বিবিসি বাংলা:

ভারতের সংশোধিত নাগরিকত্ব আইনের বিরুদ্ধে পশ্চিমবঙ্গের কলকাতায় এক লাগাতার প্রতিবাদ বিক্ষোভ শুরু হয়েছে।

২৪ ঘন্টা ধরেই শত শত মানুষ ওই ধর্নায় যোগ দিচ্ছেন মঙ্গলবার থেকে। শীত উপেক্ষা করেই তারা প্রথম রাতটা কাটিয়েছেন পোস্টার হাতে নিয়ে, স্লোগান দিয়ে।

ওই বিক্ষোভে না আছে কোনও রাজনৈতিক দল না কোনও সেলিব্রিটি।

নাগরিকত্ব চলে যাওয়ার আশঙ্কায় একেবারে সাধারণ মানুষ প্রতিবাদে নেমেছেন – যাদের একটা বড় অংশ নানা বয়সের মুসলমান নারী – বৃদ্ধা, স্কুল ছাত্রী, গৃহবধূ।

তাদের অনেকেই জীবনে প্রথমবার কোনও ধরণের বিক্ষোভে সামিল হয়েছেন।

পার্ক সার্কাস ময়দানের প্রবেশ পথ থেকেই দেখা যাচ্ছিল দলে দলে নারী পুরুষ – কেউ আবার বাচ্চার হাত ধরে ভেতরে ঢুকছেন।

ভেতরে তখন চলছিল সেই ‘আজাদি’ স্লোগান গুলি – যা বছর কয়েক ধরেই বিজেপি বিরোধী যে কোনও প্রতিবাদ বিক্ষোভে শোনা যায়। সেই সাথে জামিয়া মিলিয়া আর জহরলাল নেহরু বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রদের ওপরে সহিংসতার বিরোধীতা করেও স্লোগান চলছিল মাঝে মাঝে।

মঙ্গলবার থেকে শুরু হয়েছে কলকাতায় এই লাগাতার বিক্ষোভ
মঙ্গলবার থেকে শুরু হয়েছে কলকাতায় এই লাগাতার বিক্ষোভ

চিৎকার করে স্লোগান দিচ্ছিলেন দশম শ্রেনীর ছাত্রী সাজিয়া হুসেইন। কমাস পরেই মাধ্যমিক বোর্ডের পরীক্ষা, তার মধ্যেই হাজির থাকছেন এই বিক্ষোভে।

তিনি বললেন, “আমারও অধিকার আছে এই দেশে থাকার। হতে পারে কারও কাছে নথি নেই, কিন্তু তাই বলে আমি হিন্দুস্তানের নাগরিক নই? কোনও নথিতে একটা সামান্য বানান ভুলের জন্য কাউকে নাগরিক নয় বলে দেওয়া হবে? এটা ঘোর অন্যায়।”

পাশেই দাঁড়িয়েছিলেন গৃহবধূ সালমা খাতুন।

“ছোটবেলা থেকেই আমরা পড়েছি ‘মোরা একই বৃন্তে দুটি কুসুম হিন্দু মুসলমান’। সেটা শুধু পড়ার জন্য পড়ি নি, মাথায় ঢুকিয়ে নিয়েছি। কিন্তু দু:খের কথা আমাদের প্রধানমন্ত্রী আর তার সঙ্গী অমিত শাহ বোধহয় এগুলো পড়েন নি, সেজন্যই আজ তারা দেশের এই দুর্দশা করে ছাড়ছেন।”

ওই জমায়েতের মধ্যেই হাত মুঠো করে গলা ফাটিয়ে স্লোগান দেওয়ার কারণে নারীদের ভিড়েই নজর পড়েছিল এক বয়স্কার দিকে – খালিদা খাতুন।

জীবনেও কোনওদিন কোন সভা-সমাবেশে আসেন নি। কিন্তু কাল রাত কাটিয়েছেন এই সমাবেশেই।

“আমার দেশ হিন্দুস্তান কিছুতেই ছাড়ব না। ৭০ বছর বয়স হয়েছে, জীবনটাই যখন এখানেই কাটিয়েছি, বাকিটাও এখানেই থাকব। বলা হচ্ছে মুসলমানদের পাকিস্তানে চলে যেতে। কেন নিজের দেশ ছেড়ে অন্য দেশে যাব? আমি কি পাকিস্তানি?”দৃঢ় গলায় বলছিলেন মিসেস খাতুন।

পাশ থেকে আরেক নারী মুখ বাড়িয়ে বলছিলেন, “একের পর এক আইন হয়েছে – তিন তালাক প্রথা রদ হয়েছে, অযোধ্যার রায় বেরিয়েছে — কোনওদিন আমরা প্রতিবাদ করতে রাস্তায় নামি নি। কিন্তু এটা তো নিজের নাগরিকত্বের প্রশ্ন.. তাই এক সাধারণ গৃহবধূ হয়েও জীবনের প্রথম কোনও বিক্ষোভে যোগ দিতে বাধ্য হয়েছি।”

কলকাতায় নাগরিকত্ব আইন বিরোধী লাগাতার সমাবেশের একাংশ
কলকাতায় নাগরিকত্ব আইন বিরোধী লাগাতার সমাবেশের একাংশ

বিক্ষোভে দৃশ্যতই মুসলমানদের জমায়েত বেশি।

কিন্তু কথা হল অনেক হিন্দুর সঙ্গেও। তেমনই দুজন দীপান্বিতা রায় আর ঋতব্রত ঘোষ।

দীপান্বিতা বলছিলেন, “মহিলাদেরই প্রতিবাদে বেশি করে এগিয়ে আসা উচিত। কারণ যখন ডিটেনশান ক্যাম্পে পাঠানো হবে, সেখানে মহিলাদের সঙ্গে যে কী কী হতে পারে, সেসব তো পৃথিবীর নানা দেশের ঘটনা আমরা দেখি! তাই ভয়টা মহিলাদেরই বেশি।”

ঋতব্রত ঘোষের কথায়, “আমাদের প্রত্যেকের নাগরিকত্ব প্রশ্নের মুখে। কোটি কোটি মানুষকে এখন একটা পরীক্ষা দিতে হবে। সেই পরীক্ষায় পাশ করলে তবেই থাকতে পারব, নয়তো ডিটেনশানে যেতে হবে!”

এই বিক্ষোভ কোনও একটি দল বা সংগঠনের সমাবেশ নয়। আর কোনও ধর্মীয় উক্তিও যাতে না করা হয়, সেদিকেও নজর রাখছিলেন আয়োজকরা – যারা মূলত এসেছেন মাস কয়েক আগে থেকে গড়ে ওঠা কিছু ফেসবুক গ্রুপ এবং কিছু সামাজিক সংগঠন থেকে।

আয়োজকদের অন্যতম, ফরিদুল ইসলাম বলছিলেন, “মি. মোদী বা বিজেপি দেখানোর চেষ্টা করছে যে শুধু মুসলমানরাই প্রতিবাদে নেমেছে। কিন্তু সেটা একদম অসত্য। হিন্দু মুসলমান, ছাত্র যুব, নারী পুরুষ – প্রত্যেকেই আজ রাজপথে – কারণ প্রত্যেকের নাগিরকত্বই তো প্রশ্নবিদ্ধ হবে এই আইনে।”

যখন সমাবেশ থেকে বেরিয়ে আসছি, তখনও মানুষ আসা শেষ হয় নি।

আয়োজকরা বলছিলেন সকালের দিকে কম মানুষ থাকছেন। কারণ প্রত্যেকেরই ঘরের কাজকর্ম থাকে।

সেসব সেরে কিছু খেয়ে আবার দুপুর থেকে জমায়েত বড়ো হতে শুরু করেছে। যা সন্ধ্যে বা রাতে শত শত মানুষের সমাবেশে পৌঁছচ্ছে — ঠিক যেমনটা গত প্রায় ২৫ দিন ধরে চলছে দিল্লির উপকন্ঠে শাহিনবাগে।