নিজস্ব প্রতিবেদকঃ
‘একদিকে পাহাড় অন্যদিকে সাগর, টেকনাফের হ্নীলা জাদিমোরা প্রধান সড়কের পশ্চিম পাশে পাহাড়ের পাদ দেশ, পশ্চিম দিকে আবার রোহিঙ্গা অধ্যুষিত এলাকা। সাগর ও পাহাড় মিলে নয়নাভিরাম সৌন্দর্য বিরাজমান। তবে এই সৌন্দর্যময় এলাকাকে বিনষ্টে নেমেছে প্রভাবশালী মাদক চক্র। তাদের সিন্ডিকের সদস্যদের মরণ নেশা ইয়াবা ও দেশীয় অস্ত্রপাচারের একাধিক চক্র রয়েছে। ক্ষুদ্র ও বৃহৎ সিন্ডিকেটের মাধ্যমে পাচার হচ্ছে এই মরণ নেশা ইয়াবা ট্যাবলেট। তাছাড়া স্কুল, কলেজ পড়ুয়া ছাত্ররাও ইয়াবা আসক্তি হয়ে জড়িয়ে পড়ছে তাদের ব্যবসার সিন্ডিকেটের সঙ্গে। আবার রোহিঙ্গা ক্যাম্প তাদের নিয়ন্ত্রনে হওয়ায় সন্ত্রাসী কার্যকলাপের মাধ্যমে রোহিঙ্গাদের জীম্মি করে মুক্তিপনের মাধ্যমে টাকাও হাতিয়ে নিচ্ছে এই শক্তিশালী ৩০ জনের ইয়াবা সিন্ডিকেট। তাদের সিন্ডিকেটের অন্যতম সদস্য ছৈয়দ হোসেন খলিফা কোস্টগার্ডের হাতে ৭ হাজার ইয়াবাসহ আটক হলেও রয়ে গেছে আলোচিত ইয়াবা সম্রাট সিরাজ উল্লাহ’র নেতৃত্বে আরো ২৯ ইয়াবা কারবারী।
তারা সীমান্তবর্তী এলাকার বাসিন্দা হওয়ায় সহজে সাগর পথে নৌযানে হারহামেশায় ইয়াবা ট্যাবলেট ঢুকায় অনায়সে। এলাকায় ইয়াবা ট্যাবলেটের চালান ঢোকার পর সেখান থেকে বিভিন্ন ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীর মাধ্যমে পাচার করছে রোহিঙ্গা ক্যাম্পে এবং কক্সবাজার চট্টগ্রামসহ সারাদেশে। সবমিলিয়ে জাদিমোরা এলাকাকে ইয়াবা ও অস্ত্রের স্বর্গরাজ্যে পরিণত করেছে ৩০ জনের এই ইয়াবা সিন্ডিকেট। এই যখন জাদিমোরার অবস্থা আইনশৃঙ্খলা বাহিনী ছোটখাটো অভিযানে ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী ও অস্ত্রধারীকে আটক করলেও বৃহৎ সিন্ডিকেটের হোতারা রয়েছে পুলিশের ধরাছোঁয়ার বাইরে। সম্প্রতি টেকনাফ থানা পুলিশের অভিযানে রোহিঙ্গা ডাকাত নুর মোহাম্মদসহ বন্দুকযুদ্ধে একাধিক ডাকাত নিহত হওয়ায় বিভিন্ন ডাকাত বাহিনীর সদস্যরা জাদিমোরা এলাকার পাহাড়ের পাদদেশে অবৈধ অস্ত্রধারী ডাকাত দল অবস্থান করায় সাধারণ মানুষের মাঝে আতঙ্ক বিরাজ করছে। এলাকাবাসী একাধিকবার থানা, র‌্যাব, সেনাবাহিনীর হস্তক্ষেপ চাইলেও কোন প্রকার সুরাহা হচ্ছে না। তাছাড়া প্রশাসনের কতিপয় কর্তাদের সাথে ডাকাত দলের সাথে সম্পর্ক থাকায় আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর অভিযানের খবর তাদের কাছে আগেই পৌঁছে যায়।
হ্নীলা ইউনিয়নের জাদিমোরায় রয়েছে বিশাল ইয়াবা ও অস্ত্র পাচারকারী সিন্ডিকেট। এদের নিয়ন্ত্রণে রয়েছে কতিপয় রাজনৈতিক নেতা ও জনপ্রতিনিধি। মায়ানমার হতে সমুদ্রপথে কোন নৌযানের মাধ্যমে কোন প্রকার বাধা ছাড়াই এলাকায় অনায়াসে প্রবেশ করছে মরণনেশা ইয়াবা। মিয়ানমার হতে মূল সিন্ডিকেটের হাতে ইয়াবা পৌঁছানোর পর ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীদের নিকট সহজেই পৌঁছে দিচ্ছে তারা। এই সিন্ডিকেটে রয়েছে চিহ্নিত মানবপাচারকারী, ডাকাত, ইয়াবা কারবারীরা।
স্থানীয় বাসিন্দাদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, জাদিমোরা স্টেশনের পশ্চিম পাশে গড়ে উঠেছে ইয়াবা পাচারের বিশাল সিন্ডিকেট। সাগরপথ দিয়ে আসা ইয়াবা ট্যাবলেট অনায়াসে ঢুকে রোহিঙ্গা ক্যাম্পের বিভিন্ন লোকালয়ে প্রবেশ করে এলাকায় ও কক্সবাজারের বিভিন্ন স্থানে পৌঁছে যাচ্ছে। সবমিলিয়ে এলাকার সুশীল সমাজ ও মানুষের বর্ণনা মতে জাদিমোরা এলাকা হয়ে উঠেছে ইয়াবা ও অস্ত্রপাচারের স্বর্গরাজ্য।
‘চলো যাই যুদ্ধে’-মাদকের বিরুদ্ধে এমন স্লোগান নিয়ে শুরু হওয়া মাদকবিরোধী অভিযানেও এই জাদিমোরার সিন্ডিকেট পরোয়া করেনা প্রশাসনকে। তারা একের পর এক কৌশল পাল্টিয়ে ইয়াবা ব্যবসা চালিয়ে যাচ্ছে।
গত ৫ নভেম্বর কোস্টগার্ড দক্ষিণ-পূর্বজোনের টেকনাফ বিসিজি ষ্টেশনের জওয়ানেরা জাদিমোরা বাজারের হার্ডওয়ারের দোকানে অভিযান চালিয়ে গ্যাস সিলিন্ডারের ভেতরে লুকিয়ে রাখা ৭ হাজার পিস ইয়াবাসহ দোকানের মালিক ৩০ জনের সিন্ডিকেটের অন্যতম সদস্য বাছা মিয়ার পুত্র ছৈয়দ হোসেন (৩০) কে আটক করা হয়। বর্তমানে তিনি কক্সবাজার জেলা কারাগারে রয়েছে। তাকে রিমান্ডে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করা হলে রাঘববোয়াল ও অনেক ইয়াবা ব্যবসায়ীর অজানা কাহিনী জানা যাবে।
তথ্যসুত্রে জানা গেছে, এই ভয়ংকর ৩০ জনের ইয়াবা সিন্ডিকেটের নেতৃত্ব দিচ্ছে সিরাজ উল্লাহ নামক ব্যক্তি। তার স্থায়ী বাড়ি টেকনাফ জালিয়াপড়া হলেও বর্তমানে পালিয়ে জাদিমোরায় গোপন আস্তানায় অবস্থান করে ইয়াবা ও সন্ত্রাস কার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছে।
তার বিরুদ্ধে রয়েছে অন্তত ৬ টি মামলা। তারমধ্যে চট্টগ্রামে দুটি, কক্সবাজার সদর থানায় ১টি, ইয়াবা মামলা ৩টি। তিনি সম্প্রতি নিহত নুর মোহাম্মদ ডাকাতের হাল ধরে এলাকার লোকজন ও রোহিঙ্গাদের ভয়ভীতি দেখিয়ে বিপুল টাকাও হাতিয়ে নিচ্ছে বলে অভিযোগ করেছেন এলাকাবাসী।
মো: রহিম, মো: করিম, আমির হামজা, সহযোগি জুহুর আলম ও আবদুল গফুর ইয়াবা সিন্ডিকেটের অন্যতম হোতা বলে জানা গেছে। তাদের মধ্যে আমির হামজার বিরুদ্ধেও রয়েছে বিস্তর অভিযোগ।
আমির হামজা ২০১২ সালে মানবপাচারের মামলায় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রনালয়ের তালিকাভুক্ত আসামী। তার নামে মালেশিয়ায় নৌকাডুবির ঘটনায় ২টি মামলা রয়েছে। তিনি হত্যা মামলারও চার্জশীটভুক্ত আসামী।
এলাকার লোকজন জানিয়েছে, চিহ্নিত ইয়াবা কারবারিদের কাছে এলাকার মানুষ অনেকটা জীম্মি। তাদের দখলে রয়েছে ইয়াবার প্রবেশদ্বার খ্যাত জাদিমোরা, ওমরখাল, জাদিরখাল, হাজিরখাল। তারা এই ঘাট দিয়ে সরাসরি মিয়ানমার থেকে বিভিন্ন ফিশিংবোট দিয়ে ইয়াবা খালাস করে তাদের আস্তানায় নিরাপদে নিয়ে যায়। এরপর রোহিঙ্গা ও পাচারকারীদের মাধ্যমে কক্সবাজারসহ সারাদেশে ছড়িয়ে দেয়।
মরণ নেশা ইয়াবা পাচার ও সন্তানদের নেশার আসক্তি হতে বাঁচাতে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর উর্ধতন কর্তৃপক্ষের কাছে দ্রুত অভিযানের আহ্বান জানিয়েছেন ওই এলাকায় বসবাসকারী সাধারণ মানুষ।
এ ব্যাপারে টেকনাফ থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) প্রদীপ কুমার দাস জানান, এলাকায় মাদক ও ইয়াবা পাচার রোধে পুলিশ সর্বদা সতর্ক রয়েছে। ইতোমধ্যে অনেক ইয়াবা ও অস্ত্র পাচারকারীসহ শীর্ষ অপরাধী বন্দুকযুদ্ধে নিহত হয়েছে। মোদ্দাকথা কাউকে টেকনাফের মাটিতে ইয়াবা ও সন্ত্রাসবাদ করতে দেওয়া হবেনা। মরণ নেশা ইয়াবা ট্যাবলেট ৩০ জনের সিন্ডিকেট সম্পর্কে জানতে চাইলে তিনি বলেন, বিষয়টি নজরদারির মধ্যে রাখা হয়েছে শীঘ্রই অভিযান পরিচালনা করা হবে।