মুহাম্মদ আবু সিদ্দিক ওসমানী :

মোঃ কামাল হোসেন। বিসিএস (প্রশাসন) ২০ তম ব্যাচের একজন কর্মকর্তা। কক্সবাজারের জেলা প্রশাসক হিসাবে ২০১৮ সালের ৪ মার্চ যোগদান করেন। কক্সবাজারের জেলা প্রশাসক হিসাবে পদায়ন হয়ে আসার পর থেকেই বিশেষ চাহিদা সম্পন্ন শিশুদের অর্থাৎ অথিষ্টিক, প্রতিবন্ধীদের জন্য কিছু একটা করা যায় কিনা। সে চিন্তা থেকেই কক্সবাজার শহরের শহীদ স্মরণীর (নিউ সার্কিট হাউস রোড) হিলটপ ও হিলডাউন সার্কিট হাউসের মাঝে খালি জমিতে সাহসের সাথে একটি স্কুলের নির্মাণকাজ শুরু করেন। অনেক প্রতিবন্ধকতা। কিন্তু থেমে থাকেননি জেলা প্রশাসক মোঃ কামাল হোসেন। দৃঢ় আত্ম প্রত্যয়ে এগোতে থাকেন। অদম্য গতিতে এগিয়ে চলা যেন কেউ থামাতে পারবেনা। আলাদিনের যাদুর চেরাগের মতোই উঠতে থাকে দালান। অর্ধনির্মিত থাকাবস্থায় ২০১৮ সালের ৭ নভেম্বর শুরু করে দেন স্কুলের কার্যক্রম। অনেক চিন্তা ভাবনা করে স্কুলের নামকরণ করা হয় “অরুণোদয়”। ভর্তি প্রক্রিয়া শুরু করা হয়। ২২১ জন বিশেষ চাহিদা সম্পন্ন অথিষ্টিক, প্রতিবন্ধী শিশুদের ভর্তির জন্য আবেদন আসে। পুরোদমে শুরু হয় অরুণোদয় এর সার্বিক কার্যক্রম। নিয়োগ দেওয়া হয় ২২ জন শিক্ষক, চিকিৎসক, নার্স, সহকারী ও অন্যান্য স্টাফ। এই অরুণোদয় স্কুলে ভর্তি হওয়া শিশুদের পড়ালেখা, চিকিৎসা, বিনোদন ইত্যাদি নিয়মিত দেখতে যান জেলা প্রশাসক মোঃ কামাল হোসেন। প্রতিদিন একবার, না পারলে ২/৩ দিন পর একবার গিয়ে দেখে আসেন, মাঝেমধ্যে সময় পেলে দিনে ২ বারও যান। বিভিন্ন দিক নির্দেশনা দেন শিক্ষক ও স্টাফদের। বসে পড়েন, শিশুদের সাথে আড্ডায়। মেতে উঠেন শিশুদের সাথে বিনোদনে। শরীরবৃত্তীয় ও বুদ্ধিবৃত্তিক বিষয় নিয়ে আলোচনা করেন খোলামেলা। জেলা প্রশাসক মোঃ কামাল হোসেন গেলেই শিশুরা যেন জোয়ারের পানিতে ভেসে এসে মাছ ডাঙ্গায় আটকে গিয়ে, আবার যেন পানির সন্ধান পেয়েছে, জেলা প্রশাসক মোঃ কামাল হোসেন গেলেই সেভাবে দৌড়ে আসেন শিশুরা। দীর্ঘদিন মাতাপিতা থেকে বিচ্ছিন্ন থেকে হঠাৎ যেন, মাতাপিতার দেখা। এভাবেই তাঁর কাছে ছুটে আসেন অরুণোদয় এর শিক্ষার্থীরা পাগলের মতো। সেভাবে গত এক বছরে আদর যত্ন, সোহাগে গড়ে তুলছেন তাদের। জেলা প্রশাসক মোঃ কামাল হোসেন নিয়মিত জানতে চান তাদের অভিবাবকদের কাছ থেকে বিভিন্ন সমস্যার কথা। পরামর্শ নেন তাঁদের কাছ থেকে। কোন মন্ত্রী, উর্ধ্বতন কর্মকর্তা কক্সবাজারে আসলেই তিনি নিয়ে যান, অরুণোদয় স্কুল পরিদর্শনে। তাদের কাছে তুলে ধরেন এই অরুণোদয় স্কুলের অপরিহার্যতা ও মানবিক দৃষ্টিভঙ্গির কথা। তাদের কাছে অনেকটা ছোট হয়েই অরুণোদয় স্কুলকে সহযোগিতার কথা বলেন বার বার।

