শান্তারাম (৩)

প্রকাশ: ২২ নভেম্বর, ২০১৯ ১১:৪৭

পড়া যাবে: [rt_reading_time] মিনিটে


(ইংরেজী থেকে অনুবাদ)

Md Max

বইটিকে ঠিক কোন ধারার বইয়ের কাতারে ফেলা উচিত তা নিয়ে দ্বিধা-দ্বন্দ্ব আছে।

পড়ার পর আমার মনে হবে আসলেই তো, কী নেই এখানে! জীবন, দর্শন, তত্ত্ব, ধর্ম, নারী, মাদক, যুদ্ধ, অপরাধজগৎ, অন্ধকার, আলো সবকিছু নিয়েই মোটের উপর উপন্যাস হিসেবেই বাজারে প্রচলিত। অস্ট্রেলিয়ার ভিক্টোরিয়া অঙ্গরাজ্যের কোবার্গ শহরে অবস্থিত ম্যাক্সিমাম সিকিউরিটি প্রিজন ‘পেন্টরিজ’। গল্পের মূল চরিত্র একসময় ছিলেন হিরোইনে আসক্ত একজন ব্যাংক ডাকাত, তার ১৯ বছরের সশ্রম কারাদণ্ড হয়, আর তাকে রাখা হয় এই জেলখানায়। সেখান থেকে দিনে-দুপুরে দেয়াল টপকে পালিয়ে ভারতে আসেন। তারই জবানীতে পুরো উপন্যাসের যাত্রা, যেখানে প্রতিটা সংলাপে আপনি পাবেন ভিন্ন মাত্রা। ঘটনাক্রমে পরবর্তী দশ বছরে তিনি হয়ে উঠেন, অস্ট্রেলিয়ার মোস্ট ওয়ান্টেড ম্যান। Lindsay Ford নামে নকল পাসপোর্ট নিয়ে ভারতে আসলেও পরবর্তীতে বোম্বে আন্ডারওয়ার্ল্ডে তিনি লীন বা শান্তারাম নামে পরিচিত হয়ে ওঠেন।অপরাধী হিসেবে জীবনের বিভিন্ন অভিজ্ঞতায় তিনি লীন থেকে শান্তারাম কীভাবে হয়ে উঠেন সেই যাত্রার বর্ণনা উঠে আসে উপন্যাসে। জীবনের ঘাত-প্রতিঘাতে তার মানবিক পরিবর্তন ঘটে, সাথে ঘটে আত্মিক উন্নতি। যাদের সংস্পর্শে এ সকল পরিবর্তন ঘটে এই উপন্যাসে, কিংবা বোম্বে আন্ডারওয়ার্ল্ডে, কোনোটিতেই তাদের ভূমিকা কম নয়। তবে তার আগে বোম্বে’র বস্তিতে বসবাসরত সাদা চামড়ার মানুষ লীন কীভাবে বস্তির মানুষের সাথে মিশে যায়, মারাঠি ভাষা শিখে, এসবের দৈনন্দিন নিটোল বিবরণ শুনতে শুনতেই গল্প জমে যাবে।

এই উপন্যাসের৩ টি পার্ট আমি প্রথমবারের মত সিবিএন পাঠকদের জন্যে বাংলা অনুবাদ করেছি।

যেহেতু বইটি প্রায় ৯৩০ পৃষ্ঠার তাই আমি খুব আলোচিত ২ টি অংশের সাথে এ-র শুরু টি আর জেল থেকে পালানোর পর্বটি অনুবাদ করেছি।

