জিয়াউর রহমান মুকুল

২০১৭ সালের ২৫ আগস্ট থেকে কক্সবাজার তথা বাংলাদেশ বিশ্বের দরবারে নতুনভাবে পরিচিতি লাভ করে।বিশ্বের বৃহত্তম শরনার্থী ক্যাম্প এখন এদেশেই।যদিও ঐতিহাসিকভাবে বাংলাদেশ বিশ্বের অন্যতম জনবহুল দেশ তারপরেও আমরা আশ্রয় দিতে সক্ষম হয়েছি প্রায় ১১ লক্ষ ভিটাবাড়িহীন আসহায় রোহিঙ্গাদের।কেবল আশ্রয় প্রদানে ক্ষান্ত না হয়ে তাদের জীবন রক্ষাকারী প্রয়োজনীয় সবকিছুর ব্যবস্থা করা হচ্ছে সম্পূর্ণ বিনামূল্যে। মানবিকতার চূড়ান্ত উদাহরণ এর বেশি আর কী হতে পারে।ইতিমধ্যে আমাদের প্রধানমন্ত্রী মাদার অব হিউমিনিটি উপাধিতে ভূষিত হয়েছেন।অন্যদিকে মিয়ানমার বিশ্বের বুকে পরিচিতি লাভ করছেন বিতাড়ক রাস্ট্র হিসেবে;সংখ্যালঘু নির্যাতনকারী দেশ হিসাবে।নোবেল বিজয়ী অং সাং সুচি হয়েছেন বিশ্ব নিন্দিত।

২০১৯ সালের আগস্ট মাসের ২২ তারিখে রোহিঙ্গাদের স্বদেশে ফেরত পাঠানোর ২য় উদ্যোগ নেওয়া হলেও অনিবার্য কারণবশত তা আর সম্ভব হয়নি।২য় বারে তিন হাজার চারশত পঞ্চাশজনকে মিয়ানমারে ফেরত পাঠানোর কথা থাকলেও শেষ পর্যন্ত কেউ ফিরে যেতে রাজি না হওয়ায় প্রত্যাবাসন প্রক্রিয়া ব্যাহত হয়।উল্লেখ্য ২০১৮ সালের ১৫ নভেম্বর রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনের ১ম উদ্যোগ গ্রহন করা হয়েছিল।এর পর থেকে আঞ্চলিক ও আন্তর্জাতিকভাবে বিভিন্ন মহলে রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন ইস্যুটি জন আলোচনায় চলে আসে।একেকমহল একেকভাবে এ সমস্যা উত্তরণের ফর্মূলা দিচ্ছেন। রোহিঙ্গা আশ্রয় পরবর্তী ঘটনাবলির মধ্যে ২০১৯ সালের উল্লেখযোগ্য ঘটনাবলির একটি হল রোহিঙ্গা কর্তৃক আয়োজিত ২৫ আগস্টের মহাসমাবেশ।রোহিঙ্গা বিতাড়ানের ২য় বর্ষফূর্তি উদযাপন উপলক্ষে ক্যাম্প এলাকায় এই মহাসমাবেশ আয়োজন করে আশ্রিত রোহিঙ্গারা ।তার কয়েকদিনের মধ্যে সেপ্টেম্বর-২০১৯ এর শুরু থেকে রোহিঙ্গাদের মোবাইল ফোনে গতিসম্পন্ন নেটওয়ার্ক ব্যবহারে বিধিনিষেধ আরোপিত হয় সরকার কর্তৃক।ফলে রোহিঙ্গা ক্যাম্প ও তার পার্শ্ববর্তী এলাকায় থ্রিজি ফোরজি নেটওয়ার্কের আওতার বাইরে চলে যায়। যা এখনো স্থানীয় লোকদের কাছে একটি নেতিবাচক স্মৃতি হিসেবে বিদ্যমান।