এমনিভাবে গত ১১ নভেম্বর থেকে ২২ নভেম্বর পর্যন্ত রাষ্ট্রীয় কাজে বিশ্বের ৩ টি দেশ সফরে গিয়েছিলেন, জেলা প্রশাসক মোঃ কামাল হোসেন। কক্সবাজারে আসেন ২৪ নভেম্বর সন্ধ্যায়। দীর্ঘ ১৪ দিনের না দেখার পিপাসা নিয়ে গত ২৫ নভেম্বর রোববার সকালে দেখতে যান ঔরসজাত সন্তান সমতুল্য অরুণোদয় স্কুলের শিক্ষার্থীদের। প্রতিদিনের মতো সেখানে গিয়ে শিক্ষার্থীদের সাথে মেতে উঠেন কোলাহলে। হারিয়ে যান তাদের মাঝে। শিক্ষার্থীদের এই প্রিয় অভিবাবককে দীর্ঘ ১৪ দিন যাবৎ স্বচক্ষে না দেখার যন্ত্রণা যেন আর সইতে না পেরে শিক্ষার্থীরা একের পর এক কুশল বিনিময় করছেন, তাদের বন্ধুর মতো প্রিয় অভিভাবক, জেলা প্রশাসক মোঃ কামাল হোসেনের সাথে। এক পর্যায়ে অরুণোদয় স্কুলের শারীরিক প্রতিবন্ধী ৬ বছরের আবদুল আল আমিন এগিয়ে আসে সুপ্রিয় অভিবাবককে একটি গান শোনানোর প্রচন্ড আগ্রহ নিয়ে। তাদের অভিবাবক ও জেলা প্রশাসক মোঃ কামাল হোসেনও রাজি হয়ে যান, গান শোনতে। কক্সবাজার পৌরসভার ১২ নম্বর ওয়ার্ডের লাইট হাউজ এলাকার আবদুল গফুরের পুত্র আবদুল আল আমিন নির্ভয়ে স্বাচ্ছন্দ্যে জেলা প্রশাসক মোঃ কামাল হোসেনের বুকের কাছে দাঁড়িয়ে শুরু করে দেন গান। জেলা প্রশাসক মোঃ কামাল হোসেনও দারুণ উপভোগ করেন গানটি। সন্তান একটি গান গাওয়ার বায়না ধরেছে। সে গান বিশ্রী আর মধুময় কিনা, সেটা বড় কথা নয়। সন্তান গান গাইছে, আর হৃদয় ছূঁয়ে যাচ্ছে, এটাই আসল কথা। আর আবদুল আল আমিনের গাওয়া গানটি হলো-একসময়ের কক্সবাজার সমুদ্র পাড়ের ক্ষুদে শিল্পী মোহাম্মদ জাহিদ এর চট্টগ্রামের আঞ্চলিক ভাষায় গাওয়া, বহুল জনপ্রিয় “মধু হই হই বিষ খাওইলা, হন হারণে ভালবাসার দাম নদিলা” আবদুল আল আমিনের চমৎকার গায়কীর সাথে মেতে উঠেন, জেলা প্রশাসক মোঃ কামাল হোসেন, সকল শিক্ষার্থী সহ উপস্থিত সকলে। গানের সুরে সুরে সবার হাততালি যেন ব্যান্ডের ঝাঁজালো সুরকেও হার মানায়। গানের সুরে সুরে খুশীতে সবাই একাকার। জেলা প্রশাসক মোঃ কামাল হোসেন নিজের অজান্তে মিশে যান আবদুল আল আমিনের সুমধুর কন্ঠের সাথে। গুন গুন করে তিনি নিজেও আবদুল আল আমিনের গানের সাথে গাইতে থাকেন। এই গানটি ভিডিও করা হয়েছিলো কারো একজনের মোবাইল ফোনে। সেখান থেকে জেলা প্রশাসক মোঃ কামাল হোসেন সেটি সংগ্রহ করে কক্সবাজার জেলা প্রশাসনের নিজস্ব ফেসবুক পেইজে আপলোড করেছেন ২ দিন পর বুধবার ২৭ নভেম্বর সন্ধ্যায়। গানটির ভিডিও ফুটেজের সাথে জেলা প্রশাসক মোঃ কামাল হোসেন এক আবেগঘন স্ট্যাটাস দিয়েছেন। স্ট্যাটাসটি ৩ ঘন্টায় ৩ সহস্রাধিক লাইক, ৩ শতাধিক শেয়ার ও প্রায় একই পরিমান কমেন্ট এসেছে।