পর্ব ২১
তত্বাবধায়াকরা ঠিক ফজরের একটু পরে ঘুম থেকে উঠে যাই আর যে অভাগাদের ঘুম তখনও পুর্ন হয়নি তাদের মেরে মেরে তুলে দেয়৷
\আমি প্রায় উঠে গিয়েছিলাম, ঠিক তখনই আমাকে লাঠির বারি দেওয়া হল, আমি তাকে ধরতে যেতেই মাহেস আমাকে আবারও বাধা দিল। আমরা কম্বলগুলো নিয়ে ভাঁজ করে রাখলাম। রক্ষীরা গেইট খুলে দিল আর আমরা সবাই ফ্রেশ হওয়ার জন্যে জড়ো হলাম, গোসলখানা পাথরের তৈরি একটা পুকুরের মত, আইরন ট্যাংকে পানি, একজন আসামি ট্যাংক খুলে দিল আর পাইপ দিয়ে সবাই পানির খোজে, আর এলুমিনিয়ামের প্লেটে নিয়ে নাওয়া সারছে। শত শত আসামি এক ফোটা পানি পাওয়ার লক্ষে লড়াই করছে। একজনের সাথে অপরজন ধাক্কা খাচ্ছে। পানির পাইপ কার আগে কে পায়। আমি সবার শেষ হওয়া পর্যন্ত অপেক্ষা করলাম, পানি আর একটু বাকী আছে। একটা সাবানের ছোট অংশ প্রায় ২০ জনের মত ব্যাবহার করেই দৌড় দিচ্ছে পাইপ নিতে। আমি যখন পাইপ নিতে গেলাম ততক্ষণে পানি শেষ। যা সামান্য পানি আমি নিতে পেরেছিলাম তা পোকামাকড়ের বসতির মত কি যেন কিলিবিলি করছে। আমি রাগে প্লেট ছুড়ে মারলাম এতে অনেকেই হেসে উঠলেন। পানির কৃমি দোস্ত, মাহেস বলে উঠল, তার প্লেট পরিস্কার করতে করতে, এসব ট্যাংকে থাকে, যখনই পানি একদম শেষ হয়ে যায় তখনই প্লেটে উঠে আসে। কিন্তু সমস্যা নেই, তারা কাদমলের মত কামড়ায় না। তারা ঠান্ডা পানিতে মারা যায়।
পানির ট্যাপে কিছু থাকে, তবে তুমি অপেক্ষা করলে এরা যেমন বের হবে তেমনি পানিও বের হবে, তারপরও ভালো, চল বন্ধু, গোসল সেরে নিই, কালকে সকালের আগ পর্যন্ত আর পানি পাওয়া যাবে না, তাই এভাবেই করতে হবে। কারন আমরা ডরমিটরিতে গোসল করতে পারবনা, সেটি শুধুমাত্র তত্বাবধায়াকদের । গতরাতে তারা তোমাকে সেখানে তা ব্যাবহার করতে দিয়েছিল কেননা তুমি রক্তাক্ত ছিলে বলে।
তুমি সেখানে আর যেওনা, আমরা টয়লেট ব্যাবহার করতে পারব কিন্তু শাওয়ার নয়, এটিই আমাদের একমাত্র গোসলের ব্যাবস্থা ভাই।
আমি শেষ হয়ে আসা পানি আমার প্লেটে নিলাম, পোকা সরালাম যেমনটি মাহেস করছে।আমার পরনে অন্যান্য ভারতীয়দের মত আন্ডার প্যান্ট ছিল, প্রভাকর যেটি কে গ্রামে বলত। যখনই তত্বাবধায়াকরা আমাদের ডরমিটরিতে ফিরে যাওয়ার তাগিদ দিচ্ছিল মেরে মেরে, ততক্ষণে আমি সাবান ছাড়া যতটুকু সম্ভব নাওয়া সারলাম। ডরমিটরিতে আমরা প্রায় ১ ঘন্টা অপেক্ষা করলাম আমাদের মাথা গোনা হচ্ছে তাই, যেহেতু আমরা দীর্ঘক্ষন বসা তাই আমদের প্রচন্ড ব্যাথা লাগছিল, যখন কেউ একটু পা বাড়াতে যায় পেট্রোলে থাকা তত্বাবধায়াকদের একজন তাকে সজোরে আঘাত করে। কিন্তু আমি পা বাড়াইনি, আমি চাইনি তারা আমাকে মেরে মজা নিক, তারপরেও কোন কারন ছাড়া একজন আমাকে যখন মারল আমি দাড়াইতেই মাহেস আমাকে আটকে দিল। যখন তারা আমকে ১৫ মিনিটের মধ্যে ৪ থেকে ৫ বার আমার কানে আঘাত করল, আমি দাড়িয়ে তাদের একহাত নিলাম। ‘ এদিকে আয় কুত্তার বাচ্চা’, আমি চিতকার করে বললাম, তাদের একজনকে। এই তত্বাবধায়াককে শত্রু আর বন্ধু সবাই গামা রাহুল হিসবে চিনে, সে সবার চেয়ে বড় আর দেখতে বিশাল।
‘ আমি তোর লাঠিটা নিয়ে তোর পাছায় দিব, তুই নিজেই দেখবি ‘। পুরু রুমে নীরবতা, প্রত্যেকটি শব্দ সবাই গিলে খাচ্ছে। গামা রাহুল আমার দিকে তাকিয়ে থাকল, আর তার বিস্ময় ঘনীভূত হয়ে আসছে, আস্তে আস্তে অন্যান্য তত্বাবধায়াকরা তার পাশে এসে দাড়াচ্ছে। আমি হিন্দিতে বললাম, আয়, আমি প্রস্তুত, পারলে আয়। মাহেস সহ কয়েকজন আমাকে জোর করে বসিয়ে দিল।
‘ প্লিজ লিন, প্লিজ আমার ভাই, আমি জানি তোমাকে আমি কি বলছি’।
সেখানে একটি মুহুর্ত ছিল যখন গামা রাহুল আর আমি একে অপরের দিকে তাকালাম, আমরা দুজনেই হিংস্রতা কি তা জানি।
তার উন্নাসিকতার পতন হল আর তার চোখে পরাজয়ের চাপ। সেটা আমিও জানি সেও জানে।
সে আমাকে ভয় পেয়েছিল, আমি ইচ্ছে করে সবাইকে সুযোগ দিয়েছিলাম আমাকে সরিয়ে নিতে।
সে রাগে সরে গিয়ে পাশে যে ছিল তাকে মারল, রুম শান্ত হল আর মাথা গোনা শুরু হল। সকালের নাস্তায় আমাদের শুধু একটি বড় চাপাতি দিল, ৫ মিনিট যে সময় বরাদ্দ ছিল তা আমরা পানি দিয়ে সারলাম, এরপর তারা আমাদের রুম থেকে বের করে দিল।
আমরা কয়েকটি বড় উঠোনের সামনে আসলাম, তত্বাবধায়াকরা আমাদের চুল নেড়া করতে বাধ্য করল, একটা গাছের নীচে নাপিতের দরবার, প্রত্যেক নতুন আসামিকে একটা রেজর দিয়ে চুল ন্যাড়া করে দেওয়া হয়। আমরা যখন অপেক্ষা করছিলাম তখন এক কোলাহল আর আওয়াজ শুনতে পেলাম, নাপিতদের উঠোনে, মাহেস আমাকে দেখার জন্যে তাড়া দিল।
কাটাতারের ওপাশে প্রায় ১০ জন তত্বাবধায়াক এক লোককে টেনে আনছে। মানুষটির কব্জি আর কোমরে রশি বাধা।গলায় ও রশি পেছানো। সবাই রশি ধরে হেচকা টান দিচ্ছে। লোকটা খুবই লম্বা আর শক্তিশালী, তার গলাটাও মোটা, যেমনটি কামানের মত। তিনি ছিলেন একজন আফ্রিকান। আমি তাকে দেখতেই চিনে ফেললাম। হাসান ওবাইকের ড্রাইভার রাহিম। যাকে আমি কিছুদিন আগে গড়নপিটন থেকে, নিয়ার সার্কেলে রক্ষা করেছিলাম। আমি শ্বাসরুদ্ধকর নীরবতার মাঝে চেয়ে থাকলাম। তারা রাহিমকে একটি পাথরের কম্পাউন্ডে শুয়ে রাখল, সে যুদ্ধ করতে লাগল বাধা দিতে, কোন কাজই হলনা, আরও কয়েকজন তত্বাবধায়াক রশি নিয়ে আসল।
রহিমের পা আর তার নিয়ন্ত্রণে নেই, তিন জন তত্বাবধায়াক তাদের পুর্ণ শক্তি দিয়ে কব্জির রশি টানছিল, তার হাত তারা এত জোরে টানছিল, মনে হচ্ছে তা সকেট থেকে ছিড়ে যাচ্ছে। তার পাগুলো কে এমনভাবে রাখা হয়েছে তা খুবই অপ্রাকৃতিক।অন্যান্যরা তার গলার রশি টেনে সামনের দিকে নিয়ে আসছে। তারপর তারা হাত টেনে মোজাইকে রাখল, রাহিম ব্লকে কাত হয়ে আছে।একজন তত্বাবধায়াক রাহিমের বাহুতে প্রচন্ডভাবে লাফ দিল, মনে হল হাড় ভেঙ্গে গেল। সে চিতকার করতে পারছিলোনা, কারন তার কলার রশি দিয়ে টাইট করে লাগানো, তার পক্ষ থেকে যেন আমরাই চিতকার করছিলাম, যদিও তার মুখ খোলা ছিল।
তার পা বিষমভাবে নড়তে শুরু করল যেন অংঘহানি হচ্ছে। তার পুরু শরীরে ভীষণ ঝাকুনি হচ্ছে, মাথা খুব জোরে নড়ে উঠছে। তত্বাবধায়াকরা তাকে টেনে ব্লকে নিয়ে আসল, একজন মোজাইকে উপর উঠল, কথা বলছে অপরজনের সাথে, তারপর সজোরে আঘাত করল তার নাকে, ডান বাহুতে লাফ দিল, হাত উল্টো টান দিল, আর রাহিম জ্ঞান হারাল। তত্বাবধায়াকরা রশি দিয়ে টেনে তাকে কম্পাউন্ড থেকে নামাল। তার শরীরের পেছনে তার হাত অবশ হয়ে গেল, তার অংঘ প্রতংগ জীবনহীন হয়ে পরে রইল, যেমনটি বালুভর্তি কালো মোজার মত৷
‘ দেখেছ, মাহেস বলল আমাকে। এসব কেন? সে একজন তত্বাবধায়াক কে মেরেছিল তাই।
তাই তোমাকে নিষেধ করি আমি। তারা কি করতে পারে দেখ।
পাশে আরেকজন এসে বলল, আর ডাক্তারের কোন নিশ্চয়তা নেই, পেতেও পারে বা নাও পেতে পারে , ঐ কালো লোকটা বাঁচতে ও পারে বা মারা যাবে। তত্বাবধায়াকদের সাথে লাগতে যেওনা বাবা । বড় রাহুল আমাদের দিকে লাঠি হাতে আসতে থাকল, আমার পাশে দাড়িয়ে হালকা করে আমার পিঠে মারল, সে সবার সামনে দিয়ে জোরে হেসে গেলে কি হবে তা ছিল তার দুর্বলতা, তা আমাকে বোকা বানাতে পারেনি। আমি এই হাসির অর্থ বুঝি, কারন আমি অন্য জেলেও তা দেখেছি। হিংস্রতা একধরনের কাপুরুষত্ব, এই নিষ্টুর হাসি একমাত্র ভীরুরাই দেয় যখন তারা একা থাকেনা, তারা এভাবে তাদের দুখ লাঘব করে। বসে থাকতেই আমি একটি ব্যাপার লক্ষ্য করলাম, তা হল ছোট একটা উকুন আমার সামনের মানুষটির চুলে,আমি ঘুম থেকে উঠার পরেই চুল্কানি অনুভব করছিলাম। এটি বাজে কম্বলে ঘুমানোর কারনে জন্মেছে আর আমার ক্ষতবিক্ষত শরীরে ও অনেক জায়গায় ঢুকে গিয়েছে, অনেকের মাথায় উকুন দেখতে পেলাম। মাহেসের চুলে সব উকুন, যখন চুল ঝাকুনি দিলাম সব দেখলাম সাদা উকুনের হামাগুড়ি।
পরে দেখলাম তা আমাদের পুরু শরীরে ভরে গিয়েছে। আমাদের চুল যখন কেটে ফেলা হল পরে মাহেস জানাল আমাদের শরীরের গুলো সব সেপ্পেস হিসেবে পরিচিত। সেপ্পেস গুলো ভয়ংকর ভাই, সব জায়গায় তাদের ছড়াছড়ি, তাই তত্বাবধায়াকরা নিজেরদের কম্বলে ঘুমায় আর আলাদা রাখে। এদিকে আস তোমাকে দেখায় তুমি কি করবে। সে তার জামা খুলে ফেলল, তা ঝাঁকিয়ে নিল, তারপর জামা থেকে তা আস্তে আস্তে সরাল, বিশেষ করে জামার সেলাই থেকে সব সরাল। তারা দেখা না গেলেও বুঝা যায়, কিন্তু তাদের সহজেই মেরে ফেলা যায়, তুমি শুধুমাত্র তোমার বৃদ্বা অংগলি দিয়ে তা মেরে ফেলবে এই ভাবে। আমি সে কিভাবে একটার পর একটা উকুন মারছে তা দেখলাম। সে জামার সেলাই থেকে আগা পর্যন্ত সব মেরে ফেলল, শত শত ছিল সংখ্যায়, সে তা খুব দক্ষতার সাথে খতম করল। এখন দেখ জামা একদম পরিস্কার, সে তা ফ্লোরে রেখে দিল, আর সেপ্পিস নেই, তাপর রুমে একটি তাওয়াল নিবে প্যান্ট খুলে সেখান থেকে সব ঝেড়ে ফেলবে৷তারপর জামা কাপড় পরবে৷ তোমার সব হাত, পা, ভেতরে পরিস্কার করে পরে জামা গায়ে দিবে। সারাদিন ভালো থাকবে, রাত আসলে আবার কম্বল থেকে নতুন সেপ্পিস জন্ম নিবে, তুমি কম্বল ছাড়া ঘুমাতে পারবেনা, কেননা তত্বাবধায়াকরা এসে মার দিবে যদি তা কর, তোমাকে তা নিতেই হবে, পরের দিন আবারও একই কাজ করবে, এটিকে আমরা সেপ্পিস চাষ বলি, আর আমরা সবাই এখানে আরথার রোড জেলে একজন কৃষক। আমি বৃষ্টিভেজা দিনের ডরমিটরির বাইরে থাকালাম, দেখলাম সবাই এই কাজে ব্যাস্ত, কেউ তা আবার তা পাত্তাই দিচ্ছেনা, তারা কুকুরের মত সহ্য করে যাচ্ছে আর তাদের শরীর এই সব পোকাদের খেতে দিচ্ছে৷

আমার চামড়ার জন্যে তা খুবই ক্ষতিকর ছিল, আমি জামার সেলাইয়ে তা লক্ষ করলাম, তা পুরো জামায় ভরে গিয়েছে। আমি একটার পর একটা মারতে লাগলাম, এটি প্রায় কয়েকঘন্টার কাজ, আমি এই জেলে এসে সকালে এই কাজই পেলাম।

