আবুল কালাম, চট্টগ্রাম:
চট্টগ্রাম মহা নগরীতে এক জন নারী ভিক্ষুকের ৬ মাস বয়সী শিশুপুত্র অপহরণ করে অপহরণ চক্রের সদস্যরা। দীর্ঘ ৬ মাস পর শিশুটিকে উদ্ধার করে চট্টগ্রাম মহানগর পুলিশ মায়ের কাছে ফিরিয়ে দিয়ে প্রসংশায় ভাসছে।

শুক্রবার (২১ নভেম্বর) চট্টগ্রামের ফটিকছড়ি উপজেলার ভুজপুর থানার কাশেম আলী টেন্ডল বাড়ির এক নিঃসন্তান গৃহবধূ তাসমিনা আক্তার জেলীর হেফাজত থেকে শিশুটিকে উদ্ধার করা হয়।

ক্যান্সারে মা মারা যাওয়ার কথা বলে পাচারকারী চক্র শিশুটিকে জেলীর কাছে দেড় লাখ টাকায় বিক্রি করে দিয়েছিল বলে জেলা পুলিশ জানায়।

শনিবার দুপুরে নগরীর দামপাড়াস্থ সিএমপি সদর দপ্তরে এক প্রেস ব্রিফিং-এ শিশু অপহরণ, উদ্ধার এবং পাচারকারী চক্রকে গ্রেপ্তারের বিষয়ে বিস্তারিত জানান নগর পুলিশের অতিরিক্ত কমিশনার আমেনা বেগম।

প্রেস ব্রিফিং-এ জানানো হয়- চলতি বছরের ১৫ মার্চ নগরীর বিকেলে চট্টগ্রাম মহানগরীর ইপিজেড থানাধীন নেভী কলোনী সংলগ্ন ফুটপাতে ৬ মাস বয়সী শিশু শুভকে কোলে নিয়ে ভিক্ষা করছিলেন শিরিন বেগম (২৫)। স্বামীহারা শিরিন বেগমের ৭ বছর বয়সি আরো এক কন্যা সন্তান রয়েছে। স্বামী সড়ক দুর্ঘটনায় মৃত্যুবরণ করায় দুই সন্তানের মুখে অন্ন তুলে দিতে ভিক্ষাবৃত্তি করেন এই শিরিন।

ঘটনার দিন ভিক্ষা করার সময় অজ্ঞাত দুই ব্যক্তি শিরিনের কাছে এসে তার অসহায়ত্ব দেখার ভান করে জুস খেতে দেন। এই জুস পান করার কিছুক্ষণের মধ্যেই শিরিণ অজ্ঞান হয়ে যান। অজ্ঞান করে ওই ব্যক্তিরাই আবার শিরিনকে নগরীর আগ্রাবাদস্থ মা ও শিশু হাসপাতালে নিয়ে ভর্তি করেন। হাসপাতালে জ্ঞান ফেরার পর শিরিন নিজেকে হাসপাতালের বেডে আবিস্কার করলেও তার ৬ মাস বয়সি শিশুপুত্রকে আর খুঁজে পান না।

হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ জানায়, শিরিনকে ভর্তি করতে আসা দুই ব্যক্তি নিজেদের শিরিনের স্বজন পরিচয় দিয়ে শিশুটিকে সাথে করে নিয়ে যান।

এই ঘটনায় শিরিন ১৮ মার্চ নগরীর ইপিজেড থানায় হাজির হয়ে তার ৬ মাস বয়সি শিশু অপহরণের এক এজাহার দায়ের করেন। মামলা দায়েরের পর থেকেই পুলিশ শিশু উদ্ধারে ব্যাপক তৎপরতা শুরু করে। মামলার তদন্তভার দেওয়া হয় বন্দর থানার এস আই কামাল হোসেনকে। একই সাথে বন্দর জোনের উপ-পুলিশ কমিশনার, অতিরিক্ত উপ-পুলিশ কমিশনার এবং বন্দর থানার ওসি মীর নুরুল হুদা সার্বক্ষণিকভাবে ভিক্ষুক শিরিনের অপহরণ হওয়া শিশু উদ্ধারে ব্যাপক তৎপরতা শুরু করেন।

পুলিশ প্রথমে চট্টগ্রাম মা ও শিশু হাসপাতালে সিসিটিভি ফুটেজ সংগ্রহ করে, তথ্যপ্রযুক্তির সহায়তার শিশুটিকে অপহরণ করে নিয়ে যাওয়া দুই ব্যক্তিকে সনাক্ত করতে সক্ষম হয় হয়। এদের একজন ইকবাল হোসেন (৩০) এবং অপরজন জাফর সাদেক প্রকাশ আফসার (৩৫)।

এদের মধ্যে গত ২৮ জুলাই চট্টগ্রাম মেডিক‌্যাল কলেজ হাসপাতাল এলাকা থেকে শিশু অপহরণকারী চক্রের সদস্য ইকবাল হোসেনকে গ্রেপ্তার করতে সক্ষম হন ইপিজেড থানার এস আই কামাল কামাল হোসেন ও তার ফোর্স।

গ্রেপ্তারের পর ইকবাল পুলিশের কাছে স্বীকার করে সে এবং তার গুরু জাফর সাদেক কৌশলে শিরিনকে ঘুমের ওষুধ মিশ্রিত জুস খাইয়ে তার ৬ মাস বয়সী শিশুটিকে অপহরণ করে। ইকবালকে গ্রেপ্তার করে ভিক্ষুকের শিশুসন্তানকে অপহরনের তথ্য পাওয়া গেলেও শিশুটি কোথায় এবং কার কাছে বিক্রি করা হয়েছিল সে ব্যাপারে ইকবালের কাছে কোন তথ্য পাচ্ছিলনা পুলিশ।

