-কাফি আনোয়ার 

নেতৃত্বে, দুরদর্শিতায় , সাংগঠনিক দক্ষতায় , জ্ঞানে প্রজ্ঞায় , নিপুন বাগ্মিতায় , জনবান্ধব সম্মোহনী কুশলে অকাল প্রয়াত আলমগীর চৌধুরী হিরু ছিলেন কক্সবাজারের মাটি ও মানুষের হৃদয়ের স্পন্দন।মগজে বঙ্গবন্ধু, মননে উদার বাঙ্গালী জাতিসত্ত্বা ও অসাম্প্রদায়িক চেতনার স্বতঃশচ্ল স্রোতধারা, হৃদয়ে মুক্তিকামী মানুষের অব্যক্ত বেদনা বুঝার অকৃত্রিম ধীশক্তি, যা অপরিণত বয়স সত্ত্বেও তাঁকে দিয়েছিল অনন্যসাধারণ ও পরিপক্ক মানবিকতা। একাত্তরের রণাংগনের সূর্যসারথী বীরমুক্তিযোদ্ধা পিতা মাষ্টার ছৈয়দুল আলম ছিলেন প্রগতিশীল চিন্তার মুক্তমনের মানুষ। শিক্ষক ,সংস্কৃতিকর্মী, ক্রীড়াবিদ, মুক্তিযোদ্ধা ও মুক্তিযুদ্ধের সংগঠক হিসেবে কক্সবাজার জেলার সর্বত্র তাঁর নামডাক। মাষ্টার ছৈয়দুল আলমের (আলম মাস্টার) অভিজাত ও মুক্তচিন্তা ঘরানার পরিবারে বাবর , হুমায়ুন, আলমগীরের স্বকীয় চেতনার মুঘল সম্রাজ্যবৎ বলয় সৃষ্টি করে সন্তানের সুপ্তপ্রতিভা বিকাশের ক্ষেত্রকে প্রসারিতই শুধু করেননি করেছেন নির্ভার ও সমৃদ্ধও। সেই সময়ে বৃহত্তর ঈদগাঁও’র মুক্তিযুদ্ধের স্বপক্ষশক্তি কিংবা বঙ্গবন্ধুর চেতনাধারী কিংবা আওয়ামীলীগ বলতে এই আলম মাষ্টারের পরিবারই ছিল একমাত্র কেন্দ্রবিন্দু। যে কারণে এই পরিবারটি মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন সময়ে এবং তৎপরবর্তীকালে হানাদার বাহিনী ও প্রতিক্রিয়াশীলচক্রের অগ্নিদাহ এবং বিষাক্ত থাবায় উপর্যুপরি ক্ষতবিক্ষতও হয়েছে।
আলমগীর চৌধুরী হিরু আওয়ামী ছাত্রলীগের রাজনীতির মাধ্যমে বাংলাদেশের মুলধারার রাজনীতিতে দাপটের সাথে এদতাঞ্চলের গণমানুষের প্রতিটি আনন্দ বেদনার সারথী হয়ে তাদের অধিকার আদায়ে লড়াই করে গেছেন আমৃত্যু ।
শৈশব থেকেই তুখোড় মেধাবী ও ক্যারিশম্যাটিক চরিত্রের অধিকারী আলমগীর চৌধুরী হিরু’র জন্ম ,বেড়ে উঠা,শারীরিক ও মানসিক বিকাশ, প্রাকরাজনৈতিক প্রস্তুতিপর্ব অনুপঙ্খভাবে সম্পন্ন হয়েছে আদর্শ পিতার প্রত্যক্ষ তত্ত্বাবধানে। শিক্ষাশিল্পসংস্কৃতি চর্চার পারিবাবিক আবহে মানস ও মূল্যবোধ গঠন, সৃজনশীলতা ও মননশীলতা বিকাশে শিক্ষক পিতার সুনিপুণ পথনির্দেশনা কৈশোর ও কৈশোরোত্তর সময়ে তাঁকে দিয়েছে একটি ব্যতিক্রমি নেতৃত্ব,মানবহিতৈষী চেতনা এবং লক্ষ্যভেদী দৃঢ়তা যা পরবর্তীতে সময়ের সাথে সাথে পরিস্ফুট হয়েছে,হয়েছে পরিব্যাপ্ত ও সুশোভিত।
পচাঁত্তর পরবর্তী বাংলাদেশের রাজনীতির পটপরিবর্তনের ধারাবাহিকতায় সেনাছাউনীনির্ভর দেশশাসনে ক্ষতবিক্ষত ও ভঙ্গুর আওয়ামী রাজনীতির বাতাবরণে পশ্চাৎপদতার রাহুগ্রাস, চারদিকে আওয়ামীবিদ্বেষী রগরগে নেতিবাচক মনোবৃত্তি , স্বৈরচারের বুলেটনির্ভর ব্যালেটী গণতন্ত্রের অন্তিমযাত্রা, সেই উত্তঙ্গু সময়ে ককসবাজার জেলা ছাত্রলীগের সভাপতির দায়িত্ব নিয়ে এই অঞ্চলের ছাত্রসমাজের কুপমন্ডুক দৃষ্টিভঙ্গি ও স্থবিরতা ভেঙ্গে জ্বালিয়েছে শিক্ষা-শান্তি-প্রগতির প্রদীপ। সংগঠিত করেছেন ব্যাকফুটে চলে যাওয়া বঙ্গবন্ধুর আদর্শ, মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ও মুল্যবোধে জাগ্রত আপামর জনগোষ্ঠিকে ।
