মুহাম্মদ আবু সিদ্দিক ওসমানী :

কক্সবাজার জেলা পুলিশের ব্যবস্থাপনায় আগামী শনিবার ২৩ নভেম্বর মহেশখালী উপজেলার কালারমারছরা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের মাঠে জলদস্যুদের আত্মসমর্পণ অনুষ্ঠানের প্যান্ডেল, স্টেজ, নিরাপত্তা বেষ্টনী তৈরীর কাজ পুরোদমে চলছে। প্রায় দু’শ শ্রমিক দিবারাত্রি ২ শিফটে কাজ চালিয়ে যাচ্ছে। ডেকোরেশনের মালামাল চকরিয়া ও চট্টগ্রাম শহর থেকেও আনা হচ্ছে। মহেশখালী থানার কালারমার ছরা ফাঁড়ির পুলিশ সরাসরি এ কাজ তদারকি করছে। ভিভিআইপি, আমন্ত্রিত অতিথি সহ প্রায় এক হাজার মানুষ অনায়সে সেখানে বসার ব্যবস্থা হওয়ার মতো প্যান্ডেলটি নির্মাণ করা হচ্ছে। আগত অতিথিদের নিরাপত্তা, অভ্যর্থনা, প্রটোকল, জলদস্যুদের জমায়েত, তাদের অস্ত্র জমা করা, যাতায়াত সুবিধা, পার্কিং, প্যান্ডেল, মঞ্চ তৈরি, নিরাপত্তা বেষ্টনী, আইনশৃংখলা রক্ষাকারী বাহিনীর অবস্থান ইত্যাদি সার্বিক বিষয় মাথায় রেখে রেকি ও ম্যাপ মতো সবকিছু পরিকল্পিতভাবে তৈরি করা হচ্ছে।

একইসাথে মধ্যস্থতাকারীর নিয়ন্ত্রণে চলে আসা একশোর কাছাকাছি অস্ত্রের কারিগর, জলদস্যু ও সশস্ত্র সন্ত্রাসীরা শনিবার আত্মসমর্পণের পর কারাগারে যাওয়ার জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছেন। তাদের সাথে দেখা করছেন আত্মীয় স্বজন, বন্ধু-বান্ধবেরা। বিদায় নিচ্ছেন কারাগারে যাওয়ার আগে। আসন্ন শীত মওসুমের কথা চিন্তা করে পরিধেয় কাপড় চোপড়, ওষুধ পত্র গুছিয়ে নিচ্ছেন তারা। আত্মসমর্পণ করতে মধ্যস্থতাকারীদের নিয়ন্ত্রণে চলে আসার সংখ্যা আপাতত একশো এর কাছাকাছির মতো হলেও বৃহস্পতিবার ২১ নভেম্বরের মধ্যে এ সংখ্যা আরো বাড়তে পারে। আত্মসমর্পণ অনুষ্ঠানের শৃংখলার প্রয়োজনে বৃহস্পতিবার বিকেলের পরে আর কোন আত্মসমর্পণকারী মধ্যস্থতারীর নিয়ন্ত্রণে আনা হবেনা বলে সিবিএন-কে বিশ্বস্ত সুত্র জানিয়েছেন। আত্মসমর্পণে আগ্রহী অনেক জলদস্যু ও অস্ত্রের কারিগর আগে থেকে আত্মসমর্পণ অনুষ্ঠানের তারিখ নির্ধারনের অপেক্ষায় ছিলো। এখন তারিখ নির্ধারণ হওয়ায় অপেক্ষায় থাকা এরকম আগ্রহীরা মধ্যস্থতাকারীদের নিয়ন্ত্রণে আসার জন্য তাদের সাথে যোগাযোগ করছে বলে এই আত্মসমর্পণের একমাত্র মধ্যস্থতাকারী প্রাইভেট টিভি চ্যানেল আনন্দ টিভি’র বিশেষ প্রতিনিধি, কক্সবাজারের পেকুয়ার উপজেলার উজানটিয়া ইউনিয়নের মালেক পাড়ার বাসিন্দা এম.এম আকরাম হোসাইন সিবিএন-কে জানিয়েছেন।