পরবর্তীতে গত ৩ নভেম্বর পুলিশ গ্রেপ্তার করতে সক্ষম হয় এই অপহরণকারী চক্রের মাস্টারমাইন্ড এবং হোতা জাফর সাদেককে। তাকে গ্রেপ্তারের পর রিমান্ডে এনে জিজ্ঞাসাবাদ করা হলে সে শিশু চুরির পর কোথায় কার কাছে রেখেছিল এবং কার মাধ্যমে কোথায় বিক্রি করেছে তার বিস্তারিত জানায় পুলিশকে।

পুলিশের জিজ্ঞাসাবাদে চক্রের হোতা জাফর সাদেক জানায়, তারা শিশুটিকে চুরি করে প্রথমে নগরীর মেহেদীবাগস্থ ন্যাশনাল হাসপাতাল ও সিগমা ল্যাবের টেকনোলজিস্ট পারভিন আক্তারের হেফাজতে রাখে। এরপর তাদের অপর সদস্য সালেহা বেগম আলেয়ার (৫২) মাধ্যমে নিঃসন্তান দম্পত্তি ক্রেতা খুঁজতে থাকে। এবং আলেয়াই শিশুটিকে ফটিকছড়ির এক দম্পত্তির কাছে বিক্রি করেছে বলে জাফর সাদেক পুলিশকে জানায়।

ঘটনা নিশ্চিত হয়ে পুলিশ গত ২১ নভেম্বর সন্ধ্যায় নগরীর পাঁচলাইশ থানার শূলকবহর এলাকা থেকে গ্রেপ্তার করা হয় সালেহা আলেয়াকে। তার দেয়া স্বীকারোক্তি মতে চট্টগ্রাম জেলার ফটিকছড়ি উপজেলার কাসেম আলী টেন্ডলের বাড়ির দুবাই প্রবাসী সাইফুল্লার স্ত্রী নিঃসন্তান তাসমিনা আক্তার জেলীর কাছ থেকে শিশুটি উদ্ধার করতে সক্ষম হয়। এর আগে শিশুটি চুরির পর যে মেডিক‌্যাল টেকনোলজিস্ট-এর বাসায় রেখেছিলো সেই পারভিন আক্তারকেও গত ৩ নভেম্বর গ্রেপ্তার করে কারাগারে পাঠায় পুলিশ।

এদিকে শিশু উদ্ধারের পর দেড় লাখ টাকায় কিনে নেয়া তাসমিনা আক্তার রাইজিংবিডিকে বলেন, ৮ বছর বিয়ে হলেও তিনি নিঃসন্তান। একটি সন্তান পালক নেওয়ার জন্য তিনি চেষ্ঠা করছিলেন। তার এক খালার মাধ্যমে আলেয়ার কাছ থেকে দেড় লাখ টাকা দিয়ে তারা শিশুটিকে কিনে নিয়েছেন।

কেনার আগে তাদের জানানো হয়েছিল ক্যান্সারে শিশুটির মা মারা গেছে। তাকে দেখাশোনার কেউ না থাকায় শিশুটির বাবা শিশুটিকে তার কাছে দত্তক দিতে চায়। এ জন্য প্রথমে আড়াই লাখ টাকা দাবি করা হয়। পরে দেড়লাখ টাকায় স্টাম্প করে শিশুটিকে তিনি কিনে নিয়েছেন। শিশুটি অপহরণ করে বিক্রি করা হয়েছে সেটি তারা জানতেন না।

কিনে নেয়ার পর গত ৬ মাস ধরে নিজ সন্তানের মতোই লালন পালন করছিলেন জেলী। পুলিশ শিশুটিকে উদ্ধারের পর আসল মায়ের কাছে ফেরত দিতে গিয়ে কান্নায় ভেঙে পড়েন জেলী। পুলিশের প্রেস ব্রিফিং- চলাকালীন কিনে নেয়া এই সন্তানটিকে কোলে নিয়ে সারাক্ষণই নিরবে চোখের পানি ফেলছিলেন জেলী।

অপরদিকে দীর্ঘ ৬ মাস পর নিজে হারিয়ে ফেলা সন্তান কোলে পেয়ে আনন্দিত ভিক্ষুক শিরিন। পুলিশের প্রতি তার কৃতজ্ঞতার শেষ নেই।

চট্টগ্রাম নগর পুলিশের অতিরিক্ত কমিশনার আমেনা বেগম জানান, দীর্ঘ ৬ মাসের নিরবিচ্ছিন্ন প্রচেষ্ঠায় অপহরণ হওয়া ৬ মাসের শিশুটিকে পুলিশ উদ্ধার করতে সক্ষম হয়েছে। এই চক্রের হোতাসহ অন্যান্যদেরও গ্রেপ্তার করা হয়েছে।

চট্টগ্রামে আর কারো সন্তান এভাবে চুরি বা অপহরণ হয়ে থাকলে পুলিশকে জানানোর জন্য অনুরোধ জানিয়ে আমেনা বেগম বলেন যদি কারো সন্তান অপহরণ বা চুরি হয়ে থাকে তবে এই চক্রের সদস্যদের আবার রিমান্ডে এনে প্রয়োজনে জিজ্ঞাসাবাদ করা হবে। তারা আর কোন শিশু অপহরণের সাথে জড়িত কি-না তা খুঁজে বের করা হবে।