শুমাইয়ালা জাফেরি, বিবিসি  ইসলামাবাদ:

পাকিস্তানে ছোট একটি গ্রাম আছে যেখানকার প্রায় ৯০০ শিশু এইচআইভি পজিটিভ।

এ বছরের এপ্রিলে সেখানকার একজন স্থানীয় চিকিৎসক তার ক্লিনিকে আসা শিশুদের উপসর্গ দেখে সন্দেহ করেন।

তিনি সেসব শিশুর এইচআইভি পরীক্ষা করার উপদেশ দেন।

আটদিনের মধ্যে এক হাজারের বেশি মানুষের শরীরে এইচআইভি ভাইরাসের উপস্থিতি আছে বলে জানা যায়।

শুধু পাকিস্তানেই নয়, এশিয়াতেও এত মানুষের, বিশেষ করে শিশুদের মধ্যে একসাথে এইচআইভি ভাইরাস ছড়িয়ে পড়ার নজির নেই বললেই চলে।

পাকিস্তানে যেসব শিশুর দেহে এইচআইভি ভাইরাস থাকে তাদের অধিকাংশ ক্ষেত্রেই বৈষম্যমূলক আচরণের
পাকিস্তানে যেসব শিশুর দেহে এইচআইভি ভাইরাস থাকে তাদের অধিকাংশ ক্ষেত্রেই বৈষম্যমূলক আচরণের

বিস্ময়কর সংক্রমণ

পাকিস্তানের ঘটনায় বিস্মিত হওয়ার মত বিষয়টি হলো, সেখানে এইচআইভি আক্রান্ত হওয়া শিশুদের অধিকাংশের বয়সই ১২’র কম।

তাদের পরিবারের সদস্যদের মধ্যেও এই রোগের কোনো উপস্থিতি ছিল না।

ভাইরাস ছড়িয়ে পড়ার হার সবচেয়ে বেশি ছিল যেখানে, সেই রাতোদেরোতে গিয়েছিলাম আমি।

সেখানকার একটি ছোট স্বাস্থ্যকেন্দ্রে ডাক্তার মুজাফফর ঘাঙরো সাত বছর বয়সী এক শিশুকে পরীক্ষা করছেন।

বাবার কোলে চুপচাপ বসে আছে শিশুটি। ডাক্তার তার পোশাক সরিয়ে স্টেথোস্কোপ দিয়ে তার শ্বাস-প্রশ্বাস পরীক্ষা করার সময় শিশুটিকে ধীরে ধীরে নিশ্বাস নিতে বলেন।

ঐ কক্ষের বাইরে অন্তত আরো এক ডজন রোগী নিজেদের পরীক্ষা করানোর জন্য অপেক্ষা করছেন। তাদের কারো কারো বয়স কয়েক সপ্তাহ।

শিশুদের ডাক্তার হিসেবে ঐ অঞ্চলে ডাক্তার ঘাঙরোর সুখ্যাতি ছিল, তার কাছে চিকিৎসা করানোর খরচও কম ছিল।

কিন্তু তিনি গ্রেফতার হওয়ার পর সব বদলে যায়।

ডাক্তার ঘাঙরোর সাথে বিবিসির প্রতিবেদকের কথা হয়।

কথা বলার জন্য তিনি ক্লিনিক থেকে বের হয়ে আসেন, তার একটি পা যান্ত্রিক হওয়ার কারণে কিছুটা খুঁড়িয়ে হাঁটতে হয় তাকে।

উদ্দেশ্যমূলকভাবে শিশুদের মধ্যে এইচআইভি ভাইরাস সংক্রমণ করার অভিযোগ আনা হয় তার বিরুদ্ধে। এরপর গ্রেফতার করা হয় অনিচ্ছাকৃত হত্যার দায়ে।

এ বছরের এপ্রিলে এইচআইভি সংক্রমণের বিষয়টি প্রকাশ পায়
বছরের এপ্রিলে এইচআইভি সংক্রমণের বিষয়টি প্রকাশ পায়

এমনিতে হালকা মেজাজে থাকলেও ভাইরাস সংক্রমণের বিষয়ে কথা বলা শুরু করার সাথে সাথে তার আচরণ বদলে যেতে থাকে।

“আমি কোনো অপরাধ করিনি”, দাবি করেন তিনি।

“স্বাস্থ্য বিভাগের কর্মকর্তারা ভীষণ চাপের মুখে ছিল। তাদের অযোগ্যতার দায় কারো না কারো ওপর চাপাতে হতো তাদের। বলির পাঁঠা হই আমি।”

কয়েক সপ্তাহ পরে পাকিস্তানের সরকার এবং বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার যৌথ উদ্যোগে পরিচালিত হওয়া এক তদন্তের পর ডাক্তার ঘাঙরোর বিরুদ্ধে আনা অভিযোগের গুরুত্ব কমানো হয়।

অভিযোগ করা হয় যে তার দায়িত্বে অবহেলার মাত্রা অপরাধের পর্যায়ে পড়ে।

ডাক্তার ঘাঙরো বলেন, “গত দশ বছর ধরে আমি চিকিৎসা পেশায় আছি। এখন পর্যন্ত একজনও আমার বিরুদ্ধে এমন অভিযোগ করেনি যে আমি সুঁই পুনর্ব্যবহার করেছি। আমি স্থানীয়দের মধ্যে যথেষ্ট জনপ্রিয়ও ছিলাম। তাই পেশাগত হিংসা থেকে অন্যান্য ডাক্তার এবং সাংবাদিকরা আমার বিরুদ্ধে বানোয়াট অভিযোগ এনেছে।”

নিজেও এইচআইভি আক্রান্ত থাকা ডাক্তার ঘাঙরো কিছুদিন পর জামিনে ছাড়া পান।

‘মানুষ আমাদের শিশুদের ঘৃণা করে’

ডাক্তার ঘাঙরোর ক্লিনিক থেকে কয়েক কিলোমিটার দূরে শুভানা খান গ্রামে ৩২জন শিশু এইচআইভি আক্রান্ত।

এই শিশুদের পরিবারের কোনো সদস্যরই এইচআইভি ছিল না।

কয়েকটি শিশুর মায়ের সাথে আমার কথা হয়।

তাদের অবস্থা উন্মাদপ্রায়। তাদের সন্তানরা অপুষ্টিতে ভুগছে আর ক্রমাগত কাঁদছে।

এক শিশুর মা বলেন, “আমার সন্তানের ওজন মেপে তাকে ভিটামিন দিতে বলি আমি।”

ডাক্তার ঘাঙরোর বিরুদ্ধে আনা অভিযোগ পরিবর্তিত হওয়ার ফলে অভিযোগের গুরুত্ব কিছুটা হ্রাস পায়
ডাক্তার ঘাঙরোর বিরুদ্ধে আনা অভিযোগ পরিবর্তিত হওয়ার ফলে অভিযোগের গুরুত্ব কিছুটা হ্রাস পায়

“তারা আমাকে বলে যে তারা শুধু ওষুধের সুপারিশ করতে পারবে, যা আমার নিজের টাকা দিয়ে কিনতে হবে। কিন্তু আমার এত দামি ওষুধ কেনার সামর্থ্য নেই।”

পাকিস্তানের সরকার এইচআইভি’র ওষুধ যদিও বিনামূল্যে দিচ্ছে, কিন্তু অধিকাংশ রোগীরই এইচআইভি’র প্রভাবে শরীরে অন্যান্য যেসব রোগের সংক্রমণ হয়ে থাকে সেগুলোর ওষুধের খরচ বহন করতে পারেন না।

কিন্তু আর্থিক দৈন্য নয়, রাতোদেরো’র শিশুদের অভিভাবকদের যন্ত্রণা দিচ্ছে সমাজের মানুষের মধ্যে এইচআইভি আক্রান্তদের সম্পর্কে মনোভাব।

“মানুষ আমাদের সন্তানদের ঘৃণা করে”, বলছিলেন এক শিশুর মা।

“এমনকি আমাদেরও স্পর্শ করতে চায় না, তাদের বাসায় যেতে বারণ করে।”

“তাদের ধারণা আমাদের সংস্পর্শে আসলে তারাও অসুস্থ হয়ে পড়বে। এরকম অবস্থায় কী করার আছে আমাদের?”

তিনি জানান গ্রামের স্কুলও চায় না যে তাদের শিশুরা সেখানে পড়াশোনা চালিয়ে যাক।

এইচআইভি সংক্রমণের জন্য ইঞ্জেকশনের যথেচ্ছ ব্যবহারকে দায়ী মনে করা হয়
এইচআইভি সংক্রমণের জন্য ইঞ্জেকশনের যথেচ্ছ ব্যবহারকে দায়ী মনে করা হয়

ভীতিকর পরিস্থিতি

এইচআইভি যখন ছড়িয়ে পড়ে তখন ডাক্তার ফাতিমা মীর মাঠপর্যায়ে কাজ করছিলেন।

“শিশুদের মধ্যে এইচআইভি সংক্রমণের খবর ছড়িয়ে পড়লে সাধারণ মানুষের মধ্যে একটা আতঙ্কের পরিস্থিতি তৈরি হয়। তারা ধারণা করে নেয় যে ঐ শিশুরা কয়েকদিনের মধ্যে মারা যাবে”, বলেন ডাক্তার মীর।

জাতিসংঘের ২০১৯ সালের জুলাইয়ে প্রকাশিত রিপোর্ট অনুযায়ী বিশ্বে এইচআইভি’র ব্যাপক প্রাদুর্ভাব থাকা ১১টি দেশের একটি পাকিস্তান।

কিন্তু সেখানে যে পরিমাণ মানুষের এইচআইভি রয়েছে তাদের অর্ধেকের বেশি সংখ্যক মানুষ জানেই না যে তাদের এইচআইভি আছে।

জাতিসংঘের তথ্য অনুযায়ী, ২০১০ সালের তুলনায় পাকিস্তানে বর্তমানে এইচআইভি আক্রান্তের সংখ্যা প্রায় দ্বিগুণ বেড়েছে।

এশিয়ার মধ্যে ফিলিপিন্সের পরে পাকিস্তানেই দ্রুততম হারে এইডস ছড়িয়ে পড়ছে বলে জানান পাকিস্তানে ইউএন এইডস’এর পরিচালক এলেনা বরোমেয়ো।

রাতাদেরো এলাকার মানুষ এইডসকে ঘিরে বিদ্যমান সামাজিক ভীতি কাটিয়ে উঠতে পারবে বলে বিশ্বাস ডাক্তার মীরের
রাতাদেরো এলাকার মানুষ এইডসকে ঘিরে বিদ্যমান সামাজিক ভীতি কাটিয়ে উঠতে পারবে বলে বিশ্বাস ডাক্তার মীরের

গুরুত্ব দিচ্ছে সরকারও

এইডসের এরকম প্রাদুর্ভাব থাকা স্বত্ত্বেও এটি পাকিস্তানের সরকারের অগ্রাধিকারের তালিকায় নেই।

এ থেকেই বোঝা যায়, এই ইস্যুটি অনেক পেছনে পড়ে গেছে।

তবে সাম্প্রতিক সময়ে সংক্রমণের ঘটনায় সরকারও নড়েচড়ে বসেছে বলে জানিয়েছেন দেশটির স্বাস্থ্যমন্ত্রী আযরা পেচুহো।

আনুমানিক ৬ লাখ অযোগ্য ডাক্তার বেআইনিভাবে পাকিস্তানে চিকিতসা কাজ চালায় বলে মনে করা হয়।

“পাকিস্তানের অনেক হাসপাতালেই চিকিৎসা পদ্ধতি নৈতিকতার নিয়ম মেনে পরিচালিত হয় না। ডাক্তাররা অনেকসময়ই তাদের রোগীদের বিষয়ে চিন্তা করে না। তারা সামান্য কারণেই ইঞ্জেকশন দেয়। আর আপনি যত বেশি ইঞ্জেকশন দেবেন তত বেশি সম্ভাবনা থাকবে সংক্রমণ ছড়ানোর।”

অগাস্টে প্রধানমন্ত্রীর স্বাস্থ্য বিষয়ক বিশেষ সহকারী জাফর মির্জা এক টুইটে উল্লেখ করেন যে বিশ্বের মধ্যে মাথাপিছু সবচেয়ে বেশি ইঞ্জেকশন ব্যবহারের দিক থেকে শীর্ষে পাকিস্তান।

আর এসব ইঞ্জেকশনের ৯৫ শতাংশই অপ্রয়োজনীয়।

ঘাটতি সচেতনতায়ও

এইচআইভি’র ঝুঁকিতে রয়েছে, এমন মানুষের মধ্যে সচেতনতা তৈরি করতে পাকিস্তানের সরকারের পাশাপাশি বেসরকারি সংস্থাগুলোও প্রচারণা চালাচ্ছে।

কিন্তু পাকিস্তানে যেহেতু বিবাহ বহির্ভূত যৌন সম্পর্ক এবং সমকামিতা আইনগতভাবে নিষিদ্ধ, তাই এই বেসরকারি সংস্থাগুলোর প্রচারণা বেশ রাখঢাক করে করতে হয় এবং অধিকাংশ মানুষের কাছে তাদের বার্তা পৌঁছানোই হয়ে ওঠে না।

আর পাকিস্তানের সমাজে এই রোগ হলে সামাজিক মর্যাদাহানির আশঙ্কা থাকে বলে এইচআইভি’র ঝুঁকির মধ্যে থাকা জনগোষ্ঠীও নিজেদের অনিরাপদ মনে করে।