ইমাম খাইর, খান জাহান আলীর মাজার থেকে:

হজরত খান জাহান আলী (রহ.)। একাধারে একজন সূফি, সিপাহ্সালার, ইসলাম প্রচারক ও স্থপতি। মহান সাধকের নামটি ছোট্ট কাল থেকে শুনে আসছিলাম। বইয়ের পাতায় কত্তো কাহিনী পড়েছি। আগ্রহ ছিল তার সমাধিস্থল দেখার। দীর্ঘদিনের পরিকল্পনা, অবশেষে আজ (২৬ ডিসেম্বর) পৌঁছলাম মহান এই গুণীজনের মাজারে। দেশে প্রচলিত মজারগুলোতে শিরকি কর্মকাণ্ড চললেও এটি কিন্তু ভিন্ন।

বিভিন্ন সুত্র ও উইকিপিডিয়া থেকে প্রাপ্ত তথ্য বলছে, ১৩৬৯ খ্রিস্টাব্দে দিল্লির এক সম্ভ্রান্ত পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন খান জাহান আলী। তার পিতার নাম আকবর খাঁ এবং মাতার নাম আম্বিয়া বিবি। খান জাহান আলীর প্রাথমিক শিক্ষা তার পিতার কাছে শুরু হলেও তিনি তার মাধ্যমিক শিক্ষা গ্রহণ করেন দিল্লির বিখ্যাত অলি ও কামেল পীর শাহ নেয়ামত উল্লাহর কাছে। তিনি কোরআন, হাদিস, সুন্নাহ ও ফিকহ শাস্ত্রের ওপর গভীর জ্ঞানার্জন করেন।

খান জাহান আলী ১৩৮৯ খ্রিস্টাব্দে তুঘলক সেনাবাহিনীতে সেনাপতির পদে কর্মজীবন আরম্ভ করেন। অতি অল্প সময়ের মধ্যেই প্রধান সেনাপতি পদে উন্নীত হন। ১৩৯৪ খ্রিস্টাব্দে মাত্র ২৭ বছর বয়সে তিনি জৈনপুর প্রদেশের গভর্ণর পদে যোগ দেন। পরবর্তী জীবনে নানা ধাপ পেরিয়ে জৈনপুর থেকে প্রচুর অর্থসম্পদ এবং প্রায় চল্লিশ হাজার সৈন্যের এক বিশাল বাহিনী নিয়ে বাংলাদেশে আগমন করেন। তার এই বাহিনীতে কয়েকজন সূফি ও প্রকৌশলী ছিল। তিনি তদানীন্তন বাংলার রাজধানীর দিকে না যেয়ে অজ্ঞাত কারণে সুন্দরবন অঞ্চলের দিকে আসেন।

হজরত খান জাহান আলী (রহ.)-এর প্রকৃত নাম উলুঘ খান। নাম দৃষ্টে অনুমিত হয় তিনি তুর্কি বংশীয়। খান জাহান তার উপাধি বিশেষ। বৃহত্তর যশোর-খুলনা অঞ্চলে তিনি পীর খাঞ্জালি নামে সমধিক পরিচিত।

তিনি প্রথম বর্তমান যশোর শহর থেকে ১১ মাইল উত্তরে অবস্থিত বারোবাজারে এসে ছাউনি ফেলেন। প্রাচীনকালে এই বারোবাজার গঙ্গারিডীর রাজধানী ছিল। খানজাহান আলীর আগমনে এই প্রাচীন নগরী নতুন করে প্রাণ লাভ করে। এখানে একটি দীঘি খনন করা হয় এবং নির্মিত হয় একটি মসজিদ। তবে এখানে তিনি বেশিদিন থাকেন নি। কিন্তু তার স্মৃতি থেকে যায়। মসজিদটি খাঞ্জালি মসজিদ হিসেবে অভিহিত।

বারোবাজার থেকে খান জাহান আলী মুরলিতে এসে অবস্থান করেন। তার বিশাল বাহিনীর আগমনে এখানেও একটি শহর গড়ে ওঠে। এখানেও তিনি অবস্থান করেননি। অনেক পথ সফর শেষে খান জাহান আলী সদলবলে বাগেরহাটে এসে স্থায়ী বসত স্থাপন করেন। নির্মাণ করেন ষাট গম্বুজ, নয় গম্বুজ মসজিদ। ষাট গম্বুজ মসজিদের গম্বুজ সংখ্যা আসলে ৭৭টি। এটা যেমন ছিল নামাজের স্থান, তেমনি ছিলেএকটি সেনানিবাস।

তিনি এই বৃহৎ অঞ্চলে কৃষি বিপ্লবের সূচনা করেন। নোনা পানির এই অঞ্চলে মিঠা পানির ব্যবস্থা করেন অসংখ্য বিশাল বিশাল দীঘি খনন করে, যার অনেকই খাঞ্জালির দীঘি নামে পরিচিত। অনেক সুরম্য রাস্তা নির্মাণ করেন। তার নির্মিত রাস্তা খাঞ্জালির জাঙ্গাল নামে অভিহিত। তিনি এই অঞ্চলে শিক্ষা বিস্তারের লক্ষ্যে বিভিন্ন স্থানে মাদরাসা স্থাপন করেন।

খান জাহান আলী (রহ.) এই অঞ্চলে পাথরের তৈরি মসজিদ নির্মাণ করেন। দূর-দূরান্ত থেকে পাথর নিয়ে আসাকে কেন্দ্র করে অনেক কিংবদন্তি এই অঞ্চলের মানুষের মুখে মুখে এখনও শোনা যায়।

তার মাজারের এক শিলালিপিতে লেখা রয়েছে, ‘আল্লাহর নগণ্য বান্দা রাব্বুল আলামিনের রহমত প্রত্যাশী সাইয়েদুল মুরসালিনের অনুরক্ত খাঁটি আলেমগণের বন্ধু ইসলাম ও মুসলিমগণের প্রতিষ্ঠাকারী উলুগ খান-ই জাহান- তার প্রতি বর্ষিত হোক আল্লাহর রহমত ও সন্তুষ্টি।

আরবি তারিখের হিসাব অনুযায়ী হিজরি ৮৬৩ সালে হজরত খান জাহান আলী (রহ.) প্রায় ১০০ বছর বয়সে বাগেরহাটের নিজ বাড়িতে নামাজরত অবস্থায় ইন্তেকাল করেন। ইংরেজি তারিখ মতে সেদিন ছিল ১৪৫৯ খ্রিস্টাব্দের ২৫ অক্টোবর।

খান জাহান আলী (রহ.)-এর মাজারের সামনেই রয়েছে বিশাল দীঘি। কিছুদিন পূর্বেও এই এই দীঘিতে বিশালাকারের কুমির ছিল। এই কুমির নিয়ে নানা ধরনের জনশ্রুতি রয়েছে।

স্থানীয়রা জানিয়েছে, প্রতি বছর চৈত্র মাসের পূর্ণিমার সময় খান জাহান আলীর মাজারে ওরস অনুষ্ঠিত হয় এবং লক্ষাধিক লোক তাতে সমবেত হয়।