স্থানীয়দের জন্য চাকরি মেলাঃ বিগত ০৬/০৭/২০১৯ তারিখে স্থানীয়দের দাবীর মুখে রোহিঙ্গা ক্যাম্পে কর্মরত বিভিন্ন বেসরকারি সংস্থায় কর্মসংস্থানের জন্য জেলা প্রশাসন কক্সবাজার কর্তৃক উখিয়া সরকারি উচ্চবিদ্যালয় খেলার মাঠে আয়োজন করা হয় এক বর্ণাঢ্য “চাকরি ও দক্ষতা উন্নয়ন” মেলার। মেলায় অনেককে চাকরি প্রদান করা হয়।মেলার বড় সাফল্য ছিল কক্সবাজার জেলার কর্ম প্রত্যাশী বেকারলোকদের ডাটাবেইজ। যদিও বছর শেষে এই ডাটাবেইজ এর আবেদন কিছুটা স্তিমিত হয়ে পড়ে।

ওমর ফারুক হত্যাকান্ডঃ বিদায়ী বছরের নেতিবাচক ঘটনার অন্যতম টেকনাফের হ্নীলা ইউনয়নের স্থানীয় যুবক খুনের ঘটনা। ২২ আগস্ট রোহিঙ্গা সন্ত্রাসী কর্তৃক তার নিজ বাড়ির পাশেই তাকে হত্যা করা হয়।এই ঘটনাকে কেন্দ্র করে পরবর্তীদিন স্থানীয় উত্তেজিত জনতা কক্সবাজার-টেকনাফ সড়ক অবরোধ করে ও ভাঙচুর চালায় পরবর্তী প্রশাসনের কার্যকর পদক্ষেপে এলাকায় পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আসে।

ওরাল কলেরা ভ্যাকসিনঃ কলেরা রোগের প্রাদূর্ভাব দূর করতে এবছর বড় আকারে পালিত হয় ওরাল কলেরা ভ্যাকসিন।সিভিল সার্জন অফিস কক্সবাজার এর সার্বিক তত্ত্বাবধানে রোহিঙ্গা ও তদসংলগ্ন এলাকায় এই কার্যক্রম পরিচালিত হয়।এতে সরকারের পাশাপাশি একযোগে কাজকরে বিভিন্ন জাতীয় ও আন্তর্জাতিক সংস্থাসমূহ।

পুষ্টি সপ্তাহঃ ক্যাম্পের শিশুদের পুষ্টি অবস্থা নির্ণয়,পুষ্টিসেবার পরিধি বাড়ানো ও ভিটামিন এ প্লাস ক্যাম্পেইন পরিচালনা করার জন্য ২০১৯ সালে ২ বার পুষ্টিসেবা সপ্তাহ পালন করা হয়।সিভিল সার্জন অফিস কক্সবাজার ও জনস্বাস্থ্য পুষ্টি প্রতিষ্টানের সার্বিক ব্যবস্থাপনা ও তত্ত্বাবধানে এই কার্যক্রম পালিত হয়।এতে ৬-৫৯ মাস বয়সী সকল শিশুদের ভিটামিন এ ক্যাপস্যুল খাওয়ানো ও প্রয়োজনীয় পুষ্টিসেবা নিশ্চিত করা হয়।সরকারের পাশাপাশি পুষ্টিসেবা বাস্তবায়নকারী দেশি-বিদেশি বেসরকারি সংস্থা এই কার্যক্রমে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।

মিয়ানমার প্রতিনিধির ক্যাম্প পরিদর্শনঃ উখিয়ায় রোহিঙ্গা শিবির পরিদর্শন করেছেন মিয়ানমার সরকার কর্তৃক গঠিত ‘ইনডিপেনডেন্ট কমিশন অব ইনকোয়ারি টিম’-এর একটি প্রতিনিধিদল। ২০ আগস্ট সকাল থেকে তাঁরা বালুখালী ও জামতলী আশ্রয়শিবিরের বিভিন্ন ব্লক ঘুরে দেখেন। তবে এ সময় নিরাপত্তার অজুহাত তুলে কোনো রোহিঙ্গা ওই দলের সঙ্গে কথা বলেননি। চার সদস্যের ওই তদন্ত দলের নেতৃত্বে ছিলেন ফিলিপাইনের সাবেক পররাষ্ট্রমন্ত্রী রোজারিও মানালো। কমিটির অন্য তিন সদস্য হলেন মিয়ানমারের সাংবিধানিক ট্রাইব্যুনালের সাবেক চেয়ারম্যান মিয়া থেইন, জাতিসংঘে জাপানের সাবেক স্থায়ী প্রতিনিধি কেনজো ওশিমা ও ইউনিসেফের সাবেক জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তা অন তুন থেট।