ছাত্রলীগের সভাপতি থাকা অবস্থায় ১৯৯০ সালে উপজেলা পরিষদ নির্বাচনে চেয়ারম্যান প্রার্থী হিসেবে নির্বাচন করে আদায় করেছেন তুমুল জনপ্রিয়তা ও গণমানুষের নিখাদ ভালবাসা। তাঁর অনলবর্ষী ও সম্মোহন জাগানিয়া বাগ্মীতায় এঅঞ্চলের মানুষ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ছায়া খুঁজেছে, চরম মুগ্ধতায় উচ্ছ্বসিত হয়েছে , আবেগে ভালবাসায় আপ্লুত হয়েছে , নেতা পেয়েছি বলে তৃপ্ত হয়েছে।
নির্মোহ সেই ভালবাসা বর্ণনাতীত বলে তাঁর নির্বাচনী মিছিলে হাসতে হাসতে হিরু হিরু , জয়ধবনিতে মৃত্যুকে আলিঙ্গন করেছে ৩ টগবগে নওজোয়ান।
৯০’র স্বৈরচারবিরোধী আন্দোলনে তাঁর বলিষ্ঠ নেতৃত্বে কক্সবাজারের রাজপথ উত্তাল হয়েছে, দুর্বার এই আন্দোলনে সংগঠিত করেছেন সর্বস্তরের পেশাজীবি-কর্মজীবি, ছাত্রশিক্ষক-কৃষক-শ্রমিক-মজুর’সহ মেহনতী জনতাকে।
১৯৯২ সালে যখন ভারতের বাবরী মসজিদকেন্দ্রিক উত্তেজনা উপমহাদেশের পরতে পরতে ছড়িয়ে পড়ে আক্রান্ত হয়েছে আবহমান বাংলার সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতিও সেই মুহুর্তে আলমগীর চৌধুরী হিরুর বিচক্ষন নেতৃত্বে বৃহত্তর ঈদগাঁ’র ছাত্রলীগ-যুবলীগ-আওয়ামীলীগ ও অসাম্প্রদায়িক চেতনার যুবসমাজকে সংগঠিত করার মাধ্যমে প্রতিরক্ষাবর্ম তৈরী করে রক্ষা করেছে পালপাড়া, হিন্দুপাড়া হরিপুর’সহ বিভিন্ন এলাকার সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের বাড়িঘর, মন্দির ও তাদের ধনসম্পদ।
একুশের প্রভাত ফেরী থেকে শুরু করে মুক্তিযুদ্ধের বিজয়োৎসব, দেশের মেহনতী আর্তপীড়িত ভাগ্যাহত মানুষের অধিকার আদায়ের সংগ্রামে, রাজনৈতিক ও প্রগতিশীল আন্দোলনে রাজপথের অগ্রভাগে অসম সাহস ও দৃঢ়তায় আলমগীর চৌধুরী হিরু ছিলেন নির্ভীক সেনাপতি।
আলমগীর চৌধুরী হিরু সম্পর্কে চটগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রলীগের সাবেক সভাপতি আবু তাহের বলেছিলেন, হিরু আমার অনুজ , তবে তাঁর মধ্যে নেতৃত্বের যে গুণাবলী ছিল তা সমসাময়িক কোন নেতার মধ্যে ছিল না। মানুষ হিসেবে তাঁর মহত্ত্ব সর্বজনবিদিত ।
সাবেক ছাত্রনেতা ও বর্তমান জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল (জাসদ)
কক্সবাজার শহর শাখার সভাপতি জননন্দিত নেতা মোহাম্মদ হোসাইন মাসু বলেন ,হিরু আমার বন্ধু । তাঁর বন্ধুবৎসল্যতা ছিল অতুলনীয়। আমরা একসাথে রাজপথে আন্দোলন করেছি। তাঁর রাজনৈতিক প্রজ্ঞা, বিচক্ষনতা ও সাংগঠনিক দক্ষতা এই সময়ে রাজনীতির অঙ্গনে খুঁজে পাওয়া দুষ্কর। মানুষ হিসেবে হিরু ছিলেন একেবারে সাদামাটা, নিরংহকারী ও পরোপকারী ।
