ছৈয়দ আলম :
কক্সবাজারে প্রতি বছরই বাড়ি ভাড়া বাড়ছে। বিশেষ করে ২০১৭ সালে বানের স্রোতের মতো রোহিঙ্গা আসার পর থেকে এলাকা ভেদে বাড়ি ভাড়া বাড়ছে ৫০০-৫০০০ টাকা পর্যন্ত। এক্ষেত্রে কোনও নিয়মনীতির তোয়াক্কা করেন না বাড়ির মালিকরা। ভাড়া বৃদ্ধির অতিরিক্ত টাকা দিতে না চাইলে কোনও ধরনের নোটিশ না দিয়ে বাড়ি থেকে বের করে দেওয়ার হুমকি দেওয়া হচ্ছে। এমনকি বাড়ি থেকে বের না হওয়ায় থানা পর্যন্ত বিচার গড়িয়েছে। কিন্তু এগুলো দেখার বা তদারকির কেউ নাই। ফলে চরম দুর্ভোগে পড়ছেন ভাড়াটিয়ারা।
তবে বাড়িওয়ালারা জানান, এনজিওদের দুই-তিনগুন বৃদ্ধিতে ভাড়া দেয়া, নিত্য প্রয়োজনীয় দ্রব্য, বিদ্যুৎ ও গ্যাসের দাম বৃদ্ধি পাওয়ায় তারা ভাড়া বৃদ্ধি করতে বাধ্য হচ্ছেন। এছাড়া তাদের কোনও উপায় নেই।
তথ্যনুন্ধ্যানে জানা গেছে, কক্সবাজার ও রোহিঙ্গা অধ্যুষিত সব এলাকাতেই বাসাভাড়া বাড়ছে। লাগামহীন বাড়ি ভাড়ায় বিপর্যস্ত নিম্ন ও মধ্য আয়ের মানুষ। কক্সবাজার শহর ও উখিয়া-টেকনাফের বিভিন্ন এলাকার অন্তত ১০ জন ভাড়াটের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, প্রতিবছরই বাড়ির মালিক ভাড়া বাড়ান। সেই সাথে বেড়েছে নিত্যপণের দামও। তার মুল কারন হচ্ছে রোহিঙ্গা আগমন।
ভাড়াটিয়ারা ক্ষোভের সাথে জানান-প্রতি বছর লাগামহীনভাবে বাড়ছে বাসা ভাড়া। ৬ মাস পর বা বছরের শুরুতে ভাড়া বাড়ানো যেন নিয়মে পরিণত হয়েছে। আইন অমান্য করে বাড়ানো হচ্ছে বাড়ি ভাড়া। এক্ষেত্রে মানা হচ্ছে না কোনো আইনকানুন। বাসা ভাড়া দেয়ার ক্ষেত্রে মালিকের কথাই যেন আইন। ভাড়াটিয়াদের ভাড়া রসিদে দেয়ার নিয়ম থাকলেও মালিকরা রসিদ দেন না।
শহরের নতুন বাহারছড়া এলাকার ভাড়াটিয়া আনোয়ার বলেন-নতুন বছরের শুরুতেই বাসা ছেড়ে দিতে ইতিমধ্যে বাড়ির মালিকের কাছ থেকে ভাড়াটিয়াদের অনেকেই পেয়েছেন ভাড়া বৃদ্ধির ‘লাল নোটিশ’। বিদ্যমান হারে বাসাভাড়া দিতে এমনিতেই হাঁসফাঁস অবস্থা শহরবাসীর। সেখানে তিনিও পেয়েছেন লাল নোটিশ। হোটেলে সামান্য চাকরী করে বাসাভাড়া দেয়া দু-সাধ্য হয়ে উঠেছে।
তিনি বলেন-ভাড়া বৃদ্ধি করার মুল কারন রোহিঙ্গা আসার পর কক্সবাজারে প্রায় দুইশত এনজিও কাজ করছে। তারা থাকছে প্রায় শহরে। সেজন্য সাধারণ মানুষের চেয়ে তিনগুন বাসাভাড়া নিয়ে বসবাস করছে এনজিওর কর্তাব্যক্তিরা। তার কারনে বাসাভাড়া বৃদ্ধি ভাবিয়ে তুলেছে সাধারণ মানুষকে। বিশেষ করে মধ্যবিত্ত ও নিম্নবিত্তদের নাভিশ্বাস উঠছে বাসা ভাড়া পরিশোধ করতে গিয়ে। এদিকে বাড়িওয়ালাদের দাবি-নিত্যপণ্যের দাম অস্বাভাবিক বৃদ্ধি, গৃহনির্মাণ ঋণের সুদের হার বৃদ্ধি, দফায় দফায় বিদ্যুৎ-জ্বালানির দাম বৃদ্ধির কারণে বাড়ি ভাড়া বাড়ানো হচ্ছে।
অনুসন্ধ্যানে জানা গেছে-কক্সবাজার শহরে বসবাসরতদের মধ্যে ৮০ শতাংশই ভাড়াটিয়া। এ বিপুলসংখ্যক জনগোষ্ঠী প্রতিটি বছর শুরু করেন বাড়তি ভাড়ার বোঝা ঘাড়ে নিয়ে। ৫ হাজার টাকার বাড়ি ভাড়া ২ থেকে ৩ হাজার টাকা বৃদ্ধি করে নেয়া হচ্ছে। ১০ হাজার টাকা বাড়ি ভাড়া দুই হাজার টাকা থেকে ৩ হাজার টাকা বাড়িয়ে এখন নেয়া হচ্ছে ১৩ হাজার টাকা। ২০ হাজার টাকার বাড়ি ভাড়া বাড়িয়ে নেয়া হচ্ছে ২৩ হাজার টাকা থেকে ২৫ হাজার টাকা পর্যন্ত। তারপরেও এনজিওদের জন্য কোন বাসাভাড়া পাওয়া যাচ্ছেনা। শহরের কোথাও কোন নতুন বিল্ডিং তৈরীর কাজ চোখে দেখলে ও খেঁাজ নিয়ে সেখানে অগ্রিম টাকা দিয়ে দখলে রাখছে এসব এনজিওতে কর্মরত কর্মকর্তা-কর্মচারীরা।
কক্সবাজার পিপলস ফোরামের মুখপাত্র সাংবাদিক এইচএম নজরুল ইসলাম বলেন-রোহিঙ্গাদের প্রভাবে কক্সবাজারে বাড়ি ভাড়া নিয়ে নৈরাজ্যে মেতে উঠেছে মালিকরা। রোহিঙ্গাদের নিয়ে কাজ করতে কক্সবাজার শহরে বসবাস করছেন দেশি বিদেশি অনেক মানুষ। তাদের আগমনে বাড়ি ভাড়ার ব্যবসা এখন তুঙ্গে।
এভাবে উখিয়া-টেকনাফের চিত্র আরো ভয়াবহ। ওখানে ঘর ভাড়াকে বড় বাণিজ্য হিসেবে নিয়েছে। এমনও খবর আছে যে, গরুর গোয়াল ঘর পর্যন্ত একটু পরিচর্যা করে বাসা বানিয়ে ভাড়া দিচ্ছে মালিকরা। ওই এলাকায় যে বাসা ৫০০ টাকায় ভাড়া দিতো সেই বাসা ভাড়া দেওয়া হচ্ছে ৫ হাজার টাকায়!
উখিয়া-টেকনাফে আশ্রয় নেয়া প্রায় ১২ লাখ রোহিঙ্গার সেবা প্রদানে কাজ করছে দেশি-বিদেশি এনজিওসহ আন্তর্জাতিক সংস্থার লোকজন। একদিকে রোহিঙ্গা অন্যদিকে তাদের সেবা প্রদানে নিয়োজিত বিভিন্ন সংস্থার কর্মকর্তা-কর্মচারীদের আবাসনের কারণে শহরে বেড়েছে ভাড়া বাসার চাপ। আর এই সুযোগকে কাজে লাগাচ্ছে বাড়ির মালিকেরা। তারা ইচ্ছেমত বাড়ি ভাড়া বাড়াচ্ছে।
কক্সবাজার সিভিল সোসাইটিজ ফোরামের সভাপতি ফজলুল কাদের চৌধুরী জানান, অনেক অসাধু বাড়িওয়ালা লোভে পড়ে পুরাতন ভাড়াটিয়াদের পর্যন্ত বের করে দিচ্ছেন। এমনও দেখা যায় ৪/৫ হাজার টাকা দামের বাসা ভাড়া দিচ্ছে ৮/১০ হাজার টাকায়। অগ্রিম নিচ্ছে ৫০/৬০ হাজার টাকা পর্যন্ত। ফলে কক্সবাজারের অর্থনীতিতে পর্যন্ত মারাত্বক প্রভাব পড়েছে।
কক্সবাজারের জেলা প্রশাসক মো. কামাল হোসেন জানান, কক্সবাজার শহরে বাড়িভাড়া বাড়ার বিষয়টি তিনি অবগত রয়েছেন। এ ব্যাপারে সুনির্দিষ্ট আইন রয়েছে। এ আইন প্রয়োগে শহরের আশপাশে বাড়ির মালিকদের সাথে মিটিং করার পাশাপাশি আইন প্রয়োগকারী সংশ্লিষ্টদের সাথে বসে ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে বলে জানান।