আমি কিন্তু তাতেও বাঁচতে পারলাম না, আমি যতই তা মেরে ফেলিনা কেন আমি চুল্কানি অনুভব করতাম।মাসের পর মাস আর ধীরে ধীরে তা আমাকে নিশেষ করে দিচ্ছিল।সকালে মাথা গোনা আর সন্ধার খাবারের আগ পর্যন্ত আমরা সবাই উঠোনে থাকতাম। কেউ তাস খেলতেন আর কেউ বা অন্য খেলাধুলা, কেউ ঘুমাতে চেষ্টা করতেন আর কেউ আড্ডা ইত্যাদি। কিছু মানুষ আবার নিজেদের অসহায়ত্ব প্রকাশ করত আর পাগলের মত কাতরাতে কাতরাতে দেওয়ালে পরে যেত, আমরা তাদের বসিয়ে দিতাম। লাঞ্চ ছিল ডাল, আমরা তা ফ্ল্যাট প্লেটে খেতাম, সন্ধার খাবার ৪.৩০ টায় দিয়ে ফেলত, চাপাতি আর ডাল।তা তৈরি হত সব্জীর পরিত্যক্ত অংশ দিয়ে, একদিন পালং শাকের হলে আরেকদিন গাজরের, পরের দিন কুমড়ার, এভাবেই চলত। আলোর চামড়া আর কাটা অংশ দেওয়া হত, ছিল পেয়াজ, ধুন্ধুল, মরিচ আর শালগমের খোসা। তা আবার তত্বাবধায়াকরা খেত না। আমাদের খাবারে সব খোসাগুলো রসহীন পানিতে ভাসতে দেখা যেত। প্রতিদিন আমাদের জন্যে তত্বাবধায়াকরা বড় টবে করে ১৫০ জনের জন্যে খাবার নিয়ে আসত কিন্তু আমরা ছিলাম প্রায় ১৮০ জন তাই, ঘাটতি পুরনে তারা তাতে দুই বালতি পানি ঢেলে দিত।
তারা তা প্রতিটি খাবারে করত আর তারা তা মাথা গোনার পরে সমাধানের জন্য করত আর এতে তারা খুবই মজা পেত। ৬ টার পর আমাদের আবারও গননা শুরু হত এরপর তারা আমাদের লম্বা ডরমিটরিতে রেখে দিত। পরবর্তী দুই ঘন্টা আমরা আড্ডা দিতে পারতাম আর গাজা সেবন করতাম যা আমরা তত্বাবধায়াকদের কাছ থেকে ক্রয় করতাম। আরথার রোড জেলের আসামিরা মাসে ৫ টি রেশনের কুপন পেতেন। যাদের টাকা ছিল তারা কুপন কিনতে পারত। কেউ কেউ কয়েকশো কুপন কিনে রাখত। দুটি কুপন দিয়ে গরম চা, রুটি, চিনি, জ্যাম, গরম খাবার, সাবান, সেভিং ক্রিম, সিগারেট সহ অনেক কিছু কেনা যেত, আর যারা কাপড় ধৌতকরণ করত তাদের বা অন্যান্য কাজ করে দিত তাদের দেওয়া যেত।আরও ছিল কালো বাজারি, ৬ টি কুপন দিলে গাজা পাওয়া যায় আর ৫০ টি দিলে পেনিসিলিন। ৬০ টি কুপন দিলে হেরোইন পাওয়া গেলেও তত্বাবধায়াকরা তা চেক করত, কারন হেরোইন নেশা জেলে মারাত্মক অপরাধ আর সামান্য তা পাওয়া গেলে তত্বাবধায়াকদের ক্ষেপিয়ে
তুলত। তাই যারা তত্বাবধায়াকদের ভয় পেত কোনরকম গাজা দিয়ে কাজ সারত আর পুরু রুম গন্ধ করে ফেলত। প্রতি রাতে সবাই জড়ো হয়ে গান গাইত। কয়েদিরা ১২ বা ১৫ জন করে বসত আর প্লেট কে তবলার মত করে বাজিয়ে তাদের প্রিয় ছায়াছবির গাই গাইত৷ তারা বেদনার আর হারানোর গান বেশি গাইত। গ্রুপে প্রথমে একটি লাইন গাওয়া হত, তার শেষ অক্ষর দিয়ে আরেক গ্রুপ গাইত এভাবে ঘুরেফিরে আবারও প্রথম গ্রুপের কাছে কলি ফিরব আসত৷ এই দলের সাথে আরও ২০/২৫ জনের দল তাল মিলিয়ে হাত বাজিয়ে গাইত।তারা প্রকাশ্যে কেঁদে উঠত আর জোরে জোরে হাসত।তারা এই সংগীত দিয়ে একে অপরের ভালবাসা টিকিয়ে রাখত, বাইরের জগত তারা পরিত্যাগ কবেই করেছে আর সব ভুলে যেত.
প্রায় দ্বিতীয় সপ্তাহের শেষে আমি দুজন তরুনের সাথে মিলিত হলাম যারা এক ঘন্টা পরেই বের হয়ে যাবে৷ মাহেস আমাকে নিশ্চয়তা দিল যে তারা আমার খবর পাঠাতে পারবে। তারা গ্রামের সাধারণ অশিক্ষিত ছেলে যারা প্রথমবারের মতো বোম্বে এসেছিল আর স্বাভাবিক বেকার যুবকদের ধরা পাকড়ে আটকে যায়৷ কোন অভিযোগ ছাড়া প্রায় ৩ মাস পরে তারা মুক্তি পেতে যাচ্ছে। আমি একটু ছোট চিরকুটে আব্দুল কাদের খানের ঠিকানা লিখে দিলাম আর জানালাম আমি জেলে আছি৷ আমি তাদের ওয়াদা দিলাম যে আমি তাদের এই উপকারের প্রতিদান দিব৷ তারা আমাকে হাত দিয়ে প্রতিজ্ঞা করল এবং হাসিমুখে, আশাবাদী হয়ে চলে গেল। পরের দিন তত্বাবধায়াকরা আমাদের সবাইকে জোর করে ডরমিটরিতে বাধ্য হয়ে বসাল আর আমরা দেখলাম যে দুজন তরুণ আমাকে সাহায্য করার কথা তাদের ধরে এনেই দেওয়াল আটকাল। তারা বলতে গেলেই বেহুশ প্রায় , তাদেরকে নির্মম ভাবে মারা হল, রক্ত পুরু শরীরে। মুখ ফুলে গেল আর চোখ ক্ষতবিক্ষত হল। তাদের নগ্ন হাত পায়ে সব লাঠির আঘাত। ‘ তারা এই বহিরাগতের জন্যে খবর পাঠাতে চেষ্টা করছিল’ গামা রাহুল বলল।যারা এরুপ করবে তাদের এই অবস্থা হবে, বুঝেছিস? তারা এবার এই জেলে আরও ৬ মাস থাকবে, বললাম ৬ মাস, যারা এই ভংইগাকে সাহায্য করবে তাদের অবস্থা এইরুপ হবে’।
তত্বাবধায়াকরা সিগারেট খেতে যাওয়ার সাথে সাথেই আমরা আহতদুজনকে সাহায্যে এগিয়ে গেলাম। আমি তাদের ক্ষত মুছে দিচ্ছিলাম আর যে বেশি আহত তাকে কাপড় দিয়ে সেবা করছিলাম। মাহেস ও আমাকে সাহায্য করল পরে আমাকে বাইরে সিগারেট খেতে নিয়ে গেল। অন্যদিকে তাকিয়ে আমাকে বলল, এটি তোমার দোষ নয় লিন, না এটি আমারই দোষ ‘।সে আবেগাপ্লুত হয়ে বলল, না তা নয়, এ জায়গা টিই এমন এক জেল। এই ঘটনা প্রতিদিন ঘটে এখানে। এটি তোমার আমার কারও দোষ নয়। কিন্তু তোমার সমস্যা বেড়ে গেল, কেউ তোমাকে আর সাহায্য করবে না। কলাবা জেলের মত। আমি জানিনা তুমি কতদিন এখানে থাকবে। অই বুড়ো পান্ডুকে দেখছ সে এখানে ৩ বছর আজ। কোন আইনি পদক্ষেপ ছাড়া। অজয় ১ বছর আর সন্তোষ ২ বছর, কোন অভিযোগ ছাড়া আর সে জানেনা কখন তার মামলা কোর্টে যাবে৷
আমিও জানি না কতদিন আমি এই রুমে থাকব। সরি ভাই, কেউ তোমাকে আর সাহায্য করবে না। ৩ সপ্তাহ চলে গেল, মাহেস ঠিকই বলল কেউ তত্বাবধায়াকদের ভয়ে আমাকে সাহায্য করে না। প্রতিদিন অনেকেই মুক্তি পায়, আমি যত সতর্কতার সাথে আর গোপনে পারি চেষ্টা করি তাদের কাছে খবর পাঠাতে কিন্তু কেউ সাহায্য করে না।আমার অবস্থা আরো খারাপ হয়ে আসছিল। আমার মনে হয়েছে ২ মাসে আমার ওজন ১২ কেজি কমেছে, আমাকে চিকনা দেখাচ্ছে।নিশাচর কাদমালের কামড়ে আমার সারা শরীর ঢাকা। আর সব জায়গায় তত্বাবধায়াকদের বেতের আঘাতের চিহ্ন। আর প্রতি মিনিট, দিন আমি ভয়ে থাকতাম যদি আমার ফিংগার প্রিন্ট বলে দেয় আমি আসলে কে? ১০ বছরের সাজা কে উপেক্ষা করে আমি অস্ট্রেলিয়ার জেল থেকে যে পালিয়েছিলাম তা তারা জেনে যাবে আমাকে এই দুঃস্বপ্ন প্রতিরাতে তাড়া করে।এটি আমার হ্দয়ে এমন ভাবে গেথে আছে যে আমি ব্যাথায় মুছড়ে যেতাম আর নিশ্বাস নিতে পারতাম না। অপরাধ হল ছোরার একটি হাতল যা আমরা ব্যাবহার করি, আর প্রেম হল ব্লেড, আর দুঃশ্চিন্তা হল ধারালো ছুরি, যা সব শেষ করে দেয়।
আর হতাশা, মনোকষ্ট, ব্যাথা আরও বেড়ে যেত যখন আমাকে গামা রাহুল তার ১২ বছরের জেল জীবনে সবচেয়ে অপমান দিয়েছি মনে করে যখন তখন পেঠাত।
আমি খালি ডরমিটরির দরজার পাশে বসা আর গত কয়েক সপ্তাহে আমার মনে একটি ছোট গল্প মনে এনে তা লিখছিলাম। আমি গল্পটা লাইনের পর লাইন রিপিট করার চেষ্টা করছিলাম, এটি আমাকে মেডিটেশন এর মত কাজ দিত। আমি যখন একটুকরা পেন্সিল আর চিনির প্যাকেটের কাগজে প্রথম লাইন লিখতে যাচ্ছিলাম, সেপ্পিস সরিয়ে, রাহুল আমার পেছনে এসে যতজোড়ে সম্ভব লাঠি দিয়ে আমার পেছনে আঘাত করল। আঘাতে লাঠির উপরিভাগ নড়ে গেল আর আমার বাহু দিয়ে রক্ত ঝরল, হাত দিয়ে ধরতেই সব রক্ত। আমি ক্ষিপ্ত হয়ে দাড়িয়ে রাহুলের কাপা হাত থেকে লাঠি নিয়ে ফেললাম। আমি তার দিকে এগিয়ে তাকে পেছনে ঠেলতে লাগলাম। জানালা দিয়ে লাঠি ফেলে দিলাম। রাহুলের ভয় আর বিস্ময় লেগে গেল। এটিই সর্বশেষ সে আশা করেছিল। সে তাড়াতাড়ি হুইসল বাজাতে চেষ্টা করল। আমি তাকে সজোরে লাথি দিলাম। সে তাও আ্শা করেনি।আমার লাথি তার নাক ও মুখে লাগল। সে কয়েক কদম পেছনে গেল। ১ নং নিয়ম, তুমি মারামারিতে কখনো পেছনে যাবেনা, যদি না তুমি পাল্টা আক্রমণে না যাও, আমি তাকে হাত পা দিয়ে মারতে শুরু করলাম, সে তার হাত দিয়ে মাথা ঢাকতে চেষ্টা করল আর নিচু হয়ে রইল ২ নং আইন, মাস্তানরা কখনো মাথা নীচ করেনা, তাকে সরাসরি আঘাতের উদ্দেশ্যে আমি তার কান, গলা আর গালে মারতে লাগলাম। সে আমার চেয়ে বড় আর শক্তিশালী ছিল কিন্তু সে যুদ্ধা ছিল না। সে হাটু গেড়ে বসে গেল আর দয়া খুজতে লাগল।।ততক্ষণে আমি দেখলাম অন্যান্য তত্বাবধায়াকরা জড়ো হচ্ছিল আমার দিকে, রুমের এক কোনায় চলে আসছে তারা।আমি কারাতের পৌজ নিলাম আর তাদের অপেক্ষায় দন্ডায়মান, তারা একে অপরের চেয়েও বেশি দৌড়ে আমার দিকে তেড়ে আসছে, একজন আমাকে ধাক্কা দিল, আমি আরেকটি লাথি দিলাম। আমি যত জোরে পারি আমার দুপায়ে লাথি দিলাম তাকে, ৩ বার তাকে পাঞ্চ করলাম, সে মাটিতে পরে গেল। তার মুখে রক্ত, তা ফ্লোরে পরল আর আমার কাছ থেকে সরে গেল, তারা সবাই থমকে গেল, সবাই দ্বিধায় পরে গেল, সবাই আমাকে একটি বৃত্তে ঘিরে লাঠি হাতে নিল। আমি হিন্দিতে চিৎকার করে বললাম, ‘ আস, আস, এর চেয়েও কি খারাপ কিছু করতে পারবে? আমি নিজেকে পাঞ্চ করে ঠোঁট ফেটে রক্ত বের করলাম, আমি রক্ত নিয়ে আমার কপালে লাগালাম। ৩ নং আইন, সবসময় আরেকজনের চাইতেও বেশী চিল্লাবে৷