যার আপাদমস্তক ছিল নেতা ও নেতৃত্বের নান্দনিক কাব্যময়তা। জীবনসংগ্রামের প্রতিক্ষণে লালন করেছেন বঙ্গবন্ধুর আর্দশ। তৈরী করেছে হাজার হাজার ভাবশিষ্য, নেতা, কর্মী, আওয়ামী সহযোদ্ধা। জীবনের সর্বস্ব বিলীন করেছেন মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ও মুল্যবোধের অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশের বিনির্মাণের মরণপণ সংগ্রামে তাঁর একক চেষ্টায় ঐতিহ্যবাহী ঈদগাহ হাই স্কুল মাঠে তৎকালীন বিরোধীদলীয় নেত্রী ও বর্তমান প্রধানমন্ত্রী জননেত্রী শেখ হাসিনা একাধিকবার জনসভা করেছে ।
২০১১ সালের ১১ নভেম্বর দুর্দিনের এই কান্ডারী সবাইকে শোকে মুহ্যমান করে চলে গেলেন না’ফেরা গন্তব্যে।
দীর্ঘ রাজনৈতিক জীবনে নানা ঘাতপ্র্রতিঘাত, চড়াই উতরাই দলিতমথিত করে আলমগীর চৌধুরী হিরু শেষনিঃশ্বাস ত্যাগ করা পর্যন্ত আদর্শ,মুক্তিযুদ্ধের চেতনাকে সমুন্নত রেখেছেন ।
বর্তমানে আওয়ামীলীগ নেতৃত্বধীন সরকার রাষ্ট্র ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত । জননেত্রী বাংলাদেশের মানুষকে আত্মসম্মানবোধসম্পন্ন জাতি হিসেবে ব্রান্ডিং করার পাশাপাশি দেশের উন্নয়ন সমৃদ্ধিরচিত্র দিনদিন উধর্বমুখী করছেন, বাংলাদেশ এখন বিশ্বের উন্নয়ন মডেল । তাই বর্তমান আওয়ামীলীগে বঙ্গবন্ধুর আর্দশের নামধারী প্রেতাত্মাদের অভাব নেই। অতিথি পাখি,মৌসুমী পাখি , ভুঁইফোড় নেতা,সুযোগসন্ধানী নেতা ,হাইব্র্রীড সবই আছে নেই শুধু আলমগীর চৌধুরীর হিরুর মত বিচক্ষন নেতা ও সংগঠক।
বর্তমান নেতাদের কত খেতাব, পদবী, কত বাহারী অলংকার, আত্মস্বীকৃত বনেদী নাম।
যারা দলের জন্য দেশের জন্য জীবনের সর্বস্ববাজী রেখে অকাতরে বিলীন হয়ে গেছেন, তাদের কবরে কী একটি ফুলও জোটে না। অখ্যাত কত নেতার নামে শোকসভা হয়, নাগরিক স্মরণসভা হয়, মিলাদ হয় দলীয় উদ্যোগে। আলমগীর চৌধুরী হিরু নামে আজ পর্যন্ত বিবৃতিও তো দেয়নি দল। তিনি কক্সবাজার জেলা ছাত্রলীগে সভাপতি ছিলেন। সদর উপজেলা আওয়ামীলীগের সাধারণ সম্পাদক হিসেবে দীর্ঘদিন দক্ষতার সাথে দায়িত্ব পালন করেছেন। বিপুল ভোট ও জনপ্রিয়তায় কক্সবাজার সদর উপজেলা পরিষদের ভাইস চেয়ারম্যান নির্বাচিত হয়েছেন। তবে কী এই বয়ানের সবটাই তাঁর গর্হিত অপরাধ ছিল ? ছাত্রলীগ , আওয়ামীলীগের জন্য জীবনের সর্বস্ব ঢেলে দিয়ে তৃণমূল পর্যায়ে দলকে সুসংহত ও সুসংগঠিত করার মাধ্যমে জাতিরজনকের সোনার বাংলা ও মুক্তিযুদ্ধের চেতনার আধুনিক,সমৃদ্ধ ও অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশ বিনির্মাণের সহযোদ্ধা হওয়াটাও কী তবে অপরাধ নয় ? যদি তাই হয় ,তবে কী বর্তমানের সব নেতারাও কালের বিবর্তনে দাগী অপরাধে দন্ডিত হবেন না ? এই নিমর্মতা কী বর্তমানকে ইতিহাসের স্রোতে ভাসাবে না কোনদিন ?
কবরের উপর গজিয়ে উঠা
ঘাসের ডগায়
সে কারো অশ্রু নয়,
নয় কোন বিগলিত নীর
সে তো আকাশের কান্না ,
কেবলই শিশির।