অধ্যাপক রায়হান উদ্দিন:
তমদ্দুন বা সংস্কৃতি বা কালচার শব্দট্ধিসঢ়; যে আসলে কি তা নিয়ে লোক সমাজে অনেক বিভেদ রয়েছে। সত্যি বলতে বিজ্ঞদের মধ্যে এ মতভেদ প্রকট। প্রকট এই জন্য যে কালচার জিনিষটার বিভিন্ন দিক নিয়ে পর্যালোচনা করেছেন তাঁরাই বেশী। আসলে এটা সংগত ও বটে। কারণ সংস্কৃতির ব্যাপারটি বিষয়ের দিক থেকে বিরাট ব্যাপার। এক নজরে এর বেড় পাওয়া যায়না। অর্থাৎ যে যেটুকু দেখে শুধু তাই পর্যালোচনা করে। মানুষের কল্পণার রং যেমন বিচিত্র ঠিক সংস্কৃতির রং ও তেমন বিচিত্র। সুতরাং মতভেদ হওয়াটা স্বাভাবিক। সংস্কৃতি বলতে আমরা মননস্নিগ্ধ অনুভুতি প্রধান এক বিশেষ ধারায় নানা উপাদান কে বুঝি। কোন চিজকে ধুয়ে মুছে কেটে ছেঁটে সুন্দর করার জন্য মানুষের অন্তর্নিহিত আকাংখা থেকেই সংস্কৃতির উদ্ভব। একজন ঐতিহাসিক বলেছেন যন্ত্রে যেমন ভারী (ক্রুড) তেলের প্রয়োজন হয় তেমনি আমাদের আদি পুর্ব পুরুষদের জীবিকার পক্ষে প্রয়োজনীয় ছিল সেদিনকার আত্মিক মনন বা বাসনাগত উপাদান। যা ভারী তেলের মতো মোটা তবে কাজের জিনিষ। নিতান্ত স্থুল হলেও সাধারণ জৈব প্রবৃত্তির সংস্কার সাধিত হয়েছিল মানুষের বেলায় এই মনুষ্যত্ব যে বস্তুতে আত্মপ্রকাশ করেছিল তারা স্বভাবতই সংস্কার সাধিত জীবন যাত্রায় অবলম্বন। এদের নিয়ে এলো সংস্কৃতি। মানুষ বাঁচবার উপায় যতটুকু সম্ভব প্রকৃতির নিকট থেকে আদায় করে নিতে চায় । এই জীবিকার প্রয়াস থেকেই মানুষের ইতিহাসের শুরু আর সংস্কুতির সুত্রপাত ও সেখান থেকেই। মানুষ চায় বিরুপ প্রকৃতিকে জয় করে নিজের জীবনকে সুন্দর করতে। মানব প্রকৃতির এই সাধনাকে বলবো সংস্কৃতি। জীবিকার প্রয়োজনে এর উৎপত্তি। উৎপাদন ব্যবস্থা ও উৎপাদন শক্তিই সংস্কৃতির ভিত্তি। এমনি ভাবে জীবিকার নুতনতর উপকরণের আবিস্কার ও মানস সম্পদের পরিপুস্টিতে মানুষ উদ্বুদ্ধ হচ্ছে। নুতন কিছু সৃস্টির সাথে অতীতের উৎপাদন যোগ হচ্ছে। আবার হয়তো কিছু লয় হচেছ।এভা্েব সংস্কৃতিতে ঘটছে নিত্য রুপান্তর। আগেই বলেছি সংস্কৃতির বেড় কতটুকু কেউ জানেনা।ইসলামী বিশেষজ্ঞরা সংস্কৃতি বা তমদ্দুন এর ব্যাখ্যা দিয়েছেন তাঁদের মতে তমদ্দুন এসেছে আরবী শব্দ” মদীনা” থেকে। মদীনা অর্থ শহর অর্থাৎ শহর সুলভ মার্জিত চিন্তাভাবনাকে তমদ্দুন বলা যেতে পারে। প্রাচীন কোন পাথরকে মার্জিত করলে তা হয়ে উঠে হিরা, জওহর। জমিনকে মার্জিত করলে তা হয়ে উঠে বাগান । আর মানুষের চিন্তা ভাবনাকে কথা ও কাছে ফুটিয়া তোলার নামই সংস্কৃতি। বিজ্ঞানীরা জীবন সংগ্রামের বাস্তব উপকরন থেকে সংস্কৃতির অবয়ব তৈরী করেছেন। তাঁরা সংস্কতির ধারা বিবর্তনের কয়েকটি বৈশিষ্ঠের কথা বলেছেন । যেমন উপাদানের উপস্থিতি, সৃষ্ঠি ও লয়। এই তিন বৈশিষ্ঠে চলছে নিয়মিত ঘাত প্রতিঘাত। ফলে জন্ম নিচ্ছে নুতন চেতনা, নুতন চিন্তা। উন্নত হচ্ছে মানস সম্পদ। এমনি ঘাত প্রতিঘাতের মধ্যে দিয়ে সাংস্কৃতি বিবর্তনের সৃষ্ঠি হচ্ছে। জীবনের সুন্দর তপস্যাই তমদ্দুন। উপনিষদের বাণীতে তা প্রকাশ পেয়েছে,“সত্যম শিবম সুন্দরম”। অর্থাৎ সত্যই কল্যান সত্যই সুন্দর। আবার জন কিটস এর ভাষায় সুন্দর সত্য , সত্যই সুন্দর। মানুষ সুন্দরের সন্ধানে কঠিন পথে চলে। গৌতম বুদ্ধ মুক্তির সন্ধানে কঠিন তপস্যায় ডুবেছিলেন। অনাহারে তার দেহ শুকিয়ে যায়, পাজরের হাড়গুলি করুণভাবে চেয়ে থাকে।