এবার মারাঠিতে বললাম, ‘ পারবে এরুপ করতে’ ?তোমরা কি মনে করছ আমি তোমাদের ভয় পায়? আস, আমি এটিই চাই আস, আমাকে এখান থেকে বের কর, আমাকে ধরতে পারবে, কিন্তু আমি কারও চোখ তুলে খেয়ে ফেলব’।
‘আয়, তোরা আয়, দ্রুত আয়, খোদারকসম আল্লাহ জানে আমি কত ক্ষুধার্ত’।
তারা পিছু হাটল আর পরিস্থিতি নিয়ে কথাবার্তা বলতে লাগল।
আমি তাদের দেখছিলাম আর আমার পেশির প্রত্যাকটি অংগ বাঘের হুংকার দিচ্ছিল। কিছুক্ষণ কানাঘুষা করে তত্বাবধায়াকরা একটি সিদ্ধান্তে পৌছল।
তারা পেছনে গেল আর কয়েকজন রুম থেকে বের হল, ভেবেছিলাম তারা গার্ড ডাকতে যাচ্ছে, কিন্তু তারা কয়েক সেকেন্ডের মধ্যে ১০ জন আসামি নিয়ে আসল।
তাদের সবাইকে আমার দিকে তাকাত বলল আর মারা শুরু করল। লাঠি দিয়ে খুব জোরেশোরে , সবাই ব্যাথায় কাতরাচ্ছিল। মারা থামল, এক মিনিট পর আর নতুন ১০ জন নিয়ে আসল, কিছুক্ষণ পরে আর ও ১০ জন।

‘ এবার আস, কর্নারে’ তারা বলল। আমি সাধারণ আসামিদের দিকে তাকালাম আর তত্বাবধায়াকদের দিকে, আমি মাথা নাড়লাম, তত্বাবধায়াক আবার আসামিদের মারতে শুরু করল। তাদের আর্তচিৎকারে প্রচন্ড শব্দ হচ্ছিল আর ফ্লোরে আমাদের সবাইকে ভীত পাখির মত করে রাখল। ‘ কর্নার আয়’ না ‘ আরও ১০ জন নিয়ে আস’।
ভয়ে থাকা পরবর্তী ১০ জন আমার দিকে তাকাল, সেখানে মাহেস ছিল আর ঐ দুজন যারা আমার জন্যে মার খেয়েছিল তারা ও ছিল, তাদের সবার চোখেমুখে আমার দিকে আঁকুতি। আমি হাত নিচে করে কর্নারের দিকে আসলাম, তত্বাবধায়াকরা আমার দিকে দৌড়ে এসে আমাকে ধরে ফেলল। তারা আমাকে টেনে স্টিলের গেইটের পাশে আনল, আর পেছন করে বসাল, লোহার বার আমার মাথায়।তারা রুম থেকে লকার নিয়ে আসল, লোহার গ্রিলের সাথে আমার হাত বেধে ফেলল।
তারপর তারা নারিকেলের রশি দিয়ে আমার পা বাধল।
গামা রাহুল আমার পাশে এসে বসল, তার উদ্দমের মৃত্যু হল, সে ঘৃণায়, রাগে ঘাম ফেলছিল আর নিশ্বাস নিচ্ছিল, তার মুখ কেটে গেছে, নাক ফুলে গিয়েছে। আমি জানি আমার ঘুষির কারনে তার মাথায়, কানে, গালে অনেকদিন ব্যথা থাকবে৷
সে হেসে দিল, তুমি একজন মানুষ কতটা নিষ্ঠুরতম হতে পারে তা তার হাসি না দেখলে বুঝতে পারবে না। আমার তখন মরিজির ব্যাপারে বলা লেট্টির কথা মনে পরে গেল, ( শিশুদের পাখা থাকলে তারা বলত, তারা দয়ালু হয়ে সবাইকে টানত) আমি তা ভেবে হেসে উঠলাম। আমার হাতপা বাধা থাকার পরেও আমি হাসতে থাকলাম। তার রক্তমাখা ঠোঁট আর হতবিম্ভতা দেখে আমি আরও জোরে হাসলাম।

প্রহার শুরু হল, গামা রাহুল ক্লান্ত হলেন আমাকে মারতে মারতে, সে মুলত আমার মুখ আর গোপনাংগের দিকে বেশি আঘাত করছিল।
যখন সে থামল, নিশ্বাস নিচ্ছিল তখন অন্য তত্বাবধায়াকরা মারতে শুরু করল।। তারা আমাকে ২০ মিনিট মত লাঠি দিয়ে মারল।

তারা একটু ব্রেক নিল আর সিগারেট পান করল।আমি সামান্য কাপড় পরেছিলাম, তা ভেদ করে সব শরীরের অংশ ফেটে যাচ্ছিল, রক্ত বয়ে যাচ্ছে, পা থেকে মাথা পর্যন্ত। ধুমপান শেষে আবার মার শুরু হল, পরে আমি জানতে পেরেছিলাম যে অন্য রুম থেকেও তত্বাবধায়াক এসে আমাকে মেরে গিয়েছে।

তাদের আক্রমণ ছিল দয়াহীন, এক গ্রুপ শেষ হলে আরেক গ্রুপ এসে মারত।
তারপর চতুর্থ গ্রুপ, এরপরে আবার প্রথম গ্রুপ এসে খুন চেপে আমার উপর পৈশাচিক নির্যাতন চালাল। ১০.৩০ মিনিটে শুরু হওয়া মারধর চলল ঐ দিন রাত ৮ টা পর্যন্ত।
‘ মুখ খুলুন ‘ কি? কেউ যেন বলল, কিন্ত শুকিয়ে যাওয়া রক্তের কারনে আমি চোখ খুলতে পারছিলাম না।

গেইটের অপর দিক থেকে আওয়াজ আসছিল, খুবই জোর করে বলল, ভদ্রভাবে। ‘ স্যার আপনাকে ঔষধ খেতেই হবে ‘।

আমি আমার মুখে গ্লাস অনুভব করলাম, পানি খেলাম। কোনরকমে ঔষধ গিলে ফেললাম, কেউ আমাকে দুটি ঔষধ খাওয়ে দিল। আমি আরও পানি খেলাম আর আমার নাক দিয়ে পানি পরছে।
‘ আপনার ম্যান্ড্র‍্যাক্স ঔষধ স্যার, এবার ভাল ঘুম হবে’ বললেন গার্ড। আমি নীচে শুতে গিয়ে বুঝতে পারলাম আমার শরীরের কোন অংশ বাদ পরেনি যেখানে আঘাত হয়নি আর কাটেনি।