আত্মসমর্পণকারীর সংখ্যা, অনুষ্ঠানের সার্বিক প্রস্তুতি সহ সবকিছু স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান এমপি, পুলিশের আইজি ড. জাবেদ পাটোয়ারী বিপিএম (বার) সহ উর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে অবহিত করতে কক্সবাজারের পুলিশ সুপার এ.বি.এম মাসুদ হোসেন বিপিএম বুধবার বিকেলে ঢাকা গেছেন। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান এমপি, পুলিশের আইজি ড. জাবেদ পাটোয়ারী বিপিএম (বার) যথাক্রমে প্রধান ও বিশেষ অতিথি হিসাবে অনুষ্ঠানে উপস্থিত থাকতে শনিবার ২৩ নভেম্বর সকাল ৯ টায় প্রথম বিমানযোগে কক্সবাজার পৌঁছাবেন। সেখান থেকে তাঁরা কিছুক্ষণের জন্য সার্কিট হাউসে অবস্থান করে জলদস্যু আত্মসমর্পণ অনুষ্ঠানের সামগ্রিক বিষয়াবলী জ্ঞাত হবেন। এরপর শনিবার সকাল সোয়া ১০ টার দিকে সমুদ্র পথে স্পীডবোট যোগে জলদস্যু ও অস্ত্রের কারিগর আত্মসমর্পণের জন্য নির্ধারিত মাঠ কালারমারছরা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের উদ্দেশ্যে রওয়ানা দেবেন।

কক্সবাজার জেলার সবচেয়ে বেশী অপরাধপ্রবণ এলাকা হিসাবে পরিচিত এই মহেশখালী উপজেলার কালামারছরা ইউনিয়নসহ পার্শ্ববর্তী এলাকা। খুন, রাহাজানি, দস্যূতা, অপহরণ, চাঁদাবাজি সহ সব জগন্য অপরাধকর্ম সংগঠিত হওয়া কালারমারছরার জন্য একেবারে নিত্তনৈমিত্তিক ব্যাপার। মহেশখালীর চিহ্নিত অস্ত্রের কারিগর ও কূখ্যাত বেশ ক’টি জলদস্যু বাহিনীর সর্দার ও বাহিনীর সদস্যরা এদিন স্বদলবলে আত্মসমর্পণ করছেন। আত্মসমর্পণকারীদের মধ্যে কূখ্যাত খউস্বর বর গ্রুপ, কালারবর গ্রুপ সহ ৬ টি পৃথক জলদস্যু বাহিনীর প্রধান, সদস্যরা, অস্ত্রের কারিগরদের সর্দার, সদস্যরা আত্মসমর্পণ করতে মধ্যস্থতাকারীর নিয়ন্ত্রণে চলে এসেছে। এসব কূখ্যাত বাহিনী আত্মসমর্পণ করলে অপরাধের স্বর্গরাজ্য হিসাবে পরিচিত কালারমারছরা সহ উপকূলীয় এলাকায় সাধারণ মানুষ কিছুটা হলেও স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলবে বলে ধারণা করা হচ্ছে।

এই আত্মসমর্পণ অনুষ্ঠানে কক্সবাজার-২ আসনের সংসদ সদস্য আশেক উল্লাহ রফিক, কক্সবাজারের জেলা প্রশাসক মোঃ কামাল হোসেন, স্থানীয় অন্যান্য সংসদ সদস্যগণ, র‍্যাবের কর্মকর্তা, বিজিবি’র রিজিওন কমান্ডার, কোস্টগার্ডের প্রতিনিধি সহ আইনশৃংখলা রক্ষাকারী বাহিনীর উর্ধ্বতন কর্মকর্তারা যোগ দেবেন বলে সিবিএন-কে বিশ্বস্ত সুত্র নিশ্চিত করেছেন। কক্সবাজার জেলা পুলিশ আয়োজিত এই অনুষ্ঠানে কক্সবাজারের পুলিশ সুপার এ.বি.এম মাসুদ হোসেন বিপিএম সভাপতিত্ব করবেন।