অবশেসে গৌতমও উঠেন। তিনি বুঝলেন কৃচ্ছসাধনায় মুক্তি নাই।হিন্দু সমাজ ও প্রাথমিক যুগের সন্ন্যাসব্রত প্রায়ই পরিহার করে চলেছে। মহানবী হযরত মোহাম্মদ (দ:) বলেছেন, ভাল খেয়ে দেয়ে তৃপ্তির নিশ্বাস ফেল এটিও এবাদত। ”মওলানা রূমী ছিলেন একজন মহা জ্ঞানী তাপস।একদিন তিনি আপন কক্ষে ধ্যান মগ্ন। হঠাৎ শুনতে পেলেন কে একজন রাস্তায় বীণা বাজিয়ে চলেছেন। জ্ঞান তাপস উদভ্রান্তের মতোমতো বেরিয়ে এসে তাঁকে আকুল কন্ঠে বললেন ”থামো বন্ধু থামো , তুমি ঠিক আছো, আমি পথ ভুলে ঘুরে ঘুরে মরছি। তোমার বীনার তারে আঘাত কর। এরই ঝংকারের পথে আমার তওবাকে উপরে পাঠিয়ে দিই।” বিভিন্ন জাতির বিকাশের ধারনা বিভিন্ন এবং এ বিকাশ সাধনার পথ ও ভিন্ন । প্রাচীন রোম আইনের অনুশীলন ও এর অনুসরন করে জ্ঞান সাধনাকে বিকাশের পরম পথ বলে জেনেছিল।মুসলমানরা বিশ্বভ্রাতৃত্ব,হক ইনসাফ, নারীর মার্যাদা ও জ্ঞানানুশীলনেই বিকাশ সাধনের পথ খুজে পেয়েছিল। মহানবীর সত্য বাণীতে উদ্বুদ্ধ হয়ে মুসলমানরা পাগল হয়ে জাতি ধর্মনির্বিশেষে সকলের কাছ থেকে তমদ্দুনের উপকরণ আহরন করেছে। ইসলামী তমদ্দুনের কল্যানী প্রভাব বিভিন্ন জাতির সমাদর লাভ করেছে। যেমন হিন্দু ধর্মের মৌলিক সুত্র হচ্ছে জন্মন্তরবাদ। শ্রীচৈতন্য দেখতে পেলেন অনেকে পর জনমে পুন্য করবে এ আশায় ইহ জনমে পাপ করতে দ্বিধা করেননা। অথচ মুসলমানদের একবারমাত্র জন্ম। তা এ জগতেই বেহেশতের আশায় পুণ্যের কাজ করে। ইসলামের এ শিক্ষায় জন্মান্তরবাদ সম্পর্কে ধারনা পল্টে দিলেন। জাতি ভেদ বর্জিত ইসলাম ধর্মের বিরাট আবেদন হিন্দু ধর্মে লোকজনদের যথেষ্ট প্রভাবিত করেছিল।আবার হিন্দু সংস্কৃতিও মুসলমানদের কম প্রভাবিত করেনি। অনেকে বৈষ্ণব পদাবলী রচনা করেন।সংস্কৃতি আলোচনা প্রসংগে অনেকে আমাদের পান্ডব বর্জিত দেশের অধিবাসী মনে করেন।তাঁদের ধারনায় ধার্মিক পঞ্চপান্ডব এদেশে কোন কালেই আসেনি ।তাই দ্রোপদীতত্বের ঐতিহ্য আমাদের নেই। আসলে নাগরিক সংস্কৃতি বলতে যা বোঝায় আমাদের তা কোন কালে ছিলনা। বাংলার সংস্কৃতি মুলত গ্রামীন জীবনকে নিয়ে ,বাংলার মাটি , বাংলার আপামর জনসাধারন কে নিয়ে শুধু প্রত্যান্ত এলাকাবাসী বলেই বাংলার জনসাধারন নগর সংস্কৃতির বাইরে ছিল তা নয়। আরো কারণ রয়েছে। যেমন এদেশে ঢাকা কিংবা মুর্শিদাবাদ ব্যতীত আর কোন শহর গড়ে উঠেনি। বাংলার জনবীবন ছিল মুলত: কৃষি ও গ্রাম ভিত্তিক। আর সেই গ্রাম ছিল স্বয়ং সম্পুর্ন। তাতী , কামার , কুমার , ইত্যাদী নিয়ে এক একটি গ্রাম ছিল এক একটি পৃথিবী। স্বতৃপ্ত ও স্বয়ং স¤পুর্ন ছিল বলে গ্রামে কোন শ্রেনী সংগ্রাম ছিলনা তা নয় , তবে শ্রেনী বিপ্লব ঘটেনি। দ্রোপদীতত্বের ঐতিহ্য আমাদের ছিলনা, আর নেই বলে আমরা কুরুক্ষেত্রও ঘটাতে পারিনি। উনবিংশ শতাদ্বীর জন্ম লগ্ন থেকে এদেশের সংস্কৃতির রং অনেকদুর পাল্টে গেছে । সে যুগের রমার (পল্লী সমাজের নায়িকা) কপালের রং ঠোঠে নেমে এসছে। গ্রামে গঞ্জে আধুনিক ভারী শিল্পের হাওয়া বইতে শুরু করেছে। আর আমাদের সংস্কৃতিতে চলছে অনিশ্চয়তার প্রচন্ডরুপ। তাতে করে যদি রমার কপালের কপালের রং ঠোঠে নেমে আসে তাতে বিম্মিত হওয়ার কিছু নেই।