বুঝার কোন উপায় নেই, কোন জায়গায় ব্যাথা।

আমার চোখ বন্ধ, মুখের রক্ত আর পানি পান করছিলাম।

আঁটালো ফ্লোরে আমি ঘুমিয়ে গেলাম।
আমি যে চিৎকার করেছিলাম তা আমার নিজের ভেতরেই ছিল, কিন্তু কোন গোংঞানি তাদের শুনতে দেইনি। তারা আমাকে ফজরের সময়ে এক বালতি পানি মেরে তুলে দিল।
হাজার কাটা অংশ আমার সাথে যেন জেগে উঠল।
তারা মাহেস কে অনুমতি দিয়েছিল আমার চোখ ধৌত করতে তয়লা দিয়ে। যখন আমি চোখ খুলতে পারলাম দেখলাম আমার হ্যান্ডকাফ নেই, আমাকে তুলে নিয়ে তারা রুমের বাইরে নিয়ে গেল।
আমরা একটি খালি উঠোন দিয়ে হাটলাম আর সুন্দর বাগান দিয়ে গেলাম।
অবশেষে আমরা একজন সিনিয়র প্রিজন অফিসারের সামনে এসে দাড়ালাম।
৫০ বছরের মত লোকটি , মুখে গোফ, আর চুল পাকা, পাজামা পাঞ্জাবি পরা।
সুন্দর খোলামেলা মাঠে তিনি বাকা, দেখতে বিশপের চেয়ারের মত, সেখানে বসলেন। গার্ডরা তার পেছনে আর পাশে দন্ডায়মান।
‘ আসলে আমার রোববার এভাবে শুরু হউক আমি চাইনা, ‘ তোমার এসব দুষ্ট কারসাজি কেন’ ? হাই তুলে বললেন তিনি। ভাল ভারতীয় স্কুলে পড়ালেখা শিখে আসা এরুপ ইংরেজি তিনি বলছিলেন। তার কথাবার্তার ধরন আমি বুঝতে পেরেছিলাম, কিছুটা কলোনি পরবর্তীত তা বুঝা যায়, কেননা, আমার আম্মা কষ্ট করে টাকা আয় করে এরুপ বিদ্যালয়ে আমাকেও পাঠিয়েছিলেন। অন্য অবস্থায় আমরা শেক্সপিয়ার বা বাল্ফিলছের মিথলজি নিয়ে কথা বলতাম।
আমি তার দুই লাইন ইংরেজি শুনে তা বুঝছি, কিন্ত তিনি আমার ব্যাপারে কতটুকু জানেন?
কথা বলছনা যে? কি হল? আমার মানুষ কি তোমাকে মেরেছে? আমার তত্বাবধায়াকরা?
আমি নীরবে তার দিকে তাকালাম , আবারো অস্ট্রেলিয়ার জেলের শিক্ষা, তুমি কোন তথ্য, বা কাউকে ট্যাগ করবে না , কার ও বিরুদ্ধে নয়, এমনকি তত্বাবধায়াকদের বিপক্ষে ও কোন কারণ ছাড়াই।
আরে বল, তত্বাবধায়াক কি তোমাকে মেরেছে? ।
তার প্রশ্নের নীরবতা একটি ময়না পাখির ডাকে ভেংগে গেল।
কুয়াশা কেটে গিয়ে সূর্য উদয় হল, কিরণ দিচ্ছিল। এই আলোর কারনে আমি আমার সব গায়ের কাটার ব্যাথা অনুভব করতে পারছি।
নীরবেই আমি আমার হৃদয় দিয়ে ভালবাসার শহরকে উপভোগ করছিলাম।
‘ তোমরা কি তাকে মেরেছ’ ? তিনি একজন তত্বাবধায়াক কে জিজ্ঞেস করলেন।
‘অবশ্যই স্যার, যেহেতু আপনি মারতে বলেছেন তাই’ । ‘ মেরে ফেলতে বলিনি, বেয়াদবের দল, দেখ ত তাকে, মনে হচ্ছে তার কোন চামড়া আর নেই’।

অফিসিয়াল তার ঘড়ি দেখলেন আর প্রকাশ্যই বললেন’ খুবই ভালো হয়েছে, এটি তোমার শাস্তি , তত্বাবধায়াকদের গায়ে হাত তোলার জন্যে, তোমার শিক্ষা হউক ওদের মারলে কি হয়,

আর আজ থেকে পরবর্তী ঘোষণা নে দেওয়া পর্যন্ত তোমার খাবার হবে অর্ধেক, নিয়ে যাও তাকে’আমি আমার নীরবতা বজায় রেখে চললাম, তারা আমাকে রুমে নিয়ে আসল।

আমি সব জানি, যখন জেলের অফিশিয়াল তার ক্ষমতা ব্যাবহার করবে তখন নীরব থাকাই শ্রেয়।
তুমি কিছু করলেই আর বললেই তাদেরকে আরো ক্ষেপিয়ে তুলবে আর রাগান্বিত করবে।ন্যায়পরায়ণতা যখন জর্জরিত হয়ে যায় তখন স্বৈরাচারীতা কিছুই হেয় করে না।
যে আমাকে চেইন পরিয়ে দিচ্ছিলেন তাকে খুবই উৎফুল্ল দেখাচ্ছে, ১৭ বছর ধরে ডাবল মার্ডারে জেল খাটছে। তার বউ পরকীয়াই আসক্ত ছিল , তাই তিনি প্রেমিক সহ দুজনকেই মেরে নিজেকে পুলিশের কাছে স্বেচ্ছায় সোপর্দ করেছিলেন।

‘ খুবই শান্তিপূর্ণ ছিল ‘ তিনি শিকলের বেড়া পরাতে পরাতে বললেন, ‘ ‘ ‘তারা এখন ঘুমাচ্ছে, সে ঘুমাচ্ছিল, আর বউ তখনও জেগে ছিল, কিন্ত সে বেশিদিন জাগল না’ ।যখন তিনি গোড়ালি পর্যন্ত শিকল বাধলেন, এরপর কত লম্বা তা দেখালেন যাতে আমি খুড়িয়ে খুড়িয়ে হাটতে পারি। সেন্টারের মাঝে রিং এর মত একটি লিংক আছে, তিনি আমাকে মোটা একটি কাপড় দিলেন, তা আমার কোমরে বেধে দিলেন। আমি টা টেনে ধরে মাটিতে গড়িমসি দিয়ে কদম ফেলে হাটি।
‘ তুমি জান, তারা বলল যে, আমি নাকি দু’বছর পরেই তত্বাবধায়াক হব’, তিনি আমাকে খুশি মনে চোখ মেরে যন্ত্রপাতি নিতে নিতে বললেন।
‘ চিন্তা করনা, আমি যখন তত্বাবধায়াক হব তখন তোমাকে আমি বাঁচাব, তুমি আমার একজন ভালো শ্বেতাঙ্গ বন্ধু, তাই না? কোন সমস্যা নেই’।
চেইন আমাকে ছোট কদমে আটকিয়ে দিল, দ্রুত হাটতে গেলেই আমাকে লাফ দিয়ে তা করতে হয়, আমার মত আরো দুজন চেইন পরা আমার রুমে ছিল, তাই আমি তাদের দেখে এই কৌশল রপ্ত করি। কয়েকদিনের মধ্যেই আমি ও তাদের মত অবচেতন মনে নেচে নেচে হাটা শুর করি। তাদের কাছ থেকে দেখেই আমি উপলব্ধি করলাম যে, এখানে নাচ ব্যাতিত অন্য একটি ব্যাপার আছে, তারা তাদের নড়াচড়ার মাঝে একটু প্রসন্নতা আনার চেষ্টা করত আর সৌন্দর্য রাখতে চাইত আর মর্যাদার হানি না হয় সেদিকে খেয়াল রাখত।
এর মাঝে ও যে মানুষ একটা শিল্পের খোঁজ পায় তা আমি বুঝলাম।
কিন্ত এটি ছিল ভয়ানক অপমাননা, আমাদের মানুষ যা ক্ষতি করে তাতে আমাদের সম্মানে ঘা লাগে। পৃথিবীটাকে ভালবাসার ক্ষেত্রে তা প্রতিবন্ধকতা হিসেবে কাজ করে।
আর আমাদের যা লজ্জা তা সব মানুষেরই লজ্জা।
আমি হাটতে শিখেছি বটে কিন্ত অর্ধেক খাবার আমার ওজন কমিয়ে ফেলেছে, আমার ধারনা অনুযায়ী ১ মাসেই আমার ওজন ১৫ কেজি কমে গিয়েছে।
আমাকে ছোট একটি চাপাতি আর সামান্য পরিমাণ ডাল দেওয়া হত সারাদিন মিলে।
আমার শরীর চিকন হয়ে আসল আর আমার মনে হচ্ছিল তা প্রতিটি ঘন্টায় আরও আমাকে দুর্বলকরে দিচ্ছে।

অনেকেই আমাকে খাবার চুরি করে এনে দিত, তাদের এই কারনে বেদম প্রহার করা হত, এরপরেও তারা আমাকে এনে দিত।
আমি তাদের অফার কিছুতেই নিতে চাইতাম না, কেননা তাদের যে প্রহার করা হচ্ছে তা আমাকে অপুষ্টির চেয়েও বেশি আঘাত করছে৷
আমার শরীরে থাকা শত শত কাটাছেঁড়া যা আমার দিনে রাতে মার খাওয়া থেকে হয়েছে তা আমাকে ভীষণ জ্বালাযন্ত্রণা দিচ্ছিল।
তার অনেকগুলো আবার সংক্রামিত হচ্ছিল আর ফুলে হলুদ বিষের মত হয়ে গেল। তার সাথে ত কাদমালের কামড় আছেই। আমি তা পোকামাকড় ভরা পানি নিয়ে পরিস্কার করলেও তেমন পরিবর্তন হচ্ছে না। সাথে কাদমালের কামড় আর উকুন আমার শরীর তছনছ করে দিচ্ছে।
আমি রুটিন মেনে তাদের প্রতিদিনই হত্যা করছি এরপরে ও তারা রাতে আমার শরীরের ছেড়া অংশে ঢুকে যায়। প্রতিদিন সকালে আমি তাদের আমাকে খেতে দিয়ে যেন ঘুম থেকে উঠি স্যাতস্যাতে ক্ষত নিয়ে। ঐ দিনের রোববার সকালে জেল অফিসিয়ালের সাথে দেখা হওয়ার পর থেকে আমার উপর মার বন্ধ হল, গামা রাহুল আর অন্যান তত্বাবধায়াক মাঝে মাঝে জোরে না হলে ও হালকা বারি দেয় নিয়মিতভাবে। একদিন আমি যখন শুয়ে বিশ্রাম নিচ্ছিলাম আর পাখির ঝাকের দিকে দেখছিলাম ঠিক তখনই এক শক্তিশালী লোক তার দু’হাতে আমার গলা চেপে ধরল।

‘ মুকুল, মুকুল, আমার ছোট ভাই মনে আছে’ সে হিন্দিতে বলল’মুকুল যাকে তূমি মেরেছিলে, আমার ভাই’। সম্ভবত তারা যমজ, লম্বা আর খুব ভারি, আমি চেহারা মনে করতে পারলাম সে কি বলল তা শুনার সাথে সাথেই, মনে পরল তার ভাই যে আমার প্লেট কেড়ে নিতে চেয়েছিল যাকে আমি মেরেছিলাম কলাবা লক আপে।আমাকে ক্ষুধায় আর জ্বর প্রায় গ্রাস করে ফেলেছে, তার পুরু শরীর আমার উপর আর গলা চেপে ধরে সে আমাকে মেরে ফেলছে।
মারামারির ৪ নং আইন, সবসময় কিছু না কিছু খেলা রেখে দিবে৷
আমার সর্বশেষ শক্তি গর্জে উঠলো, আমি এক হাতেই তার হাত সরালাম আর তার অন্ডকোষে জোরে আঘাত করলাম, সে জোরে চিৎকার করে উঠল আর পাশে ফেরার চেষ্টা করল। সে তার দুপা সমান করে আমাকে আটকাতে চাইল কিন্ত আমার ডান হাত তা হতে দেইনি, তার গলার নরম হাড়ে আমি আংগুল দিয়ে হিট করলাম।