অনুষ্ঠানে যোগদিতে পুলিশের চট্টগ্রাম রেঞ্জের ডিআইজি খন্দকার গোলাম ফারুক বিপিএম (বার) পিপিএম শুক্রবার ২২ নভেম্বর কক্সবাজার পৌঁছাবেন বলে সুত্রটি সিবিএন-কে জানিয়েছেন। সুত্রমতে, অস্ত্রের কারিগর ও জলদস্যুরা শতাধিক অবৈধ অস্ত্র, প্রায় ১ হাজার গোলাবারুদ, ধারালো ভয়ংকর অস্ত্র, অস্ত্র তৈরীর সরঞ্জাম সহ আনুষ্ঠানিকভাবে আত্মসমর্পণ করতে রাজি হয়েছেন। আত্মসমর্পণ অনুষ্ঠান সফল করতে, জলদস্যু ও অস্ত্রের কারিগরদের তাদের আস্তনা থেকে আইনশৃংখলা রক্ষাকারী বাহিনীর নিয়ন্ত্রণে আনতে আত্মসমর্পণকারীদের মধ্যস্থতাকারী আনন্দ টিভি’র বিশেষ প্রতিনিধি এম.এম আকরাম হোসাইন বিরাট ঝুঁকি নিয়ে এখন দিনরাত মহেশখালী উপকূল ও সাগরে অবস্থান করছেন। ২০১৬ সাল থেকে কক্সবাজারের ভূমি পুত্র, আত্মপ্রত্যয়ী এম.এম আকরাম হোসাইন মহেশখালী, কুতুবদিয়া, পেকুয়া ও চকরিয়া উপকূলীয় এলাকা থেকে কুখ্যাত জলদস্যু, দাগী অস্ত্রের কারিগর, ভয়ংকর সন্ত্রাসীদের স্বাভাবিকজীবনে ফিরিয়ে আনতে নিরন্তর কাজ করে যাচ্ছেন জীবনের ঝুঁকি নিয়ে। দেশ মাতৃকার প্রয়োজনে, বিশেষ করে কক্সবাজার সমুদ্র উপকূলকে জলদস্যু মুক্ত করতে তিনি শ্রম, সময় ও মেধা ব্যয় করছেন অনবরত। অদম্য, আত্মপ্রত্যয়ী একই সাথে তিনি সীমান্ত উপজেলা টেকনাফ ও উখিয়া উপজেলার ইয়াবা সহ মাদক ব্যবসায়ী, হুন্ডি কারবারিদের স্বাভাবিকজীনে ফিরিয়ে আনতেও তার প্রচেষ্টা ছিলো বেশ প্রশংসনীয়।

আত্মসমর্পণকারীদের স্বাভাবিক জীবনে ফিরে আসতে রাষ্ট্রীয় উদ্যোগে তাদেরকে প্রনোদনা দেওয়া হবে বলে একটি সুত্রটি সিবিএন-কে জানিয়েছেন। তাদের বিরুদ্ধে আত্মসমর্পণের পর অস্ত্র আইনে মামলা দায়ের করা হবে। তবে এ মামলা থেকে আত্মসমর্পণকারীরা সহজে মুক্তি পেতে মামলা পরিচালনায় রাষ্ট্রপক্ষ তাদেরকে সহযোগিতা করবে। এটি হবে মহেশখালীতে জলদস্যুদের ২য় দফায় আত্মসমর্পণ। এর আগে আত্মসমর্পণকারী মহেশখালী-কুতুবদিয়া সমুদ্র উপকূলের ভয়ংকর জলদস্যুরা কারাগার থেকে মুক্তি পেয়ে স্বাভাবিকজীবনে ফিরে এসেছে।

প্রসংগত, ২০১৮ সালের ২০ অক্টোবর মহেশখালীতে অনুরূপভাবে ৪৩ জন সশস্ত্র জলদস্যু আনুষ্ঠানিকভাবে আত্মসমর্পণ করেছিলো। সেখানে ৪৩ জনের মধ্যে বর্তমান আনন্দ টিভি’র বিশেষ প্রতিনিধি এম.এম আকরাম হোসাইনের একক মধ্যস্থতায় ৩৭ জন জলদস্যু আত্মসমর্পণ করেছিলো। এছাড়া চলতি বছরের ১৬ ফেব্রুয়ারী ১০২ জন ইয়াবাকারবারী টেকনাফে চ্যানেল ২৪ টিভি’র তৎকালীন সিনিয়র স্টাফ রিপোর্টার এম.এম আকরাম হোসাইনের একক মধ্যস্থতায় দেশে প্রথম মাদক কারবারি আত্মসমর্পণ করেছিলো। সেদিনের মাদক কারবারী আত্মসমর্পণ করা ছিলো এ দেশের জন্য একটা ইতিহাস ও রেকর্ড। একটি সুত্র সিবিএন-কে জানান, জলদস্যুদের আত্মসমর্পণের এটা একটা বিরাট সুযোগ। যারা এই সুযোগ কাজে লাগাবে না তাদেরকে কঠোর আইনের আওতায় আনা হবে। এরমধ্যে গত বছরের ২০ অক্টোবর মহেশখালীতে আত্মসমর্পণ করা ৪৩ জন জলদস্যু সরকারের কাছ থেকে প্রতিজন এক লক্ষ টাকা করে আর্থিক অনুদান পেয়ে তারা কারাগার থেকে মুক্ত হয়ে এখন ক্ষুদ্র ব্যবসা বাণিজ্য করে স্বাভাবিক জীবন যাপন করছেন।