আসিয়ান টিম ভিজিটঃ ১৮ ডিসেম্বর কুতুপালংয়ের মধুরছড়া রোহিঙ্গা ক্যাম্প পরিদর্শন করেন আসিয়া ও মিয়ানমার প্রতিনিধি দলের সদস্যরা। মিয়ানমারের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের আন্তর্জাতিক ও অর্থনৈতিক বিভাগের মহাপরিচালক সিন আয়ের এই টিমের নেতৃত্বে ছিলেন।
আন্তর্জাতিক আদালতে গণহত্যার অভিযোগে বিচার কার্যক্রম বিষয়ে আলোচনা ও মিয়ানমারে রোহিঙ্গাদের ফিরে যাওয়ার অনুরোধ করতেই দ্বিপক্ষীয় বৈঠকের মূল কারণ বলে জানা গেছে। 19/12/2019 রোহিঙ্গাদের সাথে আরেক দফা বৈঠক করার কথা রয়েছে প্রতিনিধি দলের। রোহিঙ্গাদের মিয়ানমারে ফিরে যেতে রাজি করানোর জন্য আসিয়ান এর সিনিয়র কর্মকর্তা রোহিঙ্গা ক্যাম্প পরিদর্শন করে রোহিঙ্গা প্রতিনিধিদের সাথে মতবিনিময় করেন।স্বদেশে ফিরে যাবার শর্ত হিসাবে রোহিঙ্গারা তাদের পূর্ণ নাগরিকত্ব প্রদান ও তাদের ভিটাবাড়ি ফেরতের দাবী উত্থাপন করে।

কাঁটাতারের ভেড়া নির্মাণঃ ক্যাম্প কমিউনিটির নিরাপত্তা বাড়ানো ও স্থানীদের অধিকার রক্ষায় রোহিঙ্গা ক্যাম্পের চর্তুরপাশে কাঁটাতারের বেড়া নির্মাণের কাজ সম্প্রতি শুরু হয়েছে।যদিও এতে স্থানীয়দের অনেকে ক্ষতিগ্রস্ত হবার অভিযোগ তুললেও স্থানীয় লোকজন অনেকটা স্বাগত জানিয়েছেন।আইন শৃঙ্খলা নিয়ন্ত্রণে এই বেড়া কিছুটা হলেও সহায়ক হবে বলে মনে করা হচ্ছে।মিয়ানমার সরকারকে কাঠগড়ায় দাঁড়করানোঃ রোহিঙ্গাদের উপর মিনামারের নিষ্ঠুরতা নতুন নয়।বিগত কয়েকদশক ধরে রাখাইন অঞ্চলে সংখ্যালঘু এই জনগোষ্ঠীর উপর চরম নির্যাতন চালিয়ে যাচ্ছে মিয়ানমার। আইনকে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়ে বারংবার পার পেলেও এই বারই প্রথম আইন কাঠগড়ায় দাড়াতে হয় তাদের।২০১৭ সালে রাখাইনেে রোহিঙ্গা গনহত্যার অভিযোগ করা হয়েছে আন্তর্জাতিক বিচার আদালতে (আইসিজে)।এর এই ঘটনায় বিশ্ববাসীকে তাক লাগিয়ে দিয়েছেন আফ্রিকার ছোট্ট দেশ গাম্বিয়া। কুশীলব হিসাবে ছিলেন দেশটির এটর্নি জেনারেল ও বিচারমন্ত্রী আবু বকর মারি তামবাদু ও পররাষ্ট্রমন্ত্রী মামাদু। ইসলামিক সহযোগিতা সংস্থা (ওআইসি) এর ভূমিকাও ছিল উল্লেখযোগ্য।