তারপর আমি আমার কপাল দিয়ে দিলাম এক ধাক্কা, প্রায় ১০ বারের মত।

তার দাত, নাক সব ভেঙে গেল আর রক্ত পরা শুরু, তার গলার হাড় যেন নড়ে গেল, সকেট থেকে ছিড়ে যাচ্ছে।
আমি তাকে মারতেই লাগলাম।
আমরা দুজনেই রক্তাক্ত হলাম, কিন্ত সে তখনও বসে পরেনি আমি তাকে মেরেই চললাম।
আমি আমার চেইন দিয়ে তাকে মেরে ফেলতে পারতাম কিন্তু ততক্ষণে তত্বাবধায়াকরা এসে তাকে সরিয়ে নিল। আমি চেইন আবারও কোমরে বেধে নিলাম।
কিন্তু তারা আবারও আমাকে গেইটের কাছে নিয়ে গেল।একটি শক্ত হাত আমার জামা ছিড়ে ফেলল, বেত দিয়ে আবারও মারা শুর হল।
তত্বাবধায়াকরা চেয়েছিল লোকটা আমাকে মারুক, এটি পূর্বপরিকল্পিত ছিল, তারা তা নিজেরাই বিরতির সময়ে স্বীকার করেছে। তারা চেয়েছিল লোকটা আমাকে মেরে অজ্ঞান করে দিক বা মেরে ফেলুক।
তার সেরকম উদ্দেশ্যও ছিল, তাই তারা তাকে রুমে ঢুকিয়ে দিল আর তার প্রতিশোধের ব্যাবস্থা করল।
কিন্ত তা কাজ হয়নি, আমি তাদের মানুষকে মার দিলাম, তাই তাদের পরিকল্পনা সফল হয়নি বলে তারা খুবই ক্ষেপে গিয়েছিল। সেজন্যে নিয়মিত চা, নাস্তা আর সিগারেট বিরতিতে আমার উপর ৪ ঘন্টা প্রহার চলল।
আর অন্যান বাছাইকৃত আসামীদের কে আমার ছিড়ে যাওয়া শরীরের অংশ দেখালশেষে তারা আমাকে গেইটে ছেড়ে দিল।
আমি যখন রক্তে ভরে গেলাম তারা আমাকে নিয়ে কি করবে তা শুনতে পেলাম।

মারামারির পরে তারা আমাকে যে প্রহার করেছিল তাতে আমার অবস্থা কাহিল হয়ে গেল, এতে তারা চিন্তায় পরে গেল, যে তারা অনেক বাড়াবাড়ি করে ফেলেছে। তারা এর কোন ব্যাখ্যা জেল কতৃপক্ষকে দিতে পারবে না। তাই তারা ব্যাপারটা গোপন রাখতে চাইল, তাদের এক চামচা কে আমায় সাবান দিয়ে ধুয়ে দিত বলল।
লোকটা এই কাজটি কঠিন বলে অপরাগতা জানাল, কিন্ত এক মারেই সে কাজ শুরু করে দিল।
আমার জীবন তার কাছে ঋণী আর অবিশ্বাস হলেও সত্যি ঐ লোকটার কাছে যে আমাকে মারতে এসছিল। এই আক্রমণের এবং প্রহারের কারনেই তারা আমাকে গরম পানি আর সাবান দিয়ে গোসল করতে দিয়েছে, এটি ছিল জেলে আমার প্রথম আর শেষ সুবিধা।
সাবানের ধৌতকরণ আমাকে বাঁচিয়ে দিল।
আমি নিশ্চিত ছিলাম যে আমার শরীরের কাটা অংশ আর আঘাতের চিহ্ন আমায় জ্বর এনে দিচ্ছিল, আর ব্যাথা আমাকে প্রায় মেরে ফেলছে। আমি নড়াচড়া করতে খুবই দুর্বল ছিলাম।
যে লোকটা আমাকে পরিস্কার করেছিল, আমি তার নামই জানিনা, সে খুব যত্নসহকারে আমার কাটা অংশ ধুয়ে দিয়েছিল সাবান আর কাপড় ব্যবহার করে।আমার চোখের পানি আর রক্তে ফ্লোর একাকার হয়ে যাচ্ছিল। জ্বর আমাকে ফুটন্ত শিহরণ জাগাচ্ছে আর আমি না খেতে খেতে আরো চিকন হয়ে আসছিলাম।আর প্রতিদিন রুমের কোনায় তত্বাবধায়াকরা তিন বেলা ভালো খাবার খেতে।
প্রায় ১ ডজনের মত চামচা তাদের কাজ করে দিতেন, কাপড়, কম্বল ধৌতকরণ, রান্নাবান্না, ফ্লোর পরিষ্কার, খাবার পরিবেশন এমন কি পা আর মাথা মেসাজ ইত্যাদি।
তারা তাই মার কম খেত আমাদের তুলনায়, বিড়ি, সিগারেট পেতেন আর খাবারের অবশিষ্টাংশ পেতেন। পরিস্কার ফ্লোরে বসে তত্বাবধায়াকরা বিভিন্ন খাবার খেতেন, ভাত, ডাল, আচার, গরম রুটি, মাছ, মাংস আর ডেজার্ট।

তারা যখন তা খেত তখন খাবারের স্ক্র‍্যাপ গুলো তাদেরকে ঘিরে বসা চামচাদের দিকে খোশমেজাজে ছুড়ে মারত আর দেখত তা নিতে মুখে সেলাইভা আসা উৎসুক চোখে সবাই অপেক্ষায় আছে। তাদের খাবারের সুগন্ধি ছিল খুবই পীড়াদায়ক, এরকম চমৎকার সুগন্ধিযুক্ত খাবার কোথাও পায় নি, যেহেতু আমি উপোষই আছি তাই এই খাবারের গন্ধ আমাকে আমার পৃথিবী ভুলিয়ে দিত।আর গামা রাহুল আমাকে প্রতি বেলায় খাবারের অফার দিয়ে খুব মজা করত, সে চিকেনের একটি হাড় নিয়ে আমার দিকে ছুড়ে মারার অভিনয় করত, চোখে প্রলোভন দেখিয়ে আমাকে তার পোষা কুকুর বানাতে চাইত। সে খাবারের কিছু অংশ আমার সামনে ফ্লোরে রেখে বাকীদের নিষেধ করত না নিতে আমি যাতে হামাগুড়ি দিয়ে তা নিতে আসি। যখন আমি কোন কিছুই করতাম না তখন সে বাকীদের খেতে বলে তার দুর্বল হাসিটা দিত আর অন্যরা এই খাবার নিতে কাড়াকাড়ি করছে।
আমি কিছুতেই এই খাবার নিতে যেতাম না, যদিও আমি প্রতিটি দিন আর ঘন্টা দুর্বল হয়ে আসছিলাম, আর আমার জ্বর বেড়ে গেল আর আমার চোখ যেন আগুনে পুড়ছে। আমি খোঁড়ায় খোঁড়ায় হেটে টয়লেটে যেতাম, তা ও যাওয়া কমে যাচ্ছিল। আমার প্রসাব, কালো আর কমরা রং এর হয়ে এসছে।
অপুষ্টি আমার শক্তি নিশেষ করে দিচ্ছিল, সামান্য হাটতে আর বসতে আমার পুরু শক্তি লাগছিল, আর এদিক ওদিক ফিরতে আমার অনেক ঘাট পোহাতে হচ্ছে।
আমি সারা দিন রাত্রি নিস্পন্দ থাকতাম আর উকুন সরিয়ে পরিস্কার করতে থাকতাম। কিন্ত এই সামান্য কাজ ও আমাকে হতভাগ্য আর উর্ধশ্বাস করে রাখত। আমার হার্টবিট অস্বাভাবিক ভাবে বেড়ে গেল, আমি সামান্য কিছুতেই হাফিয়ে উঠতাম আর আমার নিশ্বাস ভাড়ী হয়ে আসছিল। আমি ক্ষিধেয় মরে যাচ্ছিলাম আর আমি জানতাম যে এটি একজন মানুষকে মেরে ফেলার সবচেয়ে কঠিন পদ্ধতি।
আমি জানি যে গামা রাহুলের ফেলে দেওয়া খাবার আমাকে বাচাতে পারবে, কিন্তু আমি তা নিতে যেতাম না, যদিও আমি সেদিকে না তাকিয়ে থাকতে পারতাম না, তার প্রতি গিলে খাওয়া খাবারের স্বাক্ষী ছিল আমার মৃতপ্রায় চোখ দুটি।

আমি দৃষ্টিকে আমার পরিবার আর অস্ট্রেলিয়ার বন্ধুদের কাছে নিয়ে যেতাম, যাদের আমি ফেলে চলে এসছি, আমার আরো মনে পরত কাদের ভাই, আব্দুল্লাহ, কাসিম আলি, জনি সিগার, রাজু, বিক্রম, লেট্টি, ওলা, কবিতা আর দিদিয়ারের কথা।আমার প্রভাকরের কথা মনে পরত আর আমার তাকে বলতে ইচ্ছে করছে আমি তার সৎ, হাসি মাখা অন্তরকে যে কত ভালবাসি৷
আর সবসময় আমার চিন্তা প্রতিদিন কার্লার কাছে চলে যেত, প্রতিটি দিন আর ঘন্টা আমি আমার জ্বলন্ত চোখে তার কথাই ভাবতাম। আর আমি স্বপ্ন দেখতাম যে কার্লা আমাকে এখান থেকে রক্ষা করছে, আমি যখন আমার চেইন এক গার্ড খুলে দিল আমাকে জেল অফিসিয়ালের কাছে নিয়ে যাচ্ছিল তখনও তার কথা চিন্তা করছি।গার্ড নক দিল, দরজা খোলা হল, তারা বাহিরে অপেক্ষা করছিলেন যখন আমি ঢুকলাম। ছোট অফিসে আমি ৩ জনকে দেখলাম, বুড়ো করে একজন প্রিজন অফিসিয়াল, সাদা পোশাকের একজন পুলিশ, আর বিক্রম পাটেল, ডেক্সের পাশে বসা। অই মাই গড, তোমাকে ত ভয়ংকর দেখাচ্ছে, তোমার এই অবস্থা! আপনারা তাকে কি করেছেন?

