মুহাম্মদ আবু সিদ্দিক ওসমানী :

মিয়ানমারের বিরুদ্ধে গাম্বিয়ার করা রোহিঙ্গা গণহত্যা মামলার শুনানি মঙ্গলবার ১০ ডিসেম্বর শুরু হচ্ছে। এ নিয়ে কক্সবাজারের উখিয়া-টেকনাফের ৩২ টি রোহিঙ্গা শরনার্থী ক্যাম্পে প্রায় ১২ লক্ষ উদ্বাস্তুদের মধ্যে কৌতুহল ও উদ্বেগের অন্ত নেই।

পশ্চিম আফ্রিকার ছোট এই দেশটির বক্তব্যের মধ্য দিয়ে নেদারল্যান্ডসের দ্য হেগে অবস্থিত আন্তর্জাতিক বিচার আদালতে (আইসিজে) মঙ্গলবার ১০ ডিসেম্বর গাম্বিয়ার রোহিঙ্গা গণহত্যার শুনানি শুরু হচ্ছে। শুনানি চলবে আগামী বৃহস্পতিবার ১২ ডিসেম্বর পর্যন্ত।

বুধবার হবে মিয়ানমারের শুনানি, যাতে অংশ নেবেন নোবেলজয়ী অং সান সু চি। এরপর বৃহস্পতিবার সকালে গাম্বিয়া এবং বিকালে মিয়ানমার নিজ নিজ প্রতিপক্ষের যুক্তি খণ্ডন ও চূড়ান্ত বক্তব্য পেশ করবে। তবে মিয়ানমার কর্তৃপক্ষ চুড়ান্ত শুনানির জন্য হেগের আন্তর্জাতিক আদালতে সময়ের প্রার্থনা করবেন বলে বিশ্বস্থ সুত্রে জানা গেছে। বিচার প্রক্রিয়া বিলম্বিত করতেই মিয়ানমারের সময় চাওয়ার প্রধান কারণ বলে জানা গেছে।

গাম্বিয়ার পক্ষে শুনানিতে অংশ নেবেন দেশটির অ্যাটর্নি জেনারেল ও আইনমন্ত্রী আবুবকর মারি তামবাদু। রুয়ান্ডা গণহত্যার জন্য গঠিত আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে মামলা পরিচালনার অভিজ্ঞতায় সমৃদ্ধ আবুবকর মারি তামবাদু। রুয়ান্ডা গণহত্যা মামলায় আন্তর্জাতিক আদালতে গাম্বিয়া জিতেছিলেন।

তার সঙ্গে আন্তর্জাতিক আইন বিশেষজ্ঞ যুক্তরাজ্যের প্রফেসর ফিলিপ স্যান্ডসসহ বিশ্ব পরিসরে নেতৃস্থানীয় কয়েকজন আইনজ্ঞের শুনানিতে অংশ নেয়ার কথা রয়েছে। গাম্বিয়া ও মিয়ানমারের পাশাপাশি বাংলাদেশ এবং কানাডার প্রতিনিধিরা শুনানির সময় পিস প্যালেসে থাকবেন।
বাংলাদেশ-কানাডার পাশাপাশি নেদারল্যান্ডস নেপথ্যে থেকে গাম্বিয়াকে সহযোগিতা করবে বলে সুত্রটি সিবিএন-কে নিশ্চিত করেছেন।

কানাডা ও নেদারল্যান্ডসের পক্ষ থেকে সোমবার ৯ ডিসেম্বর দেয়া এক যৌথ বিবৃতিতে বলা হয়েছে, গণহত্যায় দায়ীদের বিচার সুনিশ্চি করতে গাম্বিয়ার এই উদ্যোগকে সাধুবাদ জানাই এবং এর প্রতি আমাদের পূর্ণ সমর্থন রয়েছে। মিয়ানমারে রোহিঙ্গাদের ওপর কয়েক দশক ধরে নির্যাতন চালানো হচ্ছে। সর্বশেষ গণহত্যা, ধর্ষণ, জ্বালাও-পোড়াও, লুটপাট, বাস্তুচ্যুতের ঘটনা বিশ্ববাসী প্রত্যক্ষ করেছে। নির্যাতনের শিকার রোহিঙ্গাদের রক্ষা করতে হবে।

