ইমাম খাইর, সিবিএন:
উৎপাদিত লবণের ন্যায্যমূল্য না পাওয়া, বাজারে সোডিয়াম সালফেটের প্রভাব ও রেকর্ড পরিমাণ লবণ উদ্বৃত্ত থাকার পরও আমদানির কারণে চরম হতাশ চাষিরা। নভেম্বরের প্রথম সপ্তাহ থেকে লবণ মৌসুম শুরু হলেও অনেক জায়গায় এখনো চাষি মাঠে নামেনি। দাম না পাওয়ায় মাঠ ও মিলে পড়ে রয়েছে প্রায় ৭ লাখ মেট্রিকটন লবণ।
লবণের মৌসুম শেষ না হতেই অন্যান্য বছর চাষিরা জমিদারের হাতে অগ্রিম টাকা দিলেও এ বছর তার উল্টো। ক্ষেত্রবিশেষে লবণমাঠ ফ্রি দিয়েও চাষি মিলছে না। এরই মাঝে দুইদিন আগে লবণের কৃত্রিম সংকট দেখিয়ে মূল্য বৃদ্ধি হয়েছে বলে যে অপপ্রচার হয়েছে, তাতে আরেকটি ধাক্কা খেল দেশীয় এই শিল্পটি।
সারা দেশের লবণের চাহিদার সিংহভাগ মেঠানো হয় কক্সবাজারের লবণ দিয়ে। বর্তমানে লবণের দাম না পাওয়ায় এখানকার লবণমাঠ মালিক ও চাষিদের করুণ দশা। সব মিলিয়ে লবণশিল্প করুণ অবস্থার মুখোমুখি।
টেকনাফের হোয়াইক্যং এলাকার লবণমাঠ মালিক গোলাম আজম খান কক্সবাজার নিউজ ডটকম (সিবিএন)কে বলেন, মৌসুম শেষ না হতেই পরের বছরের জন্য অগ্রিম লাগিয়তের টাকা দিয়ে যেত চাষিরা। এ বছর চাষিদের খোঁজেও পাওয়া যাচ্ছে না। গত বছর যারা চাষ করেছে তারাও অনীহা প্রকাশ করছে।
সদরের ইসলামপুরের লবণমাঠ মালিক মনজুর আলম (দাদা) বলেন, অন্যান্য বছরের মতো এ বছর চাষিদের আগ্রহ নেই। দাম না পাওয়ায় সবাই হতাশ। যে লবণের মাঠের লাগিয়ত মূল্য ২৫-৩০ হাজার টাকা ছিল, তা এ বছর অর্ধেক দামেও চাষি মিলছে না। কিছু জায়গায় চাষি নামলেও তা কাঙ্খিত নয়। লবণশিল্প বাঁচাতে ন্যায্যমূল্য নিশ্চিত করা দরকার।
বিসিক কক্সবাজারের উপমহাব্যবস্থাপক সৈয়দ আহামদ কক্সবাজার নিউজ ডটকম (সিবিএন)কে বলেন, মৌসুম শুরু হলেও বেশিরভাগ এলাকায় এখনো চাষিরা মাঠে নামেনি। ন্যায্যমূল্য প্রাপ্তিতে চাষিদের আস্থা ফেরানো না গেলে চাষিদের মাঠে নামানো দায় পড়বে। তিনি বলেন, লবণশিল্প নিয়ে ২১ নভেম্বর সকাল ১১ টায় শিল্প মন্ত্রণালয়ে সভা ডাকা হয়েছে। ওই সভায় আমি উপস্থিত থাকব। সেখানে গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত হবে বলে আশা করছি।
ইসলামপুর লবণমিল মালিক সমিতির সভাপতি শামসুল আলম আজাদ প্রশ্ন রেখে বলেন, কষ্টে উৎপাদিত ফসলের দাম না পেলে কেন চাষিরা মাঠে নামবে? আগে ন্যায্যমূল্য প্রাপ্তি নিশ্চিত করতে হবে। আস্থা ফেরাতে পারলেই এই শিল্পকে রক্ষা করা সম্ভব।
লবণের কৃত্রিম সংকট সৃষ্টি করে আমাদানিকারক সিন্ডিকেট আবারো সক্রিয় হচ্ছে কিনা? খতিয়ে দেখা দরকার বলে মনে করেন শামসুল আলম আজাদ।
খোঁজখবর নিয়ে জানা গেছে, ৮০ কেজির লবণের বস্তা মাঠ পর্যায়ে বিক্রি হচ্ছে ৩০০-৩৫০ টাকা দরে। সে হিসেবে কেজিতে পড়ছে মাত্র ৪ টাকা। যা দিয়ে মজুরি বা উৎপাদন খরচও সামাল দিতে পারছেনা চাষিরা। অথচ বাজারে প্যাকেটজাত লবণ কেজিতে বিক্রি করা হয় প্রায় ৪০ টাকা। উৎপাদনের পর থেকে বাজারে পৌঁছা পর্যন্ত অন্তত ৩টি হাত বদল হয় লবণের। প্রত্যেক হাতে লাভ পড়ে। কেবল লোকসান সয়েই যেতে হচ্ছে ‘চিরবঞ্চিত’ চাষাদের।
তিনি বলেন, লবণশিল্প নিয়ে ২১ নভেম্বর সকাল ১১ টায় শিল্প মন্ত্রণালয়ে সভা ডাকা হয়েছে। ওই সভায় আমি উপস্থিত থাকব। সেখানে গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত হবে বলে আশা করছি।
বাংলাদেশ ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্প করপোরেশন (বিসিক) কক্সবাজারের লবণ শিল্প উন্নয়ন প্রকল্প কার্যালয় সূত্র জানায়, ২০১৯-২০ মৌসুমে বিসিকের চাহিদা ১৮ লাখ ৪৯ হাজার মে.টন। লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে ১৮ লাখ ৫০ হাজার মে.টন।
২০১৮-১৯ মৌসুমে কক্সবাজার জেলায় উৎপাদনযোগ্য লবণ জমির পরিমাণ ছিল ৬০ হাজার ৫৯৬ একর। চাষির সংখ্যা ২৯ হাজার ২৮৭ জন। এই মৌসুমে লক্ষ্যমাত্রা ছিল ১৮ লাখ মে. টন। বিপরীতে উৎপাদন হয়েছে ১৮ লাখ ২৪ হাজার মে.টন। যা বিগত ৫৮ বছরের লবণ উৎপাদনের রেকর্ড ছাড়িয়েছে।
লবণমিল মালিক, ব্যবসায়ী, চাষিদের মতে- দেশে লবণের বাজার স্বাভাবিক রয়েছে। কোন ধরনের ঘাটতি নাই। বর্তমান যে পরিমাণ লবণ উদ্বৃত্ত রয়েছে তা দিয়ে আরো অন্তত দুই মাস চলবে। একশ্রেণীর অসাধু ব্যবসায়ী লবণের সংকট দেখিয়ে দাম বৃদ্ধির অপচেষ্টায় লিপ্ত রয়েছে। ইতিমধ্যে একটা কুচক্রিমহল লবণের কেজি ১৫০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে বলে অপপ্রচার চালিয়েছে। তারা মূলত এ শিল্পকে ধ্বংস করতে চাচ্ছে। অপপ্রচারকারীদের চিহ্নিত করে দ্রুত আইনগত ব্যবস্থা নিতে হবে।
এদিকে, ১৯ নভেম্বর কক্সবাজারে অনুষ্ঠিত বাংলাদেশ লবণ মিল মালিক সমিতির সাধারণ সভায় সমিতির সভাপতি নুরুল কবির বলেছেন, বর্তমানে তাদের হিসেবে তিন লক্ষ মেট্রিক টনের ওপরে লবণ উদ্বৃত্ত। কিছু মিল মালিকের কারণে মানব স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর সোডিয়াম সালফেট বাজারে সয়লাব হয়ে গেছে। বন্ড লাইসেন্স, কাস্টিং সল্ট ইত্যাদি নামে লবণ আমদানি করছিল একটা শ্রেণী। আমাদের কঠোরতায় ওই রকম লবণ আমদানি বন্ধ হয়েছে।
তিনি বলেন, লবণের জাতীয় চাহিদা নিরূপণে সবাইকে এক টেবিলে বসতে হবে। আমরা লবণ ব্যবসায়ী ঐক্যবদ্ধ হলে এই শিল্পকে বাঁচানো সম্ভব। ঘরের সমস্যা ঘরেই সমাধান চাই।
লবনমিল মালিকদের একটি সুত্র জানিয়েছে, বিসিকের অসাধু কর্তারা কারসাজি করে কালোবাজারিদের সুযোগ করে দেয়। যে কারণে বারবার দেশীয় লবণশিল্প মার খাচ্ছে। উদ্বৃত্ত থাকার পরও প্রতি বছর লবণ আমদানি করা হয়। টেক্স ফ্রি সোডিয়াম সালফেট ছড়িয়ে দিচ্ছে বাজারে।
নির্ভরযোগ্য একটি সুত্রে জানা গেছে, বাংলাদেশ লবণমিল মালিক সমিতির শীর্ষস্থানীয় একজন নেতা দেশে ২৪-২৫ লক্ষ মে. টন চাহিদা দেখিয়ে লবণ আমাদানির অনুমতির জন্য গত ১৭ জুলাই প্রধানমন্ত্রীর কাছে আবেদন করেছিলেন। অথচ দেশে লবণের চাহিদা সর্বোচ্চ ১৮ লাখ মে. টন। মূলতঃ এই জাতের লোকজনই দেশীয় লবণশিল্পের জন্য ‘বিষধর সাপ’ মন্তব্য করেন সাধারণ লবণ ব্যবসায়ীরা।
লবণ মিল মালিক, ব্যবসায়ী, চাষিসহ সংশ্লিষ্টদের দাবী- দেশীয় লবণশিল্প বাঁচাতে সমস্ত লবণ আমদানি বন্ধ করতে হবে। ন্যায্য মূল্য নিশ্চিত করতে না পারলে মাঠে ফেরানো যাবেনা চাষিদের। লবণের পরনির্ভর হবে দেশ, বাড়বে বেকারত্ব। সুডিয়াম সালফেটের আড়ালে যারা ইন্ডাস্ট্রিয়াল সল্ট, সোডিয়াম ক্লোরাইড আমদানি তাদের কঠোর হস্তে দমন করতে হবে।