তারা একে অপরের দিকে তাকালেন কিন্তু কিছুই বললেন না। বস, প্রিজন অফিসিয়াল অর্ডার দিলেন, আমি আমার দুর্বল পা নিয়ে দাড়িয়ে রইলাম, প্লিজ বস। আমি বসে পরলাম আর বিক্রম পাটেলের দিকে বিস্ময় দৃষ্টিতে থাকালাম, তার ফিতে দিয়ে মোড়ানো কালো টুপির সাথে, কালো ভেস্ট, আর প্যান্ট সব বিদেশি মনে হচ্ছে, আর পরিচিত ড্রেস আপ যা আমি চিনি।আমি আমার চোখ দিয়ে তাকে পুরু দেখার পরে এবার তার চোখের দিকে তাকালাম।
তার চেহারা মুল্যবান কিছু আভাস দিয়ে সংকুচিত হয়ে আসছিল।আমি ৪ মাস ধরে আয়নার দিকে তাকাইনি, বিক্রমের আমার দিকে মুখবিকৃতি দৃষ্টিতে আমি বুঝতে পারলাম আমি মৃত্যুর কত কাছে পৌঁছে গিয়েছিলাম। সে তার কালো জামাটা নিল আমাকে দিতে যেটি সে ৪ মাস আগে বৃষ্টিতে দিয়েছিল। ‘ আমি তোমার জামা নিয়ে এসেছি দেখ’ ইতস্ততভাবে বলল সে।

তুমি এখানে কি করছ? এক বন্ধু আমাকে পাঠিয়েছে, তোমার খুব ভালো বন্ধু, হায় খোদা লিন, মনে হচ্ছে তোমাকে কুকুর খেয়ে ফেলেছে।

আমি তোমাকে ভয় পাইয়ে দিচ্ছিনা, কিন্ত মনে হচ্ছে তারা তোমাকে মেরে কবর দিয়েছে, শান্ত থাক, দোস্ত, আমি এসে গেছি, আমি এখানে, আমি তোমাকে এই ইতরের জায়গা থেকে বের করছি। কথার সুত্র ধরে অফিসিয়াল কাশি দিলেন আর অন্য পুলিশের দিকে তাকালেন, পুলিশ মাথা নাড়ল, হাসিমুখে বিক্রম কে বলতে শুরু করলেন।১০ হাজার, অবশ্যই আমেরিকান ডলার।
১০ হাজার, কি? আমি এই টাকা দিয়ে এখান থেকে প্রায় ৫০ জনকে নিয়ে যেতে পারব, কি বলেন, ১০ হাজার!
১০ হাজারই, খুব ঠান্ডা মাথায় অফিসিয়াল বললেন, তিনি জানেন যে ছুরির খেলায় তিনি একমাত্র বন্দুক নিয়ে এসছেন। তিনি ডেক্সে হাত রেখে বললেন আর আংগুল দিয়ে মেক্সিকান ওয়েভ দিচ্ছিলেন। প্রশ্নই উঠেনা, আরে দেখুন, লোকটা কে আপনারা কি করেছেন?
আপনাদের কি মনে হয় এই অবস্থায় তার দাম ১০ হাজার?
তখন পুলিশ একটি ফোল্ডার বের করে বিক্রমের সামনে রাখলেন, সেখানে একটি কাগজ ছিল, সেটি পড়ে বিক্রমের ঠোঁট নড়ে গেল আর তার চোখে বিস্ময়।
‘ আসলে কি তাই? তুমি কি অস্ট্রেলিয়ার জেল থেকে পালিয়েছ? আমি তার দিকে তাকালাম কিন্ত কোন উত্তর দিলাম না। সে পুলিশকে জিজ্ঞেস করল , কতজন জানে এই ব্যাপারটা?
বেশী কেউ নয়, ইংরেজিতে পুলিশ উত্তর দিলেন। কিন্তু এই ব্যাপারটা একান্ত গোপন রাখতে ১০ হাজার যথেষ্ট।

হায় মরলাম, আর কি তর্ক করব, আমি আধঘন্টার মধ্যে টাকা নিয়ে আসছি, তাকে পরিস্কার করুন আর প্রস্তুত করে রাখুন।’ আরো কিছু ব্যাপার আছে’ আমি বাধা দিয়ে বললাম, সবাই আমার দিকে তাকাল।
‘ আমার ডরমিটরিতে আরো ২ জন লোক আছে, তারা আমাকে সাহায্য করতে চেয়েছিল,তত্বাবধায়াকরা তাদেরকে আরো ৬ মাসের সাজা দিয়েছে, তাদের সময় কবেই শেষ হয়ে গেল। আমি তাদের সাথে নিয়ে যাব।

পুলিশ অফিসিয়ালের দিকে দৃষ্টি দিলেন, তিনি হাত দেখালেন আর মাথা নাড়লেন, ব্যাপারটা তুচ্ছ ছিল, তারা মুক্তি পাচ্ছে।আরেকজন আছে, আমি জোরে বললাম, ‘তার নাম মাহেস মালহোত্রা, সে জামিন পাচ্ছেনা, মাত্র কয়েক হাজার রুপি, আমি চাই আপনি বিক্রমকে অনুমতি দিন তার জামিন নিতে টাকা দিয়ে, আমি তাকেও সাথে নিয়ে যাব’ ।তারা দুজনেই একে অপরের দিকে তাকালেন, আর আশ্চর্য হয়ে গেলেন,গরীব বা অসহায় লোকের ভাগ্য তাদের জাগতিক আকাংকা বা আধ্যাত্মিক মোহের তেমন বাধা দিতে পারেনা। তারা বিক্রমের দিকে ফিরলেন, অফিসিয়াল তার চোয়াল নাড়লেন মনে হচ্ছে বলতে চাচ্ছেন যেন, সে পাগল মনে হয়, তারপর ও সে যখন চাই…..বিক্রম চলে যেতে দাড়াল, আমি ঈশারা করাতে সে বসল।
আরেকজন আছে। পুলিশটা জোরে হেসে উঠলেন ।

আম এক, তিনি আবার হেসে বললেন।
সে আফ্রিকান,সে আফ্রিকান কম্পাউন্ডে আছে, তার নাম রাহিম, তারা তার হাত ভেঙে দিয়েছে। আমি জানিনা সে বেঁচে আছে কিনা, বেঁচে থাকলে তাকেও চাই।

পুলিশটি অফিসিয়ালের দিকে তাকালেন, প্রশ্ন করতে হাত তুলে দেখালেন আমি তার কেস কি জানি, এটি পুলিশের মামলা, এই লোকটা এক পুলিশ অফিসারের স্ত্রীর সাথে সম্পর্ক রেখেছিল, তাই অফিসার খুবই সতর্কতার সাথে তাকে এখানে এনে রেখেছে এই বদমাশ এখানে এসে আমার তত্ববধায়াকের গায়ে হাত তুলে, তাই এটি প্রায় অসম্ভব।
কিছুটা নীরবতা বিরাজ করল, আর অসম্ভব শব্দটা সস্তা সিগারেটের ধোঁয়ার মত শুনাল।
৪ হাজার, পুলিশ বললেন। রুপি? বিক্রম জানতে চাইল।
আরে ডলার, পুলিশটা হেসে বললেন , ৪ হাজার এক্সট্রা, ২ হাজার আমাদের সবার জন্যে আর ২ হাজার এই মাগীর ডার্লিং ইন্সপেক্টরকে দিতে হবে।
ভদ্রভাবে বিক্রম জিজ্ঞেস করল, আর কেউ কি আছে লিন?
আমি জানতে চাচ্ছি কারন আমি পুরু গ্রুপ নিয়ে ডিস্কাউন্ট চাইব তাই। আমি তার দিকে তাকালাম, চেয়ারে বসতে বসতেই ঘেমে গেলাম, আমার চোখেমুখে আবার জ্বর আসছে। সে আমার দিকে ঝুকে পরে তার হাত আমার কাধে রাখল, আমার মনে হয়েছে আমার শরীরের কিছু উকুন তার হাতে গেল, কিন্তু আমি তার এই নিশ্চয়তার হাতকে সরাতে পারলাম না ঠিক আছে দোস্ত, সব ব্যাবস্থা হয়ে যাচ্ছে, কোন চিন্তা করনা, আমি এখনই আসছি।
আমি তোমাকে ১ ঘন্টার মধ্যেই বের করছি। আমি ওয়াদা দিচ্ছি আমি তোমাদের জন্যে আর আমাদের জন্যে দুটো ট্যাক্সি নিয়ে আসছি।
৩ টা ট্যাক্সি আনবে, আমি নতুন গলার সুরে কথা বললাম, মনে হচ্ছে সত্যিই আমি মুক্ত পেতে যাচ্ছি, ১ টি তোমার জন্যে, আর ২ টি আমাদের জন্যে কারণ আমাদের শরীর ভর্তি উকুন।

ঠিক আছে বুঝতে পেরেছি ৩ টা ট্যাক্সি।
আধঘন্টা পর আমি একটি হলুদ ট্যাক্সি করে রাহিমের সাথে পেছনের সিটে বসলাম।
ফিয়াট যাচ্ছে স্থাপত্য প্রদর্শনী আর শত লোকের নাট্যমঞ্চে গড়া শহরের ভেতর দিয়ে।
রাহিম কিছুটা ট্রিটমেন্ট পেয়েছিল, তার হাত প্লাস্টার বাঁধা আর তার চোখে আতংক, সে অনেক চিকন হয়ে গিয়েছে। আমি তার দিকে তাকাতেই বমি আসতে চাইল, সে কোন কথাই বলল না, শুধুমাত্র তাকে কোথায় নামিয়ে দিতে হবে তা বলল।
সে নীরবে কান্না করছিল, যখন আমরা তাকে হাসান ওবাইকের ডংরিতে অবস্থিত রেস্তোরাঁয় নামিয়ে দিলাম।আমরা যখন যাচ্ছিলাম তখন ড্রাইভার আমার ক্ষুধার্ত, মার খাওয়া মুখের দিকে তাকাল, অবশেষে আমি তাকে জোর গলায় বললাম তার গাড়িতে কোন হিন্দি ছবির গান আছে কিনা? অবাক হয়ে সে বলল, আছে।আমি আমার একটি পছন্দের গান বললাম, সে তা চালিয়ে , হর্ণ বাজিয়ে, শত কোলাহলে আর ট্রাফিকে চলে যাচ্ছে।
এটি কয়েদীদের জেলে গাওয়া গানের মধ্যে একটি ছিল। আমি ও গানটি গাইতে লাগলাম আমার গন্ধের, রং এর এই শহরে।
ড্রাইভার ও যোগ দিল গাইতে কিচ্ছুক্ষণ পর পর আমার দিকে তাকিয়ে।
আমরা গান গাওয়ার সময় কেউ মিথ্যে বলিনা, আর ভারতবর্ষ হল গায়কদের আবাসস্থল, চরম দুখের সময়ে যদি কান্না কাজ না করে তা গান গেয়ে অনবদমিত করে সবাই ।
আমার গান গাওয়া তখনই চলছে যখন আমি আমার পরনের পচা কাপড় ফেলে দিচ্ছিলাম আর বিক্রমের শাওয়ারে নাওয়া সারছি।আমি ডেটল দিয়ে আর ব্রাশ দিয়ে আমার পুরো শরীর পরিস্কার করলাম।
হাজার কাটা, আর আঘাতের চিহ্ন আমাকে কাদিয়ে ছাড়ল, কিন্তু আমার চিন্তাই তখনও কার্লা।
বিক্রম বলল সে দুই দিন আগে শহর ছেড়ে গেছে আর কেউ জানে না সে কোথায়।
‘ তাকে আমি কিভাবে খুজব? সে কোথায়, সে কি আমাকে ঘৃণা করে? সে কি ভাবছে আমি তাকে ঠকিয়েছি আমাদের ঐ রাতের মিলনের পরে?
সে কি আমাকে তাই ভাবতে পারে? আমার বোম্বেতেই থাকতে হবে , এই শহরে তাকে ফিরে আসতেই হবে, আমার তার অপেক্ষায় থাকতেই হবে ‘।