প্রধানমন্ত্রীর চার প্রস্তাবঃ সেপ্টেম্বরে অনুষ্ঠিতজাতিসংঘের সাধারণ পরিষদের ৭৪ তম অধিবেশনে প্রধানমন্ত্রী রোহিঙ্গা ইস্যু দ্রুত সমাধানকল্পে ০৪ টি প্রস্তাব উপস্থাপন করেন।প্রথম প্রস্তাবে বলেন, ‘রোহিঙ্গাদের টেকসই প্রত্যাবাসন এবং আত্মীকরণে মিয়ানমারকে কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণের মাধ্যমে রাজনৈতিক সদিচ্ছার পূর্ণ প্রতিফলন দেখাতে হবে।’দ্বিতীয় প্রস্তাবে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘বৈষম্যমূলক আইন ও রীতি বিলোপ করে মিয়ানমারের প্রতি রোহিঙ্গাদের আস্থা তৈরি করতে হবে এবং রোহিঙ্গা প্রতিনিধিদের উত্তর রাখাইন সফরের আয়োজন করতে হবে।’তৃতীয় প্রস্তাবে শেখ হাসিনা বলেন, ‘আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় থেকে বেসামরিক পর্যবেক্ষক মোতায়েনের মাধ্যমে মিয়ানমারকে রোহিঙ্গাদের নিরাপত্তার ও সুরক্ষার নিশ্চয়তা প্রদান করতে হবে।’প্রধানমন্ত্রী চতুর্থ প্রস্তাবে বলেন, ‘আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়কে অবশ্যই রোহিঙ্গা সমস্যার মূল কারণসমূহ বিবেচনায় আনতে হবে এবং মানবাধিকার লঙ্ঘন ও অন্যান্য নৃশংসতার দায়বদ্ধতা নিশ্চিত করতে হবে।

মিয়ানমার সরকারকে কাঠগড়ায় দাঁড়করানোঃ রোহিঙ্গাদের উপর মিনামারের নিষ্ঠুরতা নতুন নয়।বিগত কয়েকদশক ধরে রাখাইন অঞ্চলে সংখ্যালঘু এই জনগোষ্ঠীর উপর চরম নির্যাতন চালিয়ে যাচ্ছে মিয়ানমার। আইনকে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়ে বারংবার পার পেলেও এই বারই প্রথম আইন কাঠগড়ায় দাড়াতে হয় তাদের।২০১৭ সালে রাখাইনেে রোহিঙ্গা গনহত্যার অভিযোগ করা হয়েছে আন্তর্জাতিক বিচার আদালতে (আইসিজে)।এর এই ঘটনায় বিশ্ববাসীকে তাক লাগিয়ে দিয়েছেন আফ্রিকার ছোট্ট দেশ গাম্বিয়া। কুশীলব হিসাবে ছিলেন দেশটির এটর্নি জেনারেল ও বিচারমন্ত্রী আবু বকর মারি তামবাদু ও পররাষ্ট্রমন্ত্রী মামাদু। ইসলামিক সহযোগিতা সংস্থা (ওআইসি) এর ভূমিকাও ছিল উল্লেখযোগ্য।

পরিশেষে রোহিঙ্গারা ফিরে যাক স্বদেশে, ফিরে পাক তাদের জীবনের পূর্ণ নিরাপত্তা;প্রতিটি শিশু বেড়ে উঠুক অকৃত্রিম ভালবাসা ও মানবাধিকার নিয়ে। ২০২০ সাল হউক সকলের জন্য মঙ্গলময়।

হ্যাপি নিউ ইয়ার-২০২০।

লেখকঃ জিয়াউর রহমান মুকুল, মানবিক ও উন্নয়ন কর্মী, শেড, কক্সবাজার।