সঙ্গে একীভূত হয়েছে। সবচেয়ে প্রধান সাড়ির মিলিশিয়া নেতারা ক্ষমতাশীল রাজনৈতিক নেতা হয়ে উঠেছেন।
২০১৪ সালে যুক্তরাষ্ট্র এবং মিলিশিয়ারা একই শত্রুর বিপরীতে লড়েছে। কিন্তু শিয়া মিলিশিয়ারা এখন তাদের শেকড়ে ফিরে আসতে চাইছে, যার মূল ভিত্তি হলো ২০০৩ সালে যুক্তরাষ্ট্রের আগ্রাসনের বিরুদ্ধে লড়াই করা।
সোলেইমানির সহায়তায় পাওয়া প্রশিক্ষণ এবং উন্নত অস্ত্র দিয়ে তারা অনেক আমেরিকান সেনাকে হত্যা করেছে। এটা একটা অন্যতম প্রধান কারণ, যে জন্য প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প গত সপ্তাহে সোলেইমানিকে হত্যার আদেশ দিয়েছিলেন।
ডোনাল্ড ট্রাম্প ২০১৮ সালে একতরফাভাবে ইরান পরমাণু চুক্তি থেকে বেরিয়ে যাওয়ার পর থেকেই আমেরিকা ও ইরান আস্তে আস্তে যুদ্ধ প্রান্তের দিকে এগিয়ে যাচ্ছিল।
সোলেইমানি হত্যার আগে থেকেই শিয়া মিলিশিয়ারা আমেরিকানদের লক্ষ্যবস্তু করতে শুরু করেছিল।
গত ডিসেম্বরে উত্তর ইরাকের একটি ঘাঁটিতে হামলায় একজন যুক্তরাষ্ট্রের ঠিকাদার নিহত হয়। সেটার জবাবে বিমান হামলায় খাতিব হেজবুল্লাহ নামের একটি গ্রুপের ২৫ জন যোদ্ধা নিহত হয়।
তাদের নেতা আবু মাহদি আল-মুহানদিস বাগদাদ বিমানবন্দরে সোলেইমানির সঙ্গে দেখা করেন এবং তার সঙ্গে একই গাড়িতে নিহত হন।
আইএসের সাপ্তাহিক সংবাদপত্র আল-নাবায় একটি সম্পাদকীয়তে লেখা হয়েছে, সোলেইমানি এবং আল-মুহানদিস তাদের মিত্রদের হাতে নিহত হয়েছে, যা যুক্তরাষ্ট্রকে বোঝানো হচ্ছে।
এটা বলছে, আইএসের শত্রুরা একে অপরের সঙ্গে লড়াই করছে, যা তাদের শক্তি এবং সম্পদের ক্ষয় করবে, শেষে লাভবান হবে জিহাদিরাই।
ইতিহাসে দেখা গেছে, জিহাদি চরমপন্থিরা তখনি সবচেয়ে বেশি উন্নতি করে যখন তারা অস্থিরতা, বিশৃঙ্খলা, দুর্বলতা এবং বিভক্ত শত্রুর সুবিধা পায়।
অতীতে ঘটেছে এবং আবারো সেটা ঘটার ভালো সম্ভাবনা রয়েছে।