আমি প্রায় দু’ঘন্টা শাওয়ারে কাটালাম,ধৌতকরণ , আর আমার ব্যাথায় দাঁত চেপে ধরলাম, আমার কাটাছেঁড়া গুলো তখনও কাচা ছিল, আমি বিক্রমের আয়নার সামনে দাড়িয়ে দেখলাম।
হায়রে, সে বলল, আমার দিকে তাকিয়ে দয়া দেখাল।
আমি দীর্ঘক্ষন আয়নার দিকে নিজেকে দেখলাম আর তার স্কেল দিয়ে ওজন মেপে দেখি ৪৫ কেজি, যখন আমাকে ধরেছিল তখন ছিলাম ৯০ কেজি, ঠিক অর্ধেক!
আমার শরীর এতই যে ভেংগে গেল, তা দেখতে কন্সেন্ট্রেশন ক্যাম্প থেকে বেঁচে আসা মানুষের মত হল।
আমার সব হাড় দেখা যাচ্ছিল, গাল ভাংগা আর কাটা, ক্ষতে আমার পুরু শরীরে কচ্ছপের মত দাগ হল।
‘ কাদের তোমার ব্যাপারে জানতে পেরেছে দুজন আফগান ছেলের কাছ থেকে, যারা তোমার ডরমিটরি থেকে বের হয়েছিল, তারা তোমাকে কাদেরের সাথে দেখেছে একদা যে রাত্রে অন্ধ গায়কগণ গান গেয়েছিল, তাদের তোমার চেহারা মনে আছে’ ।
আমি তাদের চেহার মনে আনার চেষ্টা করলাম, পারলাম না, তারা নিশ্চয়ই তা গোপনে করেছে কারন তারা আমার সাথে কোনদিন কথাই বলেনি, তারপরও তাদের আমি ধন্যবাদ দিলাম, কারন আমি তাদের কাছে ঋণী।
তারা মুক্তি পেয়ে কাদেরকে তোমার ব্যাপারে বলল, আর তিনি আমাকে তোমায় উদ্ধার করতে পাঠালেন। তোমাকে কেন? তিনি চাননি কেউ জানুক তিনি তোমাকে বের করছেন, তাই কম টাকা, তারা তা জানতে পারলে টাকা অনেক বেশী নিত।
কিন্তু তুমি উনাকে কিভাবে চিন? আমি আমার আমার উপর চলা বর্বরোচিত হামলার কথা মনে রেখে এখনো আতকে উঠছিলামা, আর তাকে বললাম।

কাকে? কাদের ভাইকে, কিভাবে?
কলাবার সবাই ত উনাকে চিনেরে ভাই।
কিন্তু তুমি কিভাবে? একবার ওনার জন্যে একটি কাজ করেছিলাম আমি।
কোন ধরনের কাজ?
অনেক লম্বা কাহিনি দোস্ত।
সময় আছে বল। বিক্রম হাসি দিল, মাথা নাড়ল, তার প্রাইভেট বার থেকে দুটো গ্লাস নিয়ে ভরল। আমাকে ড্রিংকস দিয়ে শুরু করল বিক্রম, কাদের ভাইয়ের গুন্ডাপান্ডারা একদিন এক ধনীর ছেলেকে মারল, ভালোই মারল এক নাইটক্লাবে।
আমি যা শুনলাম, ছেলেটার পরিবার মামলা করল,কাদের ভাই আমার বাবাকে চিনতেন, আর খোঁজ নিয়ে দেখলেন যে ছেলেটা আমার কলেজ বন্ধু।
তিনি আমাকে পাঠালেন খবর নিতে যে, কত দিলে তারা মামলা তুলে ফেলবে।
তারা অনেক চাইল, কাদের ভাই ও আরো বেশি দিলেন , তিনি চাইলে না দিতে পারতেন, তাদের আটকানো যেত, ভয় দেখাতে বা মেরে ফেলতে পারতেন, তার ছেলেদের দোষ ছিল ( ণা), তাই তিনি সবাইকে খুশি রাখলেন।
কাদের ভাই অসাধারণ, খুবই মারাত্মক ও বটে, আমার বাবা উনাকে খুবই শ্রদ্ধা করেন, আর পছন্দ ও করতেন, এটা অনেক ব্যাপার যে কারন বাবা তেমন মানুষ পছন্দ করেননা। ।
তুমি জান, কাদের আমাকে তার কাজ করার জন্যে বলেছিলেন? কি কাজ?
জিজ্ঞেস করনা, সে বলল, তারপর ড্রায়ার থেকে কিছু নতুন কাপড় নিতে শুরু করল। আমি জামা, ট্রাউজার্স, স্যান্ডেল সব পরে নিলাম।
তিনি আমাকে তোমার যখন ভালো লাগবে তখন নিয়ে যেতে বলেছিলেন।
আমি মনে করিনা তাই করা উচিত, কাপড় পরে নাও, তোমার দ্রুত টাকা আয় করতে হবে আর তোমার উনার মত মানুষের প্রয়োজন আছে দোস্ত। আর অস্ট্রেলিয়ার ঘটনা বলা যায় বিশাল এক ব্যাপাররে দোস্ত , পালিয়ে বেড়ানো মনে হচ্ছে নায়কোচিত কাজ।
বলা যায় কাদেরের পাশে তুমি নিরাপদই থাকবে।
তার ছায়াতলে থাকলে তোমাকে এই অবস্থা করার সাহস আর কারো নেই।
তোমার খুবই শক্ত বন্ধু আছে লিন, কেউ বোম্বেতে কাদের ভাইয়ের সাথে লাগতে যায়না।
আমি জোর গলায় তাকে বললাম, তাহলে তুমি তার পক্ষে কাজ করছনা কেন?
আর আমার মনে এখনো সেই উকুনের ধূপাধার আর মারের কথা।
আমাকে কখনো সেভাবে বলা হয়নি, আর বললে আমি তেমন তা করতে পারতাম না।

আমার উনাকে তোমার মত করে দরকার নেই, লিন, মাফিয়াদের একে অপরের প্রয়োজন হয়, মানে বুঝছ ত? তাদের কাদের ভাইকে দরকার আর উনার তাদেরকে, আমার সেরকমভাবে উনাকে দরকার নেই। তোমাকে খুবই বিশ্বস্ত দেখাচ্ছে তার চোখেই বললাম।
আমি নিশ্চিত কাদের ভাই বললেন যে, তিনি তোমাকে কেন জেলে দিয়েছে তা জানতে পেরেছেন, খুব ক্ষমতাসম্পন্ন একজন নাকি তোমার প্রতি এই কাজ করেছেন।
কে ছিল?
তিনি তা বলেননি, তিনি কে তা এখনো জানেনা, হয়তোবা তিনি আমাকে বলতে চাননি।
যাইহোক আমার ভাই লিন, তুমি কাদা মাটিতে দার বেয়েছ, খারাপ লোক পারে না এমন কাজ নেই এখানে, আর তুমি এতে পরে গেলে তোমার প্রতিরক্ষা দরকার।
তোমার এক্ষেত্রে দুটি পথ আছে, হয় শহর ছেড়ে যাও, না হয় পাশে আগুনের গোলা রাখ, বেস্টনীর মত।তুমি কি করবে?
সে হাসল আর আমার আর তার জন্যে দুটো সিগারেট জ্বালাল। আমি? আমি খুবই ক্ষিপ্ত ইয়ার, আমি গরু পছন্দ করি বলে এই পোশাক পরিনা, আমি পরি কারন, কাউবয়রা কিভাবে হ্যান্ডেল করে তার জন্যে যে করুক না কেন আমার সাথে এমন কাজ, আমি প্রতিশোধ নিবই, আমি যখন প্রস্তুত হব তারপর কাদেরের অফার গ্রহন করব, তার পক্ষে কাজ করব, আমার প্রতিশোধ নিব।
কারন এটি আমিই, আমি এক ভারতীয় বদমাশ ইয়ার, একজন ভারতীয় বদমাশ তাই করে।
আমি আবারো আয়নার দিকে তাকালাম, নতুন কাপড় কাটায় লবনের টুকরোর মত হল, তা কিছুটা ঢেকে দিচ্ছে, আমার নিজেকে কম ভীতিপ্রদ, কম মুখাপেক্ষী আর কম লুকিয়ীত মনে হচ্ছে।
আমি আয়না দেখে হাসছি, নিজেকে কেমন ছিলাম তা আবিস্কার করার চেষ্টা করছিলাম।
প্রায় নিজের মত মনে হচ্ছে, কিন্তু নতুন একটি চাহনি আমার মাঝে ফিরে আসল, কখনো নয় আর, এই আঘাত আমার উপর দিয়ে আর যাবেনা, এই ক্ষুধা আমার আর হবেনা, ভয় আর আমাকে ছিড়ে ফেলতে পারবেনা, আমার চোখ তাই বলছে যাই আসুক না কেন।
আমি তার সাথে দেখা করতে প্রস্তুত, এখনই আমি প্রস্তুত