– ড. সলিমুল্লাহ খান

(মাতৃভূমি বলে কথা)
আমার যে দ্বীপে জন্ম সেটার নাম মহেশখালী। এই বর্তমান সরকার পরিকল্পনা করছে জাপানের সাথে সেখানে একটা নয়, দু’টা নয়, তিনটা নয়, পাঁচটা নয়, কয়লা পুড়িয়ে পনেরোটা বিদ্যুৎ কেন্দ্র তৈরি করবে। এবং কক্সবাজার জেলার ৫০ মাইল ব্যাসার্ধের মধ্যে এইরকম ১৭টা হবে! তো সেখানে কি জীবন থাকবে?

আমার মা-বাবার কবর আছে ওখানে। আমার কবর জেয়ারত করতে যেতে হবে। কিন্তু আমি লিখে দিতে পারি ৩০ বছরে সেখানে একটা মানুষ থাকতে পারবেনা! এটা আমি জানি! তো জেনে আমি কী করে বিষণ্ণ না হয়ে থাকবো? আমার ভাই বোনেরা বলে যে, “তুমি তো মহেশখালীতে আসো না।” আমি তো দেখতেই পারছি মহেশখালী থাকবেনা ৩০ বছরের মধ্যে।

মহেশখালী হচ্ছে বাংলাদেশের একমাত্র দ্বীপ যেখানে ৪০-৫০ মাইলের মতো সরকারি সংরক্ষিত পাহাড়ি বন আছে।সেখানে প্রাণী বৈচিত্র্য ছিলো, সেখানে হরিণ ছিলো, একসময় হাতি এবং বাঘও ছিলো। তা এখন দেখা যায় না। সব বিলুপ্ত হয়ে গেছে! এখন যেটা হচ্ছে সেখানে তো একটা জনপ্রাণীও থাকবেনা। এখন যে ভাসানচরে রোহিঙ্গা লোক নিয়ে যেতে চাচ্ছে ধরেন, মহেশখালী তো একটা মরুভূমি তে পরিণত হবে!

আচ্ছা জেনেশুনে যে বিষ আমি পান করছি, বিষণ্ণ কথাটার মধ্যে ‘বিষ’ শব্দটা আছে খেয়াল করছেন? এই যে আমি তো দেখতে পারছি আমার জন্মভূমি হঠাৎ করে একটা মরুভূমিতে পরিণত হচ্ছে। নাইলে আমি বলি মহেশখালী কী দোষ করলো? যদি কোন রাজনৈতিক ন্যায়বিচার থাকতো, একটি দ্বীপে আপনি কেন ১৫ টা কয়লা বিদ্যুৎ কেন্দ্র করবেন? পৃথিবীর অন্যান্য দেশে জার্মানিতে বলেন, অস্ট্রেলীয়া তে বলেন আমরা সকলে দেখে আসছি যেখানে একটি কয়লা ভিত্তিক তাপ বিদ্যুৎ কেন্দ্র হয় তার ৫০ মাইলে ব্যাসার্ধের মধ্যে কোন মানুষ থাকতে পারেনা। তাদের ক্যান্সার হয়! মহেশখালীতে কোন রাজনৈতিক শৃঙ্খলা নাই বলেই এইটা সম্ভব হচ্ছে। হয়তো কেউ প্রতিবাদ করেনা!

আমি প্রতিবাদ করে পত্রিকায় লিখেছি, আমি তো গরীব মানুষ বেশি পত্রিকায় লিখতে পারবোনা, দেশরূপান্তরে লিখেছিলাম, বলেছিলাম যে অভিযোগ করছিলাম অধ্যাপক আনম মোহাম্মদ এর বিরুদ্ধে, “আপনারা সুন্দর বনের ১০ মাইলের মধ্যে তাপ বিদ্যুৎ কেন্দ্রের এতো প্রতিবাদ করছেন, মহেশখালীতে পনেরোটা হচ্ছো কোন কিছু বলছেন না কেনো?”

আমি এখন ধন্যবাদ জানায় তাদের কে সোলতানা কামাল এবং অন্যান্যরা গিয়া সংবাদ সম্মেলন করে বলেছে, “এটা তো শুধু অমানবিক নয়, বৈষম্যনূলকও বটে!” পার্বত্য চট্টগ্রামে যে কাজটা সরকার করেছিলো ১৯৬০ এর দশকে কাপ্তাই বিদ্যুৎ কেন্দ্র সেখানে কী হয়েছে? অন্যদিকে মহেশখালীতে মাত্র ৪ লক্ষ লোক থাকে, ছোট্ট এলাকা। আপনি এটা ধ্বংস করে দিচ্ছেন।! কিন্তু কোন প্রতিবাদ করার মানুষ কি পৃথিবীতে নাই?

আমি না করতে পারছি প্রতিবাদ, না থাকতে পারছি চুপ। আপনার এখানে হয়তো বলছি হয়তো আমি ভুল করছি। আমি বিষণ্ণ না হয়ে কোথায় যাবো? আপনি বলুন! এটা কোন ন্যায়বিচারে বলে, সুন্দর বনের ১০ মাইলের মধ্যে হলে সুন্দর বনের ক্ষতি হবে, মহেশখালী কি বাংলাদেশের অংশ নয়?

আবার তাও কী সেখানে প্রাকৃতিক গ্যাসের বদলানোর জন্য কেন্দ্র করছে পাহাড় কেটে। অর্থাৎ একটা জায়গা কে এভাবে বিরানভূমিতে পরিণত করার জন্য মহোৎসব, সেখানে আমি একটু বিষণ্ণও হতে পারবোনা? আচ্ছা ভাগ্যিস মহেশখালীর মানুষরা বুঝতেছেনা, সেখানে তারা জমির ক্ষতিপূরণ পাচ্ছে। আজকে বাংলাদেশে জনসংখ্যা হিসেবে সাক্ষরতা কতো? ধরেন ৭৩%। কিন্তু মহেশখালী তে বর্তমান সরকারের হিসেবে সাক্ষরতার হার মাত্র ৩০! তাইলে বুঝতে পারেন কত পশ্চাৎপদ এলাকা! সেই এলাকা বলেই কি আপনি সেখানে এ ধরনের কাজ করবেন! এটা কী ন্যায়বিচার?

এখন সরকার প্রধান বলছেন, “যারা উন্নয়ন প্রকল্প কে বিরোধিতা করবেন, আমরা তাদের দেখে নেবো!” যেখানে সরকার প্রধান দেখে নেয়, কোন কথা বলার অধিকার থাকেনা, সেখানে আমি বিষণ্ণ না হয়ে আমার উপায়টা কী? আমি তো হ্যামলেট এর কথা এমনিতে বলিনি, আমিই তো হ্যামলেট! আমি আমার দেশকে ভালোবাসি, আমি চাই সুস্থধারায় উন্নতি হোক। তাছাড়া সরকার এমন ভাবে বলছে যেন বিদ্যুৎ উৎপাদনের আর কোন বিকল্প নায়! কথাটা সত্যি নয়! আচ্ছা, একদিন যখন বিদ্যুৎ এর কারণে করুণ পরিনত হবে তখন কী করবেন? তখন তো আর সংশোধন করার সুযোগ থাকবেনা!

(সংকলিত)