স্ট্যাটাসে জেলা প্রশাসক মোঃ কামাল হোসেন বলেছেন-কক্সবাজার ছেড়ে যাওয়ার সময় কোন কিছুর জন্য কষ্ট অনুভব হবে না, তবে তোদের জন্য। যতদিন বেঁচে থাকবো, ততদিন তোদের ছায়া হয়ে থাকবো। হ্যাঁ গানের কথায় বলা যায়, “কথা বলো, আর না বলো, ওগো বন্ধু, ছায়া হয়ে হয়ে তবু পাশে রইবো।” কক্সবাজারে জেলা প্রশাসক মোঃ কামাল হোসেন কক্সবাজারে থাকেন কিংবা না থাকেন ছায়া হয়ে অবশ্যই তিনি সারাজীবন অরুণোদয় স্কুলের শিক্ষার্থী বন্ধুদের পাশে থাকবেন এ প্রত্যয় ব্যক্ত করেছেন, তাঁর দেওয়া ফেসবুক স্ট্যাটাসে। নিম্নে জেলা প্রশাসক মোঃ কামাল হোসেনের স্ট্যাটাসটি হুবহু তুলে ধরা হলো :

“আবদুল আল আমিন। আমার অরুণোদয়ের প্রতিবন্ধী ছাত্র। কক্সবাজার ছেড়ে যাবার সময় অন্য কোন কিছুর জন্যই কষ্ট অনুভব হবেনা, হবে তোদের জন্য। তোদের পাশে ছায়া হয়েই থাকব যতদিন বেঁচে থাকি।”

স্ট্যাটাস সম্পর্কে জানতে চাইলে কক্সবাজারের জেলা প্রশাসক মোঃ কামাল হোসেন সিবিএন-কে বলেন, আসলে অরুণোদয় স্কুলের শিক্ষার্থীদের সাথে এত বেশী মিশে গেছি, তাদের কাছে পেলেই শত ব্যস্ততার ক্লান্তি, অবসাদ দূর হয়ে যায়। অরুণোদয় স্কুলের শিক্ষার্থীরা যেন আমার প্রাণের স্পন্দন। সমস্ত ক্লান্তি, দুঃচিন্তা, টেনশন মুক্ত হওয়ার তারা যেন এক অবর্ননীয় পরশ। তাই, যেখানে থাকি তাদেরকে নিয়ে চিন্তা করি, তাদের কিভাবে মানুষের মতো মানুষ করা যায়। অন্য সবার সাথে পাল্লা দিয়ে মাথা উঁচু করে যাতে দাঁড়াতে পারে, এ চিন্তায় সব সময় মাথায় থাকে। এ সময়ও তিনি অরুণোদয় স্কুলটি আরো সুপ্রতিষ্ঠিত ও সমৃদ্ধ করতে সবার আন্তরিক সহযোগিতা কামনা করেন।