আইজিসেতে বিচারের মাধ্যমে গণহত্যায় দায়ীদের শাস্তি নিশ্চিতে কানাডা ও নেদারল্যান্ডস সচেষ্ট। অন্য সব দেশকে এক্ষেত্রে এগিয়ে আসার আহ্বান জানিয়েছেন। মামলার শুনানি শুরুর আগেই মিয়ানমারকে আন্তর্জাতিকভাবে বয়কট করার আহ্বান জানিয়ে প্রচার শুরু হয়েছে।

দেশটির রোহিঙ্গা মুসলিমদের সমর্থনকারী মানবাধিকার কর্মীরা বিশ্বব্যাপী এ প্রচার চালাচ্ছেন। ১০টি দেশের শিক্ষাবিদ, পেশাজীবী সংগঠন ও ৩০ আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংগঠনের কর্মীরা একযোগে এ প্রচার শুরু করেছেন।

এদিকে, আইসিজের শুনানিতে সরাসরি কোনো পক্ষ না হলেও গাম্বিয়াকে লজিস্টিক সহায়তা দেবে বাংলাদেশ। এ লক্ষ্যে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সচিব (দ্বিপক্ষীয় বিভাগ) মাসুদ বিন মোমেন এক প্রতিনিধি দল নিয়ে দ্য হেগে সোমবার ৯ ডিসেম্বর পৌঁছেছেন। ২০ সদস্যের ওই প্রতিনিধি দলে কক্সবাজারে আশ্রয় নেয়া ৫ রোহিঙ্গা শরনার্থীও রয়েছেন। যাঁরা গাম্বিয়ার হয়ে হেগের আন্তর্জাতিক আদালতে সাক্ষ্য দেবেন। দলে আন্তর্জাতিক আইন বিশেষজ্ঞ এবং নাগরিক সমাজের প্রতিনিধিকেও রাখা হয়েছে। তারা তথ্য-উপাত্ত নিয়ে হেগে রোহিঙ্গা গণহত্যা মামলার শুনানিতে উপস্থিত থাকবেন।
রোহিঙ্গাদের উপর মিয়ানমারের গণহত্যা মামলার শুনানিতে হেগের বিশ্ব আদালতে
মিয়ানমারের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি হবে এমনটাই প্রত্যাশা সকলের। এ নিয়ে কক্সবাজারের ৩২ টি রোহিঙ্গা শরনার্থী ক্যাম্পে আশ্রয় নেওয়া প্রায় ১২ লক্ষ রোহিঙ্গা শরনার্থীদের মাঝে হেগের আন্তর্জাতিক আদালতে কি হচ্ছে, তা নিয়ে কৌতুহলের অন্ত নেই। আন্তর্জাতিক আদালতে বিচার প্রক্রিয়ার মাধ্যমে মিয়ানমারের গণহত্যাকারীদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি হবে বলে আশা করেন আশ্রয় নেয়া নির্যাতিত রোহিঙ্গারা।

বাংলাদেশের পার্শ্ববর্তী মিয়ানমারের আরাকান রাজ্যে মিয়ানমার সেনাবাহিনীর নজিরবিহীন গণহত্যায় প্রাণ হারায় হাজার হাজার রোহিঙ্গা মুসলিম নারী, শিশু ও পুরুষ। সেনাবাহিনীর পোড়ামাটি নীতির কারণে অগ্নি সংযোগ করা হয় লাখ লাখ রোহিঙ্গা মুসলমানদের বাড়ি-ঘরে। ২০১৭ সালের ২৫ আগস্টের পরে লাখ লাখ রোহিঙ্গা নারী-পুরুষ মিয়ানমারে তাদের চৌদ্দপুরুষের ঘরবাড়ি, সহায়-সম্পদ ছেড়ে পালিয়ে আসেন বাংলাদেশে। কক্সবাজার জেলার মিয়ানমার সীমান্তবর্তী উখিয়া-টেকনাফের ৩২ টি আশ্রয় শিবিরে বাংলাদেশ সরকার তাদের মানবিক কারণে আশ্রয় প্রদান করে।

রোহিঙ্গা সংকটের শুরু থেকেই মিয়ানমারের বিরুদ্ধে অভিযোগ ছিল, রোহিঙ্গাদের ওপর গণহত্যা চালিয়ে রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীকে নির্মূল করার। বিষয়টি মিয়ানমার বার বার অস্বীকার করে আসলেও বিশ্ব সম্প্রদায়ের চাপে সম্প্রতি হেগের আন্তর্জাতিক আদালতে গাম্বিয়া মিয়ানমার সরকারের বিরুদ্ধে রোহিঙ্গাদের উপর গণহত্যার এই মামলাটি দায়ের করে। হেগের আন্তর্জাতিক ক্রাইম আদালতে মিয়ানমারের রোহিঙ্গা গণহত্যার বিচার মঙ্গলবার ১০ ডিসেম্বর থেকে শুনানী হচ্ছে জেনে কক্সবাজারের উখিয়া-টেকনাফে আশ্রয় নেয়া রোহিঙ্গাদের মাঝে দেখা দিয়েছে মিশ্র প্রতিক্রিয়া। তারা বিশ্ব সম্প্রদায়ের চাপে মিয়ানমার বিচারের মুখোমুখি হওয়ায় তারা যেমন খুশী ও কৌতুহলী। অন্যদিকে, মিয়ানমারের কিছু হিন্দুকে মুসলমান সাজিয়ে হেগের আদালতে নিয়ে গেছে মিয়ানমার। মিয়ানমারের পক্ষে হিন্দুকে মুসলমান সাজিয়ে হেগের আন্তর্জাতিক আদালতে সাক্ষী দেওয়ার জন্য হেগে আন্তর্জাতিক আদালতে নিয়ে গেছে বলে জেনে মিয়ানমারের বিরুদ্ধে গণহত্যার বিষয়টি আদৌ প্রমানিত হবে কিনা, তা নিয়ে রোহিঙ্গা শরনার্থীরা বেশ উদ্বিগ্ন পড়েছে। অভিযোগ উঠেছে, এসব হিন্দুরা মুসলমান সেজে কিভাবে আদালতকে বিভ্রান্ত করবে তার মহড়াও নাকি হেগে যাওয়ার আগে করা হয়েছে মিয়ানমারে। হিন্দুকে মুসলমান সাজিয়ে নেওয়া মিয়ানমার পক্ষের হেগে নিয়ে যাওয়া কথিত এসব সাক্ষী ইংরেজি ভাষাতেও নাকি বেশ পারদর্শী। রোহিঙ্গা শরনার্থীদের অনেকেই বলছেন, মিয়ানমারের এ ধরণের কূটকৌশলে বিচার প্রক্রিয়া বিলম্বিত হওয়ার আশংকা রয়েছে। এব্যাপারে সরকারের সংশ্লিষ্ট বিভাগ গাম্বিয়াকে সহযোগিতা দিয়ে যাচ্ছে বলেও জানা গেছে আরআরসি অফিস সূত্রে।

এদিকে মিয়ানমারের সংবাদমাধ্যমগুলো সূত্রে জানা গেছে , দেশটির বেসামরিক অংশের নেত্রী ও স্টেট কাউন্সিলর অং সান সুচি তার দেশের পক্ষে আইনি লড়াইয়ে নেতৃত্ব দিতে ইতোমধ্যেই হেগে পৌঁছেছেন। এর আগে ৭ ডিসেম্বর চীনের পররাষ্ট্রমন্ত্রী উয়াঙ ই (Wang Yi) মিয়ানমারে অং সান সুচি’র সাথে সাক্ষাত করেছেন। তবে তিনি সুচিকে কি বার্তা দিয়েছেন তা